আমি এক শ্রমিকের কথা বলব| এক অটোচালকের সৎ থাকার শেষ চেষ্টার কথা বলব| এবার অটোচালককে ঠিক কী জাতীয় শ্রমিক হিসেবে ক্লাসিফাইড করা যায় — তাঁকে পরিযায়ী উড়ন্ত না বঙ্গভঙ্গের স্বদেশি শ্রমিক বলবেন কিনা সেটা আপনারা ঠিক করে নেবেন| আপনারা মানে প্রশাসক ,পারিষদ ,এবং সভাসদ| সভাসদটা একটু স্যানিটাইজার নিয়ে স্লাইট করে পরিষ্কার করে দি| এঁরা হলেন ড্রাম পেটানোর মত ঘন ঘন দল বদল করা “এলিট ইন্টেলেকচুয়াল ক্লাস “| ড্রামে দুবার কাঠি পেটানোর মধ্যে যেটুকু গ্যাপ থাকে তার মধ্যেই নিজের এরা যে যার ধান্দা বুঝে বক্তব্য রাখে জানা অজানা যেকোনো বিষয়ে| হতভাগাদের আমি বলি “ইমলি ঝিমলি ক্লাস”| দুটোই সমান আছে এদের –ভদ্রলোক বলে নিজেকে অহরহ স্বতন্ত্র ভাবা, শ্রমিককে মাঝে মধ্যে বঙবেলুন ছোঁড়ার মত দরদ ছুঁড়ে মারা এবং তার সঙ্গে প্রচুর বুদ্ধি| তো এই তিন জাত –প্রশাসক ,পরিষদ এবং The Most Dangerous সভাসদ নিজেদের ঘোড়ার ডিমের অবস্থান ভুলে মেরে দিলেও শ্রমিকের ক্লাসিফিকেশন করতে সিদ্ধহস্ত হয়ে যাচ্ছেন দিন কে দিন| এমনকি শ্রমিক কী খাবে, কতটা খাবে কোথায় ঘুমোবে , কতটা ঘুমোবে, কোথায় অনর্গল হিসু পটি করতে করতে মরেও যাবে –সব –সব ঠিক করবে এই বজ্জাতরা| ঠিক করার সময় মুখেচোখে নিউট্রাল ব্যঞ্জনাও রেখে দেবে ছিটেখানিক|
গপ্পে আসি|
কাল ফিরছি সল্টলেক থেকে নাগেরবাজার| এক অটোওয়ালা এলেন| বললাম –সোজা নাগেরবাজার রিজার্ভ করে যাব| আমার সঙ্গে ছিলেন অতনু| ওর ক্লান্তি দেখে অটোওয়ালার প্রথম প্রশ্ন —“শরীর খারাপ নাকি ? ঘাম জমেছে তো কপালে ! আসুন| আসুন|”
উঠে বললাম –“কত নেবেন? সেই ট্যাক্সির ডবল তো? বলুন কত নেবেন ঠিক?” মৃদু হাসলেন চালক –“আপনি বলুন| আমি শুনি| রোজ তো আমরাই বলি তাই না? আজ আপনি বলুন!” শান্ত স্নিগধ কথায় রাগ আরো বাড়ল বা ইচ্ছে করে রাগ বাড়ালাম| ওই যে বললাম –ইমলি ঝিমলিদের বুদ্ধি খুব| —“দেখুন নাগেরবাজার যেতে এখান থেকে ঠিক দেড়শ টাকা ভাড়া| তার থেকে বড়জোর —-” বাক্য শেষ হল না আমার| তিনি বললেন –“হ্যাঁ আপনি সঠিক| দেড়শই ভাড়া|” দ্বিতীয়বার থমকালাম।
সারাটা পথ নাক কুঁচকে বসে আছি ওঁর নোংরা জামার দিকে তাকিয়ে| দেখলাম গাড়ির গ্লাস দিয়ে আমায় দেখছেন আর হাসছেন| পথে এক বন্ধু উঠল অটোচালকের| মাস্ক দুলছে হৃদপিণ্ডের কাছে | মুখে ধোঁয়া| মৃদু গলায় বন্ধুকে বললেন –“পরের স্টপে নেমে যা সিগারেট বন্ধ যদি না করিস|” কান পেতে শুনলাম শ্রমিকের স্বাস্থ্যকথা| আমাদের মত সরবে নয়| নরম বোধে উজ্জ্বল শ্রমিকের বার্তা|
নাগেরবাজার মোড়ে এসে অতনু বললেন –“আমার তো পেসমেকার আছে| যদি বাড়ির সামনে –এই পাঁচটা বাড়ি পরেই আমাদের বাড়ি”
—“দূরে হলেও আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে যাব।” বাড়ির সামনে দাঁড়ালো অটো| ইমলি মানে নিজেকে স্বতন্ত্র করে ফেলব এই ইচ্ছেটা ততক্ষণে অনেক বড় হয়ে গেছে আমার| ইচ্ছে করেই ফোলালাম তাঁর জন্য নিজের দুঃখভাবকে| —“আপনাকে ফাঁকা ফিরতে হবে তো! ডবল নিন| দিচ্ছি।”
—-“আমাকে ডবল দিতে হবে না| আমি এদিকেই আসতাম| বাঙ্গুরের নির্দিষ্ট পাম্প থেকে পেট্রোল নি তো ! আর দিদি আমার জামাটা নোংরা নয়| কেচে কেচে পুরোনো ছাপ ধরে গেছে| কিন্তু পরিষ্কার| নোংরা জামা পড়ে কি আপনাদের তুলতে পারি ? কত অসুস্থ লোক উঠছেন আমার গাড়িতে ! তাদের ক্ষতি হবে তো!”
দেখলাম –সারাক্ষণ গাড়িতে আমার রুষ্ট থাকাটা ব্যাথা দিয়েছে ওঁকে| খুব ব্যাথা| স্বল্পভাষী মানুষটি আর নিজেকে থামাতে পারছিলেন না তাই| পরপর তরতর করে বলে চলেছিলেন —“দেশের এই দুর্দিনেও দেখুন মানুষ কেমন নিজে সবথেকে বেশি উপার্জন করব ভেবে চলেছে| এখনো এই ভাবছে এরা? দিদি? চারগুণ পাঁচগুণ ভাড়া চায় আমার বন্ধুরা| এত বারণ করি! শোনে না| দিদি শোনে না| বোঝে না একটা ট্যাক্সিওয়ালা অন্যায্য টাকা নিলে বাকিগুলোও মানুষের বিশ্বাস হারাবে|”
বলতে বলতেই অভিমানে গাড়ি ঘুরিয়ে চলে গেলেন আমার বিকেলবেলার উত্তমকুমার|
গল্পটা বড় হয়ে গেল খুব? না? আরে বড় হয়ে গেল তো লগি দিয়ে টেনে জঞ্জালের গাড়িতে ফেলে দিন! দেখবেন — নোংরায় বাচ্চাদের ভাতের দলার মত ছোট্ট হয়ে থাকবে গপ্পটা| আবার বলা যায় না — শিশুর মুখ থেকে নালমাখা ভাত ছিটকোবার মত হয়ত এক দেশপ্রেমিক ছিটকে যাবে চারদিকে ! আর তার মরা শরীর থেকে উঠতে লাগবে ফোটা পদ্মের গরম গন্ধ ! ——Classified
অসাধারণ । নিজের কাছে সৎ থাকুন । তাহলেই এদের দেখতে পাবেন । এরা আপনার পাশে আছে ।
এঁরা আছেন বলেই আমি আছি । মন বলে ভালো মানুষের পাল্লা ভাড়ি এখনও । হয়ত দেখতে চাইনা, হারিয়ে ফেলি ।
এই তো সাধু সঙ্গ !!
একদম ঠিক বলেছেন অমরদা
ভালো মানুষেরে আছেন ,তাই এখনো পৃথিবীটা এক ছন্দে ঘুরছে । সুন্দর প্রকাশ
Excellent.
সৎ সাহসে নিজের ভাব প্রকাশ করলে ময়ূরাবতী-সততা নিয়ে কাটাও জীবন-বেঁচে থাক আমার সৎ শ্রমিকের দল ♥️✌️✊
পৃথিবীতে এখনো এই ধরনের মানুষ আছেন যাদের জন্য আজও আমরা ভাবতে পারি এনাদের কথা। সহজ সরল সৎ মানুষ জন নিয়ে আমরা আগামী দিনে সুন্দর পৃথিবী দেখবো। ময়ূরীদেবী যা লিখেছেন তা শুধু ঘটনা নয় এক সুন্দর স্বপ্ন, এক আশা। খুব সাবলীল ভাবে অসাধারণ লেখা।
মানুষের মত মানুষ সত্যিই এখনো আছে। সেই বিকেলবেলার উত্তমকুমার এখনো বিরল নন। ভালো লাগলো। ধন্যবাদ পড়ানোর জন্য।
ভীষণ নাড়া খেলাম