বাড়ির কাজকর্ম করে যে মেয়েটি কিছু না বলে কয়েই সেদিন দুম্ করে কামাই করতেই ঘোষ গিন্নির মেজাজ সাত সকালেই একেবারে বে লাইন। বাড়িতে লোকজন অবশ্য মাত্র দুজন – পাড়ার সব বাড়িতেই আজকাল তেমনই নাকি হাল। যাইহোক গরহাজিরার ব্যাপারটা পাকা হতেই ঘোষ কর্তা রীতিমতো ব্যস্ত হয়ে পড়েন সকালের চা এর পর্বটা মিটিয়ে ফেলতে। বাড়িতে রান্নাবান্নার পাট চুকিয়ে দিয়েছেন বেশ কিছু দিন। আজকাল এমন হঠাৎ করে ছোট হয়ে যাওয়া পরিবারের অধিকাংশই নাকি ক্লাউড কিচেন থেকে খাবার আনিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে বেশ অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। এতে নাকি অনেক সাশ্রয়,হেঁসেলের হরেক হ্যাপা সামলানোর দায় নেই।
পরদিন ঠিক ঘড়ির সময় মেপে মঙ্গলা হাজির হতেই শুরু হয় জেরার পর্ব। মঙ্গলা কথা বলে কম, তবে আজ যেহেতু অনুপস্থিত থাকার কারণ দর্শাতে হবে তাই দু একটা কথা বলতেই হলো। কাল সকালে ডাক্তার বাবুর কাছে গিয়েছিলো বড়ো মেয়েটাকে নিয়ে। ডাক্তারবাবু বলেছেন মেয়ের শরীরে রক্ত কম – ও এ্যানিমিক। ভালো খাবার খেতে হবে। ওষুধপত্র নিয়মিত খেতে হবে।
মঙ্গলা যতটুকু বললো ততটুকুই যে এই সমস্যার সবটুকু তা একদম নয়। আসলে এই সমস্যার বিষয়ে কয়েকটি কথা বলবো বলেই আজ হাজির হওয়া। শুরুতেই একটা ব্লাড রিপোর্ট পেশ করি।এই রিপোর্টটি এক পঞ্চাশোর্ধ ভদ্রমহিলার।
বেশ কিছুদিন ধরে ক্লান্তি, শারীরিক দুর্বলতা আর শ্বাসকষ্টের সমস্যা নিয়ে ভুগছিলেন। মুখ চোখের মধ্যে কেমন যেন একটা ফ্যাকাশে বিবর্ণ হলদেটে ভাব। এই পরিবর্তনগুলো নজরে এসেছিল তাঁর মটোর মেকানিক স্বামীর। তিনিই একরকম জোর করেই স্ত্রীকে নিয়ে যান স্থানীয় ডাক্তার বাবুর কাছে।
ল্যাবরেটরি রিপোর্টে দেখা গেল তাঁর শরীরে রক্তের হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ 8.3 g /dL যা ন্যূনতম স্বাভাবিক মাত্রা 12.0 g /dL থেকে বেশ খানিকটা কম, অর্থাৎ তিনি এ্যানিমিক। হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কম হলেও তাঁর সিরাম আয়রনের পরিমাণ একদম ঠিকঠাক, স্বাভাবিক । রক্তের অন্যান্য উপাদানের স্বাভাবিকতাতেও গরমিল নেই। তাহলে? রিপোর্টের এই বিষয়টিই অ্যানিমিয়ার অন্যান্য কারণগুলো নিয়ে অনুসন্ধানের সুযোগ করে দিল ডাক্তারবাবুকে।দীর্ঘদিন ধরে একটা প্রচলিত বিশ্বাস রয়েছে সকলের মধ্যে যে রক্তে আয়রন এবং ফোলেটের ( একটি বিশেষ ধরনের পুষ্টিমৌল যা রক্তের হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বাড়ায়)ঘাটতি থাকলে তা হলো অ্যানিমিয়ার প্রধান কারণ। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে যে শরীরে ভিটামিন B12 এর ঘাটতি থাকলে তা থেকেও শরীরে অ্যানিমিয়া বাসা বাঁধতে পারে। এছাড়া ক্রনিক ডিজিজ, শরীরের জন্মগত জেনেটিক সমস্যা , বোন ম্যারো বা অস্থি মজ্জার সমস্যা, রক্তের লোহিত কণিকার অতিরিক্ত মাত্রায় ভেঙে যাওয়া, থাইরয়েড গ্রন্থির অস্বাভাবিকতা এবং কিছু ওষুধপত্র নিয়মিত খাওয়ার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবেও শরীরে রক্তাল্পতা দেখা দিতে পারে। চিকিৎসা গবেষকেরা আরও জানিয়েছেন যে অপেক্ষাকৃতভাবে অর্থনৈতিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়া পরিবারের সদস্যরা ম্যালেরিয়া বা টিউবারকুলোসিস এর মতো প্রধান রোগে আক্রান্ত হলে তাদের মধ্যে অ্যানিমিয়া বাসা বাঁধতে পারে। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো বায়ুদূষণের কারণেও শরীরে যেসব পরিবর্তন ঘটে তার ফলেও শরীরে আয়রনের অধিগ্রহণ ও সঞ্চয়ে টান পড়ে যা অ্যানিমিয়ার অন্যতম কারণ।
দেশের একটা বড়ো অংশের শিশু, মহিলা – বিশেষত অন্তঃসত্ত্বা মহিলা এবং বিশেষ বয়সের পুরুষদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান অ্যানিমিয়াগ্রস্ততার প্রবণতা লক্ষ করে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আহ্বানে দেশকে অ্যানিমিয়া মুক্ত করার এক বিশেষ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে – অ্যানিমিয়া মুক্ত ভারত। ২০১৮ সালে এই প্রকল্পের সূচনা হয়। এই কর্মসূচির অঙ্গ হিসেবে এই রোগে আক্রান্ত মানুষদের মধ্যে আয়রন ও ফলিক অ্যাসিড সমৃদ্ধ ওষুধ বিতরণ করা হয়, পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের প্রয়োজনীয় অণুখাদ্য সমৃদ্ধ চাল সরবরাহ করার ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে কেবলমাত্র আয়রন ট্যাবলেট গ্রহণ করলেই অ্যানিমিয়া থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে এমন নয় , এই অতিরিক্ত মাত্রায় গৃহীত আয়রন ঠিকঠাকমতো শরীর গ্রহণ করতে পারছে কিনা সেই ব্যাপারে সুনিশ্চিত হওয়া দরকার। অ্যানিমিয়া হবার পেছনে যে অন্যান্য কারণগুলো দায়ী সেগুলো সম্পর্কে ঠিকঠাক অবগত না হয়ে কেবলমাত্র আয়রন ট্যাবলেট গ্রহণ করা হলে তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হবার প্রভূত সম্ভাবনা রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে ভারতে অ্যানিমিয়া আক্রান্ত মানুষের চিকিৎসা করার ক্ষেত্রে রক্তাল্পতার সঠিক কারণ জানা খুব খুব জরুরি এবং তার পরেই খাদ্যতালিকায় প্রয়োজনীয় পরিবর্তন, আয়রন সমৃদ্ধ দানাশস্যের নিয়ন্ত্রণ এবং আয়রন সাপ্লিমেন্ট শরীর ঠিকঠাক গ্রহণ করছে কিনা সেই ব্যাপারে সুনিশ্চিত হতে হবে। আসলে শুধুমাত্র রক্তে আয়রনের মাত্রা কমে যাওয়াই যে অ্যানিমিয়ার একমাত্র কারণ নয় সেটা সকলকেই বুঝতে হবে। এই বিষয়ে প্রয়োজনীয় সচেতনতার অভাব রয়েছে সর্বস্তরেই। শরীরে ন্যূনতম কাঙ্ক্ষিত হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বিষয়ে সকলকে আরও সচেতন করার সাথে সাথে আয়রন ট্যাবলেট গ্রহণের ফলে সম্ভাব্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলোর প্রতিকার কীভাবে করতে হবে সেই বিষয়ে সচেতন করতে হবে।
২০১৬ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যবর্তী সময়ে সারা দেশে ১৯ থেকে ১৯ বছর বয়সী প্রায় ১০০০০০ জন টিন এজারদের মধ্যে সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে শরীরে পর্যাপ্ত পরিমাণে আয়রনের ঘাটতি থাকায় তারা রক্তাল্পতায় আক্রান্ত। আয়রনের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় মাত্রায় ফোলেট, ভিটামিন A, ভিটামিন B12, ভিটামিন D এবং জিঙ্কের ঘাটতির কারণেও শরীরে অ্যানিমিয়া বাসা বেঁধেছে। তবে Vitamin D এর অভাব পরোক্ষভাবে অ্যানিমিয়া ঢেকে আনতে পারে শরীরে। ২০২৫ এর জানুয়ারি মাসে ইউরোপিয়ান জার্নাল অফ ক্লিনিকাল নিউট্রিশন পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধ সূত্রে জানা গেছে ভারতের ৮টি রাজ্যের অধিবাসীদের ওপর করা এক সমীক্ষায় অ্যানিমিয়া সম্পর্কে অনেক নতুন তথ্য উন্মোচিত হয়েছে। এই সমীক্ষার ফলাফল থেকে জানা গেছে যে “ শরীরে আয়রনের অভাবের কারণে মাত্র এক তৃতীয়াংশ মানুষ অ্যানিমিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে।” এই বিষয়টি যে এতো দিনের চেনা ধারনা থেকে অনেকটাই আলাদা তা বোধহয় বলার অপেক্ষা রাখেনা। গবেষকরা আরও জানিয়েছেন যে অন্যান্য যেসব সহযোগী শরীরী সমস্যার কারণে রক্তাল্পতায় আক্রান্ত হতে দেখা যায় সেগুলো রোগের কারণ হিসেবে অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক । রক্ত পরীক্ষা করার জন্য ক্যাপিলারি
রক্তের বদলে ধমনী থেকে রক্ত নিয়ে পরীক্ষা করে দেখা গেছে বিভিন্ন বয়সের মানুষের মধ্যে রক্তাল্পতার সমস্যা অনুমিত সংখ্যার তুলনায় বেশ কম। শরীরে ভিটামিন B12 এবং ফলিক এসিডের ঘাটতি থাকলে তা রক্তাল্পতা সৃষ্টি করে।
তবে এই সমীক্ষার সবথেকে চিন্তনীয় বিষয় হলো বায়ুদূষণের ফলে শরীরে অ্যানিমিক হয়ে পড়ার বিষয়টি যা সম্পূর্ণ আলাদা এক নিবন্ধের বিষয় হয়ে উঠতে পারে।অ্যানিমিয়ার অন্যান্য কারণগুলো হলো ক্রনিক রোগ যেমন কিডনির সমস্যা,রিহিউমাটয়েড আর্থারাইটিসের সমস্যা এবং ক্যান্সার আক্রান্ত হওয়া। এদের ক্ষেত্রে রক্তাল্পতার সমস্যা একটি সহযোগী উপসর্গ হিসেবে মান্যতা পায়। চিকিৎসকদের মতে ক্রনিক রোগ এবং শরীরের প্রদাহের ফলে erythropoietin নামের এক হরমোনের উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায় যা লোহিত রক্ত কণিকার পরিমাণ বাড়াতে সাহায্য করে।
বহুবিধ শারীরিক কারণে আমাদের শরীরে রক্তের হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কমে যায়। ফলে অ্যানিমিয়া আক্রান্ত কোনো মানুষের চিকিৎসা করার সময় চিকিৎসকদের সমস্যার প্রকৃত কারণ খুঁজে বের করতে হবে। প্রচলিত ধারনার বশবর্তী হয়ে কেবলমাত্র আয়রন ট্যাবলেট গ্রহণ ও খাদ্যতালিকায় প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনা হলে তা হিতে বিপরীত হতে পারে।
এপ্রিল ০৯.২০২৫.
ঘরে ঘরে রক্তাল্পতা।খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন অন্যতম কারণ
Beautifully explained! The science made easy for laymen (like us) through simple elucidation. The author might have left teaching, but the teaching hasn’t left him (to be precise) ! Would like to read more such topics of general interest from him in coming days. An excellent read !