লকডাউনে স্বাস্থ্য পরিষেবা কিভাবে ভেঙে পড়েছে মেডিকেল ক্যাম্পগুলি করতে করতে বুঝতে পারছি। গত তিন মাসে একেবারে মরো মরো অবস্থা না হলে কেউই হাসপাতাল-মুখো হননি। যাঁরা সরকারি হাসপাতাল থেকে সুগার প্রেসারের ওষুধ খাচ্ছিলেন, সব বন্ধ।
দলে দলে মানুষ ক্যাম্পে আসছেন। সারা দেশে টেলি মেডিসিন আইন সিদ্ধ হয়েছে। চিকিৎসক অনলাইনে পরামর্শ দিচ্ছেন। কিন্তু এক্রামন বিবি, শিউলি সর্দারদের জীবনে টেলি মেডিসিনের কোনো ভূমিকা নেই।
লকলকে লাউ ডগা ঢাকা খড়ের চালের নীচে রোগী দেখতে দেখতে প্রশ্ন করি, ‘ওষুধ খাওনা কেন?’
‘কি ভাবে হাসপাতালে যাব? গাড়ি নাই। টেরেন নাই। ঘরের লোকের কাজ নাই। আপনিই ওষুধ দেন, যা হয় কিছু দেন।’
আমি ওষুধের বাক্স হাঁটকাই। আমার সম্বল বারো রকমের ওষুধ। প্রেশার যাই থাক, এমলোডিপিন দিই। সুগারের মাত্রা না জেনেই মেটফরমিন। বারবার তাদের বোঝাই, ‘হাসপাতালে যাও৷ নিয়মিত ওষুধ খাও। সুগার পরীক্ষা করো। এই মহামারীর সময়ে সুগার, প্রেশার ঠিক রাখা অত্যন্ত জরুরী।’
রোগিণী ভরসা দেন, ‘ঠিক যাব ডাক্তারবাবু। গফুরের বাপের কারখানাটা খুলুক।’
শ্বাসকষ্টের রোগীর লুঙ্গির ভাঁজ থেকে বিড়ি বার করি। জাঁদরেল ধমক দিই। কিন্তু ইনহেলার দিতে পারিনা। প্রেশক্রিপশনের শুরুতে বড়ো বড়ো করে লিখি ‘ধূমপান বন্ধ করুন।’ শেষ করি একটি ইনহেলারের নাম লিখে।
লোকটি এক হাতে এস্থালিন আর সেপ্ট্রান ট্যাবলেট নেন। অন্য হাতে প্রেসক্রিপশন। প্রেসক্রিপশন হাতের মধ্যে দলা পাকিয়ে যায়। বাইরে বেড়িয়েই হয়তো ফেলে দেবেন।
অপুষ্টিতে ভোগা মেয়েটিকে আয়রন ট্যাবলেট দিই। চৌদ্দ বছরে পঁচিশ কেজি পেরোয়নি। এখনো মাসিক শুরু হয়নি। ক্যাম্পের ফার্মাসিস্ট হয়ে ওঠা ডিউক আয়রন ট্যাবলেট কাগজে মোড়াতে মোড়াতে বলে, ‘পায়খানা কালো হবে কিন্তু।’
মেয়েটি শূন্য চোখে শোনে। অন্য হাত বাড়িয়ে কৃমির ট্যাবলেট নেয়।
‘বাড়িতে ক’জন বাচ্চা ছেলে মেয়ে আছে?’
মেয়েটি আঙুলের কর গোণে। ডিউক আরও এলবেন্ডাজল ট্যাবলেট খোঁজে। খুঁজে পায়না। হয়তো শেষ হয়ে গেছে। ছোটোবেলার বন্ধুরা একসাথে খোঁজে। বাবাই, প্রণবদা, সঞ্জীবদা, সুমনদা….। সকলেই মাঠে আছে। এই খেলায় জয় পরাজয় নেই। আরও চারটি এলবেন্ডাজল ট্যাবলেট পাওয়া যায়।
হয়তো আমরা কিছুই করতে পারিনা। হয়তো ক্যাম্পের মাঝপথেই ওষুধের অল্প ভাণ্ডার শেষ হয়ে যায়। তবু আমরা পরের ক্যাম্পের প্রস্তুতি নিই।
অন্তত হাতগুলো তো ছুঁতে পারব। আমার লেখা প্রেসক্রিপশন সুদৃশ্য ফাইলে ভেলোরের প্রেসক্রিপশনের সাথে স্থান পাবে না। বরঞ্চ প্রেসক্রিপশন উড়ে বেড়াবে ধূ ধূ ধানক্ষেতে। পুকুরের জলে ভেসে যাবে।
ঐন্দ্রিল যদিও লেখাটা আগে পড়েছি । তবু আবার পড়লাম । আমার দুর্ভাগ্য আমি এই দেশে জন্মেছি । আমার পরম সৌভাগ্য আমি এই দেশের মানুষদের সুখ দুঃখ হাসি কান্নার অংশীদার হতে পেরেছি । যখন গরীব মেয়েটি তার বাগানের পেয়ারা বা বাড়িতে করা কচুর লতি দিয়ে যায় তখন আমি বুঝি আমি বড্ড বড়লোক । বিয়ে না করা মাসিকে যখন মা মরা বোনপো নিয়ে আসে । আমি করোনা ভুলে হাত মেলাই ‘চিয়ার আপ মেয়ে’ সেরে গেলে ডিমভাজা খেতে তোমার বাড়ি যাবো । তখন এক পৃথিবী ভালবাসায় আমি ভেসে যাই । মাসি আঁচলে চোখ মুছে এই ভাগ্যবান সরকারি হাসপাতালে চলে যায় ।
প্রণাম আপনাকে
ঐন্দ্রিল যদিও লেখাটা আগে পড়েছি । তবু আবার পড়লাম । আমার দুর্ভাগ্য আমি এই দেশে জন্মেছি । আমার পরম সৌভাগ্য আমি এই দেশের মানুষদের সুখ দুঃখ হাসি কান্নার অংশীদার হতে পেরেছি । যখন গরীব মেয়েটি তার বাগানের পেয়ারা বা বাড়িতে করা কচুর লতি দিয়ে যায় তখন আমি বুঝি আমি বড্ড বড়লোক । বিয়ে না করা ক্যানসার আক্রান্ত মাসিকে যখন মা মরা বোনপো নিয়ে আসে । আমি করোনা ভুলে হাত মেলাই “‘চিয়ার আপ মেয়ে’ সেরে গেলে ডিমভাজা খেতে তোমার বাড়ি যাবো” । তখন এক পৃথিবী ভালবাসায় আমি ভেসে যাই । মাসি আঁচলে চোখ মুছে সরকারি হাসপাতালে চলে যায় ।
স্যালুট, জানাই আপনাকে। আপনার সব লেখাই পড়ি।কথাগুলো প্রতিনিয়ত কানে বাজে।নমস্য নবারুন ভট্টচার্য” এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ হতে পারে না।”