আমাদের ইস্কুলের দীপঙ্কর বলে একজন কবি ছিলো। সে লিখেছিলো:-
আদিগন্ত নেশাতুর-
রূপ যৌবন
আঁকড়ে আঁকড়ে
বয়স চলে যায়।
আমি নেশায় অতৃপ্ত
ঠোঁট পেতে থাকি
তোমার চোখের গভীরে-
নতুবা অতৃপ্ত।।
নেশা হলো না-,
নেশার কাছে ঘুরে ঘুরে…
নেশা হলো না।।”
এ এক অদ্ভুত লেখা- যেন গঙ্গাজলে গঙ্গা পুজো। একটা একটা করে নেশা আর রকমসকম নিয়ে লেখা হবে। কোনও নেশাই বাদ যাবে না, সব দেবতারই পুজো দেওয়া হবে। বলা যায় এক আদ্যন্ত নেশাগ্রস্তের আঙ্গুলে নেশাবৃত্তান্ত।
একটা অদৃশ্য নেশা আমাদের সময় আর সমাজকে গ্রাস করে ফেলছে। আমরা কেউই জানি না যে আমরা সবাই আস্তে আস্তে ঐ নেশায় ডুবে যাচ্ছি। সমস্ত পৃথিবী থেকে আলাদা হয়ে একটা গভীর একাকীত্বে, একটা গভীর ভালো না লাগার অথৈ পাথারে হাবুডুবু খাচ্ছি।
দুঃখের কথা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, মানসিক রোগের চিহ্নিতকরণ সংস্থা কেউই এই নেশাটাকে যথোপযুক্ত মর্যাদা দেয় নি। একমাত্র দক্ষিণ কোরিয়া, তাদের দেশে ইন্টারনেটকে নেশা বলে চিহ্নিত করেছে। এক্ষেত্রে আলাদা জাতীয় স্তরে চিকিৎসা ব্যবস্থাও নির্ধারিত। হ্যাঁ। এখানে ইন্টারনেটের নেশা, পর্নোগ্রাফি দেখার নেশা, সেক্সটিং বা সারাদিন একটা কোনও কিছু নিয়ে পড়ে থাকাকে- যেটা পারিবারিক অথবা ব্যক্তিজীবনকে ধ্বংস করে’ একজন মানুষকে অসামাজিক বানিয়ে দেয়, সেটা নিয়ে বলা হচ্ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ইন্টারনেটকে নেশা হিসেবে ঘোষণা করতে পারে নি। কেন?
অথচ আমরা দুবেলাই টিভিতে, খবরের কাগজে দেখছি- মোবাইল না দেওয়ায় বা মোবাইল দেখতে না দেওয়ায় আত্মহত্যা, মোবাইল অ্যাপে ভিডিও তুলতে গিয়ে ট্রেনে কাটা পড়েছে… তাহলে এটা কি কেবল ঐ ছেলেমেয়েগুলোর ব্যক্তিগত গন্ডগোল? তাও তো নয়… আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে, নিজের বাড়িতে সব জায়গায় ছোটদের (বড়দেরও) ইন্টারনেটে আকর্ষণ দেখতে পাচ্ছি। আমরা নিজেরাই আমাদের বাচ্চাদের সময় দিতে না পেরে হাতে মোবাইল তুলে দিচ্ছি অথচ আমরাই আবার ওদের ইন্টারনেটের নেশা ছাড়াতে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হচ্ছি। আসলে ইন্টারনেট এখন প্রায় সমস্ত কাজের একটা অপরিহার্য অংশে পরিণত হয়েছে।
বই পড়া বা গান শোনাও এখন ইন্টারনেট ছাড়া প্রায় অসম্ভব। অনেকেই কাজ করতে করতে গান শোনেন- এটাকেও কি নেশা বলা হবে? হতবাক বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তাই সংজ্ঞা খুঁজে বেড়াচ্ছে। কতোটা কাজ আর কতোটা নেশা, কাজের বাইরে কতক্ষণ ইন্টারনেট করা উচিত- এই সব নিয়েই এখনও আলোচনা চলছে।
এবারে আমরা ইন্টারনেট নেশার দুটো নির্দিষ্ট ভাগ নিয়ে আলোচনা করবো।
১) প্রথমতঃ গেমিং
গেমিং আবার দুই ধরণের হয়।
ক) পরবর্তী স্তর বা লেভেলে ওঠার নেশা। এটা মূলতঃ টীন এজারদের হয়।
খ) জুয়া ধরণের নেশা। এতে সাধারণতঃ টাকা জেতার সম্ভাবনা কম। এটা একটু বয়স্কদের হয়। এতে পরিবারের আর্থিক পরিস্থিতি সঙ্গীন হয়ে পড়ে।
২) ইন্টারনেটে যৌনতা
এটাও দু ধরণের হয়।
ক) সেক্সটিং বা সেক্স চ্যাটিং।
খ) পর্ণোগ্রাফি দেখা।
এছাড়াও ফেসবুকে নিজের পোস্টে কটা লাইক পড়লো এটা দেখাও একটা নেশা।
এটা কেন হয়? এতে নেশাটা কোথায় হয়? কিভাবেই বা এটাকে নেশা গোত্রভুক্ত করা হবে?
আমরা এখন অগণন আধুনিক যন্ত্রপাতি পরিবৃত হয়ে বসে আছি। এবং আশ্চর্য হয়ে যাবেন এই সবগুলোই ইন্টারনেটের মাধ্যমে চলে। প্রতিদিনের কাজকম্ম, লেখাপড়া সবই এখন ইন্টারনেটের ওপর নির্ভরশীল। ধরুন আপনি পিৎজা খেতে ভালবাসেন। ধরুন আপনার কাছে ইন্টারনেট আছে। আপনি আপনার ব্যাঙ্কে জমা টাকা থেকে পিৎজা দিয়ে যেতে বললেন। বা মটন দোপেঁয়াজা। হয়তো আপনার না খেলেও হতো। কিম্বা যে জামাটা পঁচিশটা দোকান ঘুরে- শ’খানেক মানুষের সঙ্গে কথা বলেও শেষে কিনতেন না, কেননা কাপড়টা ততটা ভালো নয়। অথচ ইন্টারনেট আছে বলে কিনেই ফেললেন। এভাবে ইন্টারনেট আমাদের ক্রমশঃ আরও নির্ভরশীল এবং অকারণ ব্যয়বৃদ্ধি করে দেয়।
যখন আপনার চারপাশে চাপ বাড়তে থাকে, যখন কাজের অতৃপ্তি, পরীক্ষার ফলাফল আশানুরূপ না হয়, ব্যক্তিগত সম্পর্কগুলো একটু খারাপ হয়ে যায়- তখন মানুষ তার নিজের গন্ডি খুঁজে নেয়- লক্ষণরেখা টানা শুরু করে। এই সময়ে ইন্টারনেট এসে মানুষটার একটা আশ্রয় হয়ে দাঁড়ায়। মানবিক সম্পর্কগুলো ছেড়ে মানুষ ক্রমাগত অন্তর্জালে জড়িয়ে পড়ে।
এই সময়ে মানুষ ক্রমশঃ নিরানন্দ, বাইরের জগত সম্বন্ধে নিরাসক্ত আর মানবিক সম্পর্ক বিহীন হয়ে ওঠে। এগুলো সবই কিন্তু ডিপ্রেশন বা হতাশার লক্ষণ। হতাশা এলেই ইন্টারনেট আবার ইন্টারনেট যতই তার জীবনের দখল নিয়ে নেয় ততই সে হতাশ হতে থাকে। এবং আরও বেশী ইন্টারনেট করতে থাকে।
ইন্টারনেট করলে, বা ধরুন ফেসবুক করলে একটা লাইক আপনার আত্মগর্ব বাড়িয়ে তোলে। ঘিলুতে ডোপামিন বলে একটা রাসায়নিক বেরিয়ে আসে, এটাই আমাদের আনন্দিত করে। কিন্তু পরের ছবিতে যদি তার থেকে বেশী লাইক না আসে তাহলে আপনি সন্তুষ্ট হবেন না। আবার পোস্ট করবেন। মোটামুটি ঘটনাটি এই রকম। অনেকটা এলএসডি বা রাসায়নিক নেশার মতো (অবশ্যই একটা শারীরবৃত্তীয় ফারাক আছে; সেটা পরবর্তী পর্বের জন্য তোলা থাক)।
এলিজাবেথ হার্টনির তথ্য অনুযায়ী মদ বা ড্রাগ উইথড্রয়ালের সব লক্ষণই একজন ইন্টারনেট নেশায় মজে থাকা লোকের ইন্টারনেট ব্যবহার বন্ধ করে দিলে দেখতে পাওয়া যায়। যথা রাগ, হতাশা, আত্মহত্যার চেষ্টা, সবই দেখা যায়। [Results: The individuals with internet addiction had significantly higher rates of suicidal ideation (odds ratio [OR] = 2.952), planning (OR = 3.172), and attempts (OR = 2.811) and higher severity of suicidal ideation (Hedges g = 0.723).] এই জটিল সংখ্যাতত্ত্বমূলক বাক্যবন্ধে দেখা যাচ্ছে ইন্টারনেট নেশাগ্রস্তদের মধ্যে আত্মহত্যার হার স্বাভাবিক জনগণের থেকে বেশী।
আমেরিকার একশো পঞ্চান্ন মিলিয়ন মানুষ ইন্টারনেট গেমিংএ অভ্যস্ত। এরপর কিছু নির্দিষ্ট পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে অতিরিক্ত ইন্টারনেটের নেশা আমাদের মস্তিষ্কের প্রিফ্রন্টাল অংশের কিছু গঠনগত পরিবর্তন করে। যেহেতু এখান থেকে আপনার কাছে কোন কাজটা গুরুত্বপূর্ণ,ভবিষ্যতের পরিকল্পনা করা এবং মনোযোগ দেওয়ার মতো কাজগুলো নিয়ন্ত্রণ করে তাই ইন্টারনেটের নেশা এই সব এই কাজগুলোর ক্ষতি করে।
হয়তো আমাদের কাছে বিজ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গে এক ভয়ানক বিপর্যয় ঘনিয়ে আসছে। কাজের বাইরে একজন মানুষ কতোক্ষণ ইন্টারনেট ব্যবহার করবে, সেটা হয়তো ভবিষ্যতে স্বাস্থ্য সংস্থারাই ঠিক করে দেবে।
ইতি অন্তর্জালবিষয়ক প্রবন্ধম খতম।