এর আগে যেই জটিলতাগুলি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে, সেগুলি ডায়াবেটিসের দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা। ডায়াবেটিস মূলত নিঃশব্দ ঘাতক। ধীরে ধীরে দেহের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গের ক্ষতি করে। কিন্তু কখনো কখনো ডায়াবেটিস নিজেই হঠাৎ করে রোগীর জীবন সংশয় করতে পারে। এধরণের দুটি জটিলতা হল, ডায়াবেটিক কিটো এসিডোসিস (DKA) এবং হাইপার গ্লাইসেমিক হাইপার অসমোলার স্টেট (HHS)।
এই দুটি রোগের মূল কারণ ইনসুলিনের অভাব এবং রক্তের গ্লুকোজের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি। আমরা যদি দুটি রোগের মধ্যে তুলনামূলক আলোচনা করি, এবং তাদের পার্থক্য গুলি বোঝার চেষ্টা করি, তাহলেই দুটি রোগকে কিছুটা বোঝা যাবে।
১. কাদের হয়?
কিটো এসিডোসিস হয় টাইপ১ ডায়াবেটিসে এবং হাইপারগ্লাইসেমিক হাইপারঅসমোলার স্টেট হয় টাইপ২ ডায়াবেটিসে।
অর্থাৎ এটাও বলা যায় DKA হয় মূলত কম বয়সে আর HHC হয় অপেক্ষাকৃত বেশি বয়েসে।
২. কারণ?
আগেই বলা হয়েছে দুটি রোগেরই মূল কারণ ইনসুলিনের অভাব এবং রক্তের গ্লুকোজের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি।
কিন্তু ডায়াবেটিক কিটো এসিডোসিসে ইনসুলিনের অভাব অনেক বেশি হয়। এক্ষেত্রে শরীরে ইনসুলিন প্রায় তৈরিই হয় না। অন্যদিকে ইনসুলিনের বিপরীত কাজ করে যে হরমোনগুলি, যেমন গ্লুকাগন, ক্যাটেকোলামাইন, কর্টিসল এবং গ্রোথ হরমোন এগুলি রক্তে বেশি পরিমাণে থাকে। এগুলি রক্তে কিটোন বডি তৈরি করে এবং এসিডোসিস করে।
অন্যদিকে হাইপারগ্লাইসেমিক হাইপার অসমোলার স্টেটে রক্তের গ্লুকোজ বাড়তে থাকে এবং গ্লুকোজ মূত্রের মাধ্যমে বেরোতে থাকে। গ্লুকোজ মূত্রের মধ্যমে বেরোনোর ফলে প্রস্রাবও বেশি হয়। ফলে শরীরে আরও জলের অভাব বা ডিহাইড্রেশন হয়। জলের অভাব ঘটায় রক্তের ঘনত্ব বা অসমোলারিটি বৃদ্ধি পায়। রোগীর ধীরে ধীরে মানসিক বিভ্রান্তি এবং শেষে কোমা হয়।
৩. সময়ঃ
DKA তাড়াতাড়ি হয়। অনেক সময় কম বয়সী ডায়াবেটিস রোগী পেটে ব্যথা নিয়ে উপস্থিত হয়। এমনো হতে পারে তার ডায়াবেটিস তখনও ধরাই পড়েনি।
যার ফলে চিকিৎসক অনেক সময় ভুল করে প্যাংক্রিয়াটাইটিস বা অন্য কোনো কারণে পেটে ব্যথা বলে ভাবেন। এমারজেন্সি থেকে অনেক DKA রোগী ভুল করে সার্জারি ওয়ার্ডে ভর্তি হয়ে যায়।
অন্যদিকে HHS রোগী সাধারণত বয়স্ক হন। তাঁদের কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রস্রাব বেশি হয়, ওজন কমে যায় এবং খাবার ইচ্ছা কমে যায়। আস্তে আস্তে মানসিক বিভ্রান্তি শুরু হয় এবং শেষ পর্যন্ত রোগী কোমায় চলে যেতে পারেন।
৪. দুটির মধ্যে পার্থক্যঃ
দুই ধরনের রোগীর রক্তেই গ্লুকোজ অত্যন্ত বেশি হয়। DKA এর ক্ষেত্রে ২৫০- ৬০০ মিগ্রা/ডেসিলি. আর HHS এর ক্ষেত্রে ৬০০- ১২০০ মিগ্রা/ডেসিলি।
কিন্তু মূল পার্থক্য করা হয় রক্তে এবং মূত্রে কিটোন বডির উপস্থিতি দেখে। DKA রোগীর ক্ষেত্রে রক্তে ও মূত্রে কিটোন বডি পাওয়া যায়। মূত্রে কিটোন বডি নির্ণয়ের জন্য স্টিক পাওয়া যায় যা দিয়ে রোগীর বিছানার পাশে দাঁড়িয়েই বোঝা সম্ভব মূত্রে কিটোন বডি আছে কিনা।
৫. চিকিৎসাঃ
দুটি রোগের চিকিৎসার জন্যই হাসপাতালে ভর্তি হওয়া প্রয়োজন।
চিকিৎসার মূল লক্ষ্য স্যালাইনের দ্বারা ডিহাইড্রেশন ঠিক করা এবং ইনসুলিনের সাহায্যে রক্তের গ্লুকোজ স্বাভাবিক করা।
চিকিৎসা পদ্ধতি বেশ জটিল এবং তা এখানে বিস্তারিত আলোচনা করা নিস্প্রয়োজন।
দ্রুত চিকিৎসা শুরু না হলে দুটি জটিলতাই মৃত্যুর কারণ হতে পারে। HHS এর মৃত্যুর হার DKA থেকে অনেকটাই বেশি।
এই দুটি রোগকেই প্রতিরোধ করার জন্য রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা ঠিক রাখা খুবই প্রয়োজনীয়। টাইপ ১ ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে কখনোই হঠাৎ করে ইনসুলিন বন্ধ করা উচিৎ নয়। বয়স্ক ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা ঠিক রাখার পাশাপাশি তার পর্যাপ্ত খাদ্য ও পানীয়ের দিকে নজর রাখা উচিৎ। রোগীর খাদ্য গ্রহণ কমে গেলে, রোগী ঝিমিয়ে গেলে অথবা মানসিক বিভ্রান্তি দেখা গেলে সাথে সাথে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিৎ।