এক পাঠক বন্ধু ডা: বিধান চন্দ্র রায়কে নিয়ে লিখতে অনুরোধ করেছেন। তাই এই লেখা। এই লেখা রাজনীতিবিদ বিধানচন্দ্রকে নিয়ে নয়, এই লেখা প্রশাসক বিধানচন্দ্রকে নিয়ে নয় এমন কি প্রবাদ প্রতিম ক্লিনিশিয়ান বিধানচন্দ্রকে নিয়ে নয়। এই লেখা জনস্বাস্থ্যের একজন কর্মী হিসেবে স্বল্প আলোচিত বিধানচন্দ্রকে নিয়ে আরেক জনস্বাস্থ্য কর্মীর ট্রিবিউট।
১৯৪২ সালে ডা: রায় তাঁর ৩৬ নং ওয়েলিংটন স্ট্রিটের বাড়ি থেকে ‘কংগ্রেস মেডিক্যাল মিশন’ গঠনের ঘোষণা করেন। এই মেডিক্যাল মিশনে সর্বমোট ৬৫ জন কর্মী সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। এই দলে ছিলেন ছয়জন ডাক্তার, দুইজন স্যানিটারি ইন্সপেক্টর, চারজন মেল নার্স এবং ৪৩ জন স্বেচ্ছাসেবী। ডাক্তারদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য – ডা: চোলকার (মিশন ডিরেক্টর), ক্যাপটেন এস কে রায় (মিশন সেক্রেটারি), ডা: এ ডি নারদে, ডা: ধীরেন্দ্রনাথ বসু, ডা: জীবানন্দ ভট্টাচার্য্য ও ডা: রায় স্বয়ং (সূত্র: বি সি রায় পেপারস ফাইল নং ৯৯)
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ডা: রায় কংগ্রেসের ডাকে ৪২ এর ভারত ছাড় আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন নি, তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান বরঞ্চ এ বিষয়ে তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টির কাছাকাছি ছিল। মনিপুর বার্মা মালয়ে কংগ্রেস মেডিক্যাল মিশনের মাধ্যমে যুদ্ধে আহত ও অসুস্থ মানুষের দিকে মানবিক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়া ছিল তাঁর লক্ষ্য। এই মিশন তৈরির বিষয়ে তিনি কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব তথা গান্ধীজির অনুমোদন ও জোগাড় করে ফেলেন।
১৯৪২ সালে তৈরি হওয়া এই মিশন ১৯৪৬ সালের ১৫ই আগস্ট অবধি কাজ করে কলকাতায় ফেরে। মিশনের সেবা কাজে যে বিশাল অর্থ ও ওষুধ এবং অন্যান্য সরঞ্জামের প্রয়োজন ছিল সেগুলি বিভিন্ন ব্যাক্তি ও প্রতিষ্ঠানের মুক্ত হস্তে দানে পূরণ হয়েছিল। ডা: রায় নিজের বিপুল অনুদানের পাশাপাশি এই তহবিল সংগ্রহে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন। তাঁকে ১৯৪৬ এর ৮ই এপ্রিল লেখা সর্দার প্যাটেলের চিঠি থেকে জানা যাচ্ছে যে ব্রিজমোহনজি তাঁর অনুরোধে ৪০ হাজার টাকা মেডিক্যাল মিশনকে অনুদান দিচ্ছে। এছাড়াও বেঙ্গল ইমিউনিটি, বেঙ্গল কেমিক্যালস, সুর এনামেল ওয়ার্কস এর নাম উল্লেখযোগ্য। (সূত্র: বি সি রায় পেপারস ফাইল নং ১১৩)
ডা: রায় শুধু অর্থ নয়, লোকবল সংগ্রহে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেন। এই প্রসঙ্গে তাঁকে ১৯৪২ সালের ২৬শে জুন লেখা এস সুব্বারাও এর মর্মস্পর্শী চিঠিটি উল্লেখযোগ্য যেখানে একজন এম বি বি এস সন্তানের আইনজীবী পিতা হিসেবে তিনি ডা: রায়কে অনুরোধ করছেন তার ছেলেকে মিশনের কাজে নিতে। আসামের কংগ্রেস কমিটিও ডা: রায়ের ডাকে সাড়া দিয়ে বিপুল স্বেচ্ছাসেবক নিযুক্ত করে আহত, শরণার্থী, যুদ্ধ দুর্গত মানুষদের মেডিক্যাল সেবায়।
ঠিক এর পরপরই আসে তেতাল্লিশের মহামন্বন্তর। ভারত ছাড়ো আন্দোলনে অংশ না নিয়ে প্রায়শ দেশদ্রোহী অপবাদে কোনঠাসা কমিউনিস্ট পার্টি মানুষের পাশে দাঁড়ানোর ও অপবাদ ঘোচানোর সুযোগ পায়। “বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষক সভা, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির বাংলা কমিটি, অধ্যাপক চট্টোপাধ্যায়, কংগ্রেস নেতা যোগেশচন্দ্র গুপ্ত, লীগ নেতা লালমিয়া প্রভৃতির চেষ্টায় ‘পিপলস রিলিফ কমিটি’ গঠিত হয়; লক্ষ্য থাকে, রিলিফ ও পুনর্গঠনের কাজে ঐক্যবদ্ধ লড়াই চালানো (সূত্র: কৃষ্ণবিনোদ রায়: মন্বন্তরের পরিণতি ও পুনর্গঠনের পথে: বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষক সভা কর্তৃক প্রকাশিত)।
ঢাকা, মেদিনীপুর, ময়মনসিংহ, যশোর, চট্টগ্রাম, নদীয়া, মালদা, জলপাইগুড়ি ও আরো অসংখ্য জায়গায় পি আর সি এর মেডিক্যাল টিম কাজ চাকায়। এই সময়ে কুইনাইন একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কিন্তু দুষ্প্রাপ্য ওষুধ ছিল। এই ওষুধ সংগ্রহের জন্য পিআরসি সংগঠকরা ডা: রায়ের শরণাপন্ন হয়। ডা: রায়ের ডাকে সাড়া দেয় স্টাডকো স্টোর এন্ড ল্যাবরেটরি। তাঁকে লেখা ওই প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং ডিরেক্টর পি দাসের চিঠি থেকে একটা তালিকা পাওয়া যাচ্ছে: ইলেকট্রো লাইট ক্লোরিন ১ বাক্স, ক্ষত পোড়া রুগীদের জন্য ড্রেসিং ৩৬,০০০ ম্যালেরিয়ার ট্যাবলেট ১০০০ টি ইত্যাদি।”
এই ত্রাণ কাজ সূত্রে কমিউনিস্ট নেতৃত্ব তথা পিআরসি সংগঠকরা ডা: রায়ের কাছাকাছি আসেন। রাজনৈতিক মতভেদ স্বত্বেও দু পক্ষই অনুভব করেন যে ত্রাণ কাজে একটি সমন্বয়কারী কমিটির প্রয়োজন। জ্যোতি বসুর ভাষায়, “দুর্ভিক্ষের ত্রাণে একটি রিলিফ কমিটি তৈরি হয় – বেঙ্গল মেডিক্যাল রিলিফ কো অরডিনেশন কমিটি। এই সংগঠনের চেয়ারম্যান ছিলেন ডা: রায়। আমার সঙ্গে অবশ্য তখন ডা: রায়ের কোনো পরিচয় ছিল না, আমরা তখন ছোট্ট পার্টি। আমরা ত্রাণের জন্য খুব কাজন্তঞ্জ না করেছিলাম। পিপলস ওয়ারের ডাকের ফলে ভারত ছাড়ো আন্দোলনে যোগ না দেয়ায় আমরা রাজনীতির দিক থেকে তখন বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছি। কিন্তু তারই মধ্যে আমাদের পার্টি বেড়েছে, দুর্ভিক্ষের সময় আমরা মানুষের মধ্যে ত্রাণের কাজ করি। তখন আগেই ছোট একটা সংগঠন ত্রাণের জন্য ছিলো। সেই সংগঠন ও অন্যান্য কিছু সংগঠন মিলে ডা: রায়ের নেতৃত্বে বিএমআরসিসি গঠিত হয়। সেই সময় ভালো সামাজিক কাজ হয়েছিল।”
গণ আন্দোলনে গুলি চালানো বিতর্কিত প্রশাসক অথবা মহম্মদ ইসমাইলকে ভোটে পরাজিত করতে গণনাকেন্দ্রে আলো নিভিয়ে দেয়া বিতর্কিত রাজনীতিবিদ অথবা গান্ধীজিকে ওষুধ গ্রহণে বাধ্য করা ক্লিনিশিয়ান – এসব কোনো পরিচয় একজন ব্যক্তিত্বের গোটা পরিচয় হতে পারে না, ইতিহাসের বস্তুবাদী বিশ্লেষণে বিশ্বাসী একজন বামপন্থী হিসেবে মনে করি শুধু নেতিবাচক নয়, ইতিবাচক ভূমিকাও তুলে ধরা প্রয়োজন আছে। কমিউনিস্ট পার্টির সেই সময়কার নেতৃত্ব ডা: রায়ের সদর্থক ভূমিকা পালনের জন্য, দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর তাঁর এই মহতী প্রচেষ্টার জন্য সবিশেষ কৃতজ্ঞ ছিলেন – এটাও ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে।