শাসক বনাম গবেষক
শিরোনাম ঋণ: নীলাঞ্জনা
বড় লেখা, পড়তে পারেন, নাও পড়তে পারেন 🙏
সম্প্রতি ব্যারাকপুরে সারদা মাল্টিস্পেশালিটি হাসপাতালে মহামহিম কৌস্তুভ বাগচী কয়েকজন ডাক্তারকে মারাত্মক অপমান করেছেন। অবশ্য উনি ধরাছোঁয়ার বাইরে – নিজেই বলেছেন ওনাকে ছোঁয়ার যোগ্যতা ওখানে উপস্থিত ভদ্রলোকের নেই। টিকিধারি মানুষ বলে কথা – আবার বিজেপির লোক, ছুঁলে যদি জাত চলে যায়! অবশ্য ওনার জাত ঠিক কী জানিনা, আগে তো কংগ্রেসি ছিলেন, এখন গোবরের দলে নাম লিখিয়েছেন।
গোবরদের দলের আরেক গোয়ার নেতা বিশ্বজিৎ রানে ক’দিন আগে একই নাটক করেছিলেন। এঁদের এই নাটকগুলো জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির ছক যেমন, তেমনি এঁদের বিজ্ঞানদ্বেষণ এবং বিদ্বজনবিরাগেরও বহিঃপ্রকাশ। যে বিজেপি দল সমস্ত কেন্দ্রীয় শিক্ষায়তনে বিনিয়োগ হ্রাস করে, বৃত্তিতে রাশ টেনে গায়ত্রী মন্ত্র নিয়ে গবেষণায় মনোনিয়োগ করে, তাঁদের প্রতিনিধির কাছে আমরা আর কী প্রত্যাশা করবো!!
তবে দোষ বিজেপির নয় – এই লেখার মাধ্যমে এটাই আমি প্রমাণ করবো। ইতিহাস প্রমাণ দেবে বিভিন্ন যুগে শাসক সততই বিজ্ঞানবিদ্বেষী হয়। সে ডানপন্থাতেই স্বচ্ছন্দ – বিজ্ঞানের প্রশ্নবাণ তার পছন্দ হয়না। সে মনে করে সে যথেষ্ট বিজ্ঞানবোদ্ধা – কখনো সে চলন্ত গাড়িতে সাংবাদিককে গড়গড় করে ওষুধের নাম বলে দেয়, কখনো বলে মেঘ থাকলে রাডার পেরিয়ে যেতে সুবিধা হবে। এগুলো বলে সে আত্মসুখ লাভ করে। আজকের যুগে দাঁড়িয়েও এই ধারা যে চলছে, তাতে এটাই প্রমাণ হয় – মানবসমাজ আজও তিমিরেই আছে, তালপাতা থেকে কম্পিউটারের স্ক্রিনে তার উত্তরণটা নিতান্তই বাহ্যিক, সামগ্রিক সমাজজীবনে সে এখনো কুসংস্কারের বেড়ায় বন্দী।
সক্রেটিস
সক্রেটিসের গল্প তো সকলের জানা। তিনি মানুষকে প্রশ্ন করতে শিখিয়েছিলেন এই তাঁর দোষ। এথেন্সের চিরাচরিত ধারণা, ঈশ্বরবিশ্বাসকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করানোর পাপে সাজা হলো তাঁর। বলা হলো তিনি যুবসমাজকে বিপথগামী করছেন। নিজের অন্তরাত্মার কথা শুনে চলার উপদেশকে ঈশ্বরবিদ্বেষ হিসাবে দেখানো হলো। বিচার হলো, বিচারের নামে প্রহসন!! তবু সক্রেটিস ক্ষমা চাইলেন না, সত্যের পথে অবিচল থাকলেন – হাসিমুখে হেমলক পান করলেন তিনি।
গ্যালিলিও
পৃথিবীকে কেন্দ্র করে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের আবর্তন, যা খৃষ্টীয় ধ্যানধারণার মূলতত্ত্ব ছিল তাকে প্রশ্ন করেন গ্যালিলিও। স্বাভাবিকভাবেই তাঁর জীবন দুর্বিষহ করে তোলেন পাদ্রীরা। এবারও হলো বিচার। তাঁকে দিয়ে জোর করে বলানো হলো তাঁর গবেষণা ভুল, সূর্যই পৃথিবীর চারিদিকে প্রদক্ষিণ করছে। তাঁকে করে দেওয়া হলো গৃহবন্দি – গবেষণা হলো স্তব্ধ। চোখের আড়ালেই থেমে গেলো এত বড় বৈজ্ঞানিকের জীবন। ১৯৯২ সালে পোপ গ্যালিলিওর প্রতি ক্যাথলিক চার্চের এই অবিচারের জন্য আনুষ্ঠানিক ভাবে ক্ষমাপ্রার্থনা করেন।
লুইগি গ্যালভানি
এই ভদ্রলোক আবিষ্কার করেন স্নায়ুতন্তু তড়িৎ পরিবহনে সক্ষম। স্নায়ুর আবরণ যে তাকে আরো দ্রুত তড়িৎ পরিবহনে সাহায্য করে তার ধারণাও ছিল গ্যালভানির। কিন্তু তাঁর ধারণাকে মান্যতা দেননি ভোল্টা। নেহাতই দুটো ভিন্ন ধাতুর মধ্যে তড়িৎ প্রবাহ হয়েছে বলে গ্যালভানির পরীক্ষাটাই তিনি খারিজ করে দেন। তদানীন্তন শাসক নেপোলিয়নের খুব কাছের মানুষ ভোল্টা – তাঁর কথাটাই রইলো। অনাড়ম্বর শেষকৃত্যে চলে গেলেন গ্যালভানি। মৃত্যুর পর তাঁর কাজ স্বীকৃতি পেলো, আজকের ইলেকট্রোফিসিওলজির মূল কাণ্ডারি বলা যায় ওনাকে।
আলবার্ট আইনস্টাইন
জন্মসূত্রে ইহুদী হওয়ায় বিশ্বসেরা পদার্থবিদ আইনস্টাইনকেও হেনস্তা হতে হয়। নাৎসীরা জার্মানিতে ক্ষমতায় আসার পরই ওনার বিরুদ্ধে পত্রপত্রিকায় লেখালেখি শুরু হয়। আইনস্টাইনের গবেষণাপত্র খোলা রাস্তায় পোড়ানো হয়। প্রুসিয়ান একাডেমি থেকে ওনাকে বহিষ্কার করা হয়। আইনস্টাইন জার্মানিতে আর ফিরতে পারেননি।
আইনস্টাইন নোবেল পুরস্কার পান ফটোইলেকট্রিক ইফেক্টের উপর কাজের জন্য, তাঁর বিশ্ববিখ্যাত আপেক্ষিকতাবাদের তত্ত্ব স্বীকৃতি পায়নি তখন। জার্মানিতে তাঁর এই তত্ত্বকে ‘ইহুদী বিজ্ঞান’ বলে হেয় করা হতো।
ওপেনহাইমার
নিউক্লিয়ার গবেষণার প্রাণপুরুষ ওপেনহাইমার, ম্যানহাটন প্রজেক্টের মাস্টারমাইন্ড। যতদিন এই প্রজেক্টে আমেরিকার সরকারের পাশে কাজ করেছেন, সকলে মাথায় করে রেখেছে। অথচ হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে বিধ্বংসী হত্যালীলার পর যখন হাইড্রোজেন বোমার বিপক্ষে গেলেন তিনি, তখনই সরকারের চক্ষুশূল হয়ে উঠলেন ওপেনহাইমার। তখন তিনি হয়ে গেলেন রাশিয়ার গুপ্তচর। এক প্রকার তাঁর গবেষণার ক্যারিয়ারই শেষ করে দেওয়া হলো।
সুভাষ মুখোপাধ্যায়
এই মানুষটা বাংলার সবচেয়ে বড় উদ্ভাবন করেছিলেন বললেও কম বলা হয় – টেস্ট টিউব বেবি। নিজের ফ্ল্যাটে সামান্য সরঞ্জামের মাধ্যমে এবং একটা সাধারণ ফ্রিজকে কাজে লাগিয়ে জন্ম দিলেন দুর্গার। সেই খবর মিডিয়া জানলো, জানলো পশ্চিমবঙ্গ সরকার – শিক্ষিত (!) মানুষদের সরকার বাম সরকার। খবর পেয়ে তাঁরা সুভাষবাবুকে নিয়ে আহ্লাদ করলো না, বরং বসালো কমিশন পেটোয়া ডাক্তারদের দিয়ে। আজ্ঞে তখনো ডাক্তার কিনতে পাওয়া যেতো। সেই কমিশন ডাঃ মুখার্জিকে ডেকে যারপরনাই হেনস্তা করলেন এবং তাঁরা জানালেন, এসব ভাঁওতা!! সুভাষ বাবুকে বদলি করা হলো সুদূর বাঁকুড়ার চক্ষু বিভাগে, যাতে কোনো ভাবেই এই গবেষণা না এগোয়। তাঁর জাপানে বক্তৃতা রাখার আমন্ত্রণে যাওয়ার অনুমতি মিলল না। অবশেষে বন্ধ ঘরে নিজেকে শেষ করলেন বাংলার শ্রেষ্ঠ চিকিৎসক – গবেষক, বলে গেলেন “হার্ট অ্যাটাকে মরার অপেক্ষা করতে পারলাম না”
শ্যামাপদ গড়াই
ক্ষমতা পেয়েই বিভিন্ন জায়গায় চমক দিতে রাউন্ডে যাচ্ছেন মমতা ব্যানার্জি। চলে গেলেন বাঙ্গুর ইনস্টিটিউট অফ নিউরোসাইন্সেও। সঙ্গী কিছু পোষা মিডিয়া। ডাঃ গড়াই বললেন, এত লোক নিয়ে এখানে এলে রোগীদের অসুবিধা হচ্ছে। গোঁসা হলো মুখ্যমন্ত্রীর। পরদিন তলব করলেন ওনাকে। ডাক্তারবাবু সাফ জানালেন তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ওটি আছে, ছেড়ে যাওয়া সম্ভব নয়। অতঃপর সাসপেনশন!! বছরের পর বছর কেটে যায়, মানুষটা অবসরপ্রাপ্ত হয়ে গেলো। অবশেষে কোর্টে গালে গালে থাপ্পড় খেয়ে সসম্মানে বকেয়া টাকাপয়সা ফেরত দিয়ে সাসপেনশন তুলতে হলো সরকারকে। মাঝখান থেকে ডাঃ গড়াইয়ের চিকিৎসা থেকে ব্রাত্য হলো সাধারণ মানুষ।
অরুণাচল দত্ত চৌধুরী
করোনাকালে যেমন বঙ্গদেশে কেউ করোনায় মরেনি, সব অন্যান্য রোগে মরতো, তেমনি ২০১৭ সালে ডেঙ্গুতেও কেউ মরতো না। মানুষ মরতো অজানা জ্বরে। ডেঙ্গুতে মানুষ মরলে প্রশ্ন উঠবে মশা দমনে সরকার কী ভূমিকা নিয়েছে! ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু শংসাপত্রে মৃত্যুর কারণ ডেঙ্গু লেখা যাবেনা কেন, এই নিয়ে সমাজমাধ্যমে প্রতিবাদ করেছিলেন বারাসাত হাসপাতালের ডাক্তারবাবু অরুণাচল দত্ত চৌধুরী।
অতএব যা হওয়ার তাই হলো – সাসপেনশন। তিন বছর পেরিয়ে অবসরের মাস তিনেক আগে উঠলো সেই সাসপেনশন। তৎক্ষণাৎ বদলি কালিম্পং। ভগ্ন শরীরে বাড়িতে অসুস্থ বাবা – মাকে ফেলে সুদূর কালিম্পং যাত্রা করেন স্যার। এই হলো মা মাটি এবং মানুষের সরকার।
এন্থনি ফসি
চিকিৎসকদের মধ্যে জীবন্ত কিংবদন্তী যদি কেউ থাকেন, ফসি তাঁদের একজন। এইডস হোক বা করোনা – যেকোনো সংক্রামক জনস্বাস্থ্য সমস্যায় আমেরিকাকে আগলে রেখেছিলেন ফসি। ট্রাম্পের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কও খারাপ ছিল না। কিন্তু যখন বোঝা গেলো করোনা এত সহজে যাওয়ার নয় এবং ভোটের প্রচার শুরু না করলেই নয়, তখন ফসি হয়ে উঠলেন পথের কাঁটা। সে মানুষকে বলে দেয় হাইড্রক্সি ক্লোরোকুইন করোনার বিশল্যকরণী নয়। সে বলে দেয় ভ্যাক্সিন করোনা মোকাবিলায় শেষ কথা নয়। ভ্যাকসিনের শেয়ার নেমে যায়। ভোটের প্রচারে অসুবিধা হয় মানুষের মধ্যে করোনার ভয়ে।
অতএব ফসিকে ভিলেন সাজানো শুরু। জনসমক্ষে লোকে তাঁকে শোনায় করোনার এই মৃত্যুমিছিলের জন্য উনিই দায়ী। এমনকি ফিজিকাল অ্যাটাকও হয়। তাও নিজের কাজে অবিচল থাকেন ফসি। ক্ষমতায় পুনরায় ফিরে আসার পর ট্রাম্প ওনার সরকারি নিরাপত্তাও তুলে নেন।
লিখতে থাকলে লেখা শেষ হবেনা। গদির সঙ্গে শিক্ষার লড়াই চিরন্তন। বিজ্ঞান ও রাজনীতি পাশাপাশি চলে, এরা কোনোদিন একে অপরকে ছেদ করেনা। কিন্তু লক্ষ্য করবেন, নামগুলো কিন্তু এত চেষ্টার পরও মুছে যায়না। হয়তো তাঁদের জীবনযাত্রা বিধ্বস্ত হয়, হয়তো বিজ্ঞানের চলা একটু থমকে যায় – কিন্তু বিজ্ঞানের চাকা চলছে, চলবে অবিচল।।