এক্ষুনি বহু পাঠক রে রে করে উঠতে পারেন রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত গানটিকে ভুল টাইপ করেছি বলে। না কিছুটা ইচ্ছাকৃত। আসলে শরৎকালের শুভ্র সকালে কার না একটু মন কেমন করে । এই করোনা আবহে বাইরে যাবার কি যো আছে। তাই মন ক্যামেরার ওপর ভরসা করে কল্পনার ডানা মেলেছিলাম।
কংক্রিটের জঙ্গল ছেড়ে অনেক দূরে নির্জনে কোন বড় দীঘির ধারে। দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ মাঠের ওপর বকেরা ভীড় জমিয়েছে। আম জাম নারকেল গাছের ফাঁক দিয়ে দীঘির জলে নীল আকাশের সাদা মেঘের স্থির প্রতিবিম্ব ভেঙে জলে অলসভাবে বিচরণ করছে কিছু সাদা হাঁস। ধারে জংলা গাছে রংবেরঙের ফুল আর তাকে ঘিরে কত না চিত্রবিচিত্র প্রজাপতির আনাগোনা। এমন রঙিন নিখিল দৃশ্য কিন্তু উপভোগ করতে পারত না অমল কাকু। অমল কাকু আমাদের পাড়ায় থাকতেন। তিনি ছিলেন অন্ধ। খুব ধীরে রাস্তা পেরোতেন হাতে লাঠি নিয়ে। আমাদের কাজ ছিল তাকে সাহায্য করা ও বিভিন্ন গল্প করা। ছোটবেলায় কিছু না বুঝলেও মনে হত অন্ধ কানাইরা কেন সব সময় ভিক্ষা করবে। তাদের চোখের চাপ চাপ অন্ধকার মোচন করবে না কেউ?
সেই ১৮০৯ সালে দৃষ্টিহীন পনেরো বছরের বালক লুই ব্রেইল প্রথম দৃষ্টিহীনদের জন্য বিশেষ লিখবার পদ্ধতি আবিষ্কার করলেন। তারপর থেকে বিজ্ঞানের উন্নতির হাত ধরে কত পথ অতিক্রম করে এখন ব্রেইল নোটটেকার এর মাধ্যমে কম্পিউটারে টাইপ করতে পারে। কিন্তু দৃষ্টির উন্নতির জন্য কি হল?
অর্ক্যাম বলে একটি কোম্পানি অর্ক্যাম মাই আই (orcam My Eye) বলে একটি সুবহ, হালকা, কৃত্রিম দর্শনশক্তি সম্পন্ন যন্ত্র এনেছে যা অন্ধ বা অল্প দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষদের পাঠ, সামনের সকল বস্তুকে যে কোন orientation বা স্থিতিতে থাকা বস্তুকে জানতে সাহায্য করে। এর সাথে একটা শ্রবণকারী যন্ত্র বা earpiece থাকে যা ২০ টির বেশি ভাষায় যন্ত্রধারককে বলে দেয় সব কিছু। এই তারবিহীন স্মার্ট ক্যামেরা যে কোন আই ফ্রেমে লাগালে যে কোন বই, লেখা পাঠ করে যায়, বা লেখাকে শ্রবণযোগ্য ভাষায় বর্ণনা করে যায়। বাজারে গেলে পণ্যের বারকোড চিহ্নিত করে সব কিছু বলে দেয়। পরিচিত, বিখ্যাত বা সহকর্মীদের নিকট আত্মীয়দের face recognise বা মুখ চিহ্নিত করে তার উপস্থিতি বর্ণনা করে। এমনকি সামনে দরজা, চেয়ার বা যা আছে তার ব্যাপারে সব বলে দেয় এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা artificial intelligence| ভীষণ খারাপ দৃষ্টিসম্পন্ন গ্লুকোমা রুগীদের স্বাধীনভাবে পড়তে সাহায্য করে এই যন্ত্র।
২০১০ সালে এই অর্ক্যাম কোম্পানি তৈরি হয় জেরুজালেমে। এর জনক জিভ অভিরাম ও আমন সাসূয়া। এদের সৃষ্টি দুটি পণ্য অর্ক্যাম মাই আই ও মাই রিডার।
এই আমন সাসূয়া ইজরাইলের একজন বিখ্যাত কম্পিউটার বিজ্ঞানী ও উদ্যোগপতি। উনি হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞানের অধ্যাপক। অপরদিকে বিখ্যাত আমেরিকান বহুজাতিক কোম্পানি যারা বিশ্বের সবচেয়ে বড় অংকের কম্পিউটার সেমিকন্ডাক্টর চিপ নির্মাণ করে সেই ইন্টেল-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট। আবার মোবাইল আই কোম্পানির জনক। উনি ইজরাইলের প্রথম ডিজিটাল ব্যাংক শুরুর কথা ঘোষণা করেছেন। ওনার তৈরি কোম্পানি প্রথম কৃত্রিম গাড়ি চালানোর যন্ত্র উদ্ভাবন করে যা ড্রাইভিং সহায়ক প্রযুক্তির মাধ্যমে পথচারী, ট্রাফিক সিগন্যাল, গলি রাস্তা সব কিছু বাঁচিয়ে বিনা সংঘাতে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করে। এটা একটা স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তি। উনি কম্পিউটার বিজ্ঞান নিয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করে পিএইচডি করেন মস্তিষ্ক ও কগনিটিভ ডিসিস নিয়ে। বাকি গবেষণা করেন MIT থেকে। ওনার ১০০ এর ওপর গবেষণা পত্র আছে যন্ত্রবিদ্যা ও computerised ভিশন নিয়ে। এই মুহূর্তে ওনার কোম্পানিতে ১৫০ জন কাজ করেন।তার তৈরি মোবাইল আই-কে ইন্টেল ২০১৭-তে কিনে নেয় ১৫.৩ বিলিয়ন ডলারে।
এই যন্ত্র গুগল গ্লাসের থেকে অনেক ভালো। গুগল গ্লাস প্রথম স্মার্ট গ্লাস যা ৫ মেগাপিক্সেল স্থির ও সাথে অত্যন্ত আধুনিক ভিডিও ক্যামেরা নিয়ে শুরু করেছিল তার যাত্রা। এই গ্লাস ধারক যন্ত্রের মাথায় প্রতিস্থাপিত ছিল। কিন্তু গোপনীয়তা লঙ্ঘনের দায়ে একে বাজার থেকে তুলে নেওয়া হয়। এখন গুগল গ্লাস পাল্টে এনেছে অগমেডিক্স যা একধরনের app সহ পরিধেয় যন্ত্র যা চিকিৎসকরা পড়ে প্রবাহমান রুগীর স্রোতে নিবদ্ধ থাকলে এই যন্ত্রে সকল রোগ ও রুগীর তথ্য আপনা থেকে রেকর্ড হয়ে যায়। এছাড়া চিকিৎসক ও রোগীর কথোপকথন transcribe করে রাখবে এই যন্ত্র। এই স্মার্ট গ্লাস ব্যবহার করে রোগীর রেটিনার বিভিন্ন ছবি, লিভার biopsy, fistuloplasty বা interventional radiology-তে বহুল ব্যবহার হচ্ছে। কিন্তু My Eye যন্ত্রটি অন্ধজনে আলো না দিলেও কিছুটা উপকার করছে বৈকি। অর্ক্যাম My Eye এর দাম ৩৫০০ ডলার ও My Reader এর দাম ২৫০০ ডলার। নিশ্চয় এ পথে চলে আগামী দিনে অন্ধত্বকে একদিন বিজ্ঞান জয় করবেই। তার আগে মরণোত্তর চক্ষুদান চলুক।
এ অভাগা দেশে মেধার অভাব নেই। আমাদের দেশে বিজ্ঞানী, চিকিৎসক, গবেষকরা মিলে যদি দেশীয় প্রযুক্তিতে ওমন সুন্দর যন্ত্র অনেক সস্তায় উদ্ভাবন করেন কানাই রা তাহলে অনেক স্বনির্ভর হতে পারেন। মন্দির মূর্তির জন্য খরচ না করে যদি সরকার বাহাদুর এসব দিকে নজর দেন তবে অমলকাকুদের অনেকটা দুঃখ মোচন হয়। তাই না?
এইসব এর পিছনে খরচ করলে ভোট পাওয়া যাই না । আমরাও এখন আর কানাই এর কথা ভাবি না মন্দির হলো কি না সেটা নিয়ে ভাবতে ভালোবাসি।আমি মনে করি কানাই এর কথা ভাবা উচিত।
এতো সহজ ভাবে সুললিত বাংলায় এ প্রবন্ধটি শুধুই সুখপাঠ্য নয় – অতি প্রয়োজনীয় বটে। লেখককে আমি সাধুবাদ জানাই এই চমৎকার লেখনীর জ।