পরশু ছিল পয়লা বৈশাখ। শুভ দিন। মা বলে, এইসব দিনে ভালো ভালো কথা বলতে হয়। তাই, খারাপ খবর দিইনি।
মা এও বলে, এমন একটা কথা চালু আছে, পয়লা বৈশাখে যা যা করা হয়, বছরের বাকি দিনগুলোতেও নাকি তেমনটাই ঘটতে থাকে। তাই, এই দিনটাতে খারাপ কাজ করতে নেই, ফাঁকি দিতে নেই ইত্যাদি প্রভৃতি।
তা বছরের সেই প্রথম দিনটিতেই ডাক্তার পিটিয়ে ডাক্তারের বাড়ি ভাঙচুর করলেন যাঁরা, তাঁরা নিশ্চয়ই বছরের বাকি দিনগুলোতেও তেমনই করবেন। রোজ রোজ অতটা না করা গেলেও অন্তত নিত্যকর্মবিধি অনুসরণ করে ডাক্তারের নামে বাপবাপান্ত শাপশাপান্ত করে চলবেন। যেমনটা তাঁরা করেন। করে থাকেন।
আর বাকি সবাই মারধর ভাঙচুর না করতে পারলেও ওই গালিগালাজটুকু করতে থাকবেন। যাতে চিকিৎসকদের শত্রু মনে করার একটা চমৎকার পরিমন্ডল জারি থাকে, যেখানে চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীকে মারধর ইত্যাদি গ্রাফের এক্সট্রিম মাত্র – শাস্তিযোগ্য অপরাধ অবশ্যই, কিন্তু সার্বিক সমাজের মাপকাঠিতে নৈতিক অপরাধ নয়। ঠিক যেমন ধর্ষককে পিটিয়ে হাড়গোড় ভেঙে দেওয়া – আইনের বিচারে অন্যায় অবশ্যই, কিন্তু অনুচিত কিনা বলা মুশকিল।
ওহ্, গতকালের ঘটনাটাই জানেন না? অতি সংক্ষেপে বলি তাহলে।
স্থানীয় এক যুবক অসুস্থ হলে এলাকার লোকজন তাকে স্থানীয় ডাক্তারবাবুর বাড়ি নিয়ে আসে। ডাক্তারবাবু দেখেই সন্দেহ করেন, এ সাধারণ কিছু অসুস্থতা নয়, বড়সড় হার্ট অ্যাটাক। ডাক্তারির ভাষায়, অ্যাকিউট মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কসন। অতএব তিনি পরামর্শ দেন, যুবককে যেন তখুনি স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হাসপাতাল নিয়ে যাওয়ার পথেই তার মৃত্যু হয় এবং হাসপাতালে তাকে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়। সহৃদয় মানুষজন চটজলদি এসে ডাক্তারের বাড়ি চড়াও হয় এবং চলতে থাকে ভাঙচুর। ডাক্তারবাবুর উপর আক্রমণ তো চলেই, সঙ্গে বাড়িতে ঢুকে তাণ্ডব। পুলিশ এসে উদ্ধার না করলে, ডাক্তারবাবু প্রাণে বাঁচতেন কিনা বলা মুশকিল। পরবর্তীতে অবশ্য পুলিশ অপরাধীদের ধরার চাইতে ডাক্তারবাবুকে থানায় বসিয়ে রেখে “তদন্ত করতে” ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
তো, মোদ্দা ঘটনাটা এই। অনেকেই এতে বিচলিত হওয়ার মতো কিছু খুঁজে পাবেন না হয়ত। ইন ফ্যাক্ট, এতদিন ধরে এমন অসংবেদনশীল মানসিকতা দেখতে দেখতে এঁদের বিচলিত না হওয়া দেখে আমিও আর বিচলিত হই না। তবু কিছু কথা মনে করিয়ে দিই। কথাগুলো এতখানিই স্বতঃসিদ্ধ যে আপনার মনে হতেই পারে, এ আর বলার কী আছে!!! তবু আশেপাশে তাকিয়ে মনে হয়, কথাগুলো অনেকেই ভুলে গিয়েছেন।
১. মানুষ মাত্রই মরণশীল। মানে, জন্মানোর পর একটি ব্যাপারই নিশ্চিত। সেটা হলো মৃত্যু।
২. মৃত্যু অনিবার্য হলেও কে কোথায় কখন কীভাবে মরবে (মানে, মারা যাবেন), তা অনিশ্চিত। সঠিক সময় চিকিৎসা করা গেলে কিছু ক্ষেত্রে মৃত্যু আটকানো যায়, কিছু ক্ষেত্রে যায় না। কার ক্ষেত্রে যাবে আর কার ক্ষেত্রে যাবে না, তার মধ্যেও প্রবল অনিশ্চয়তা রয়েছে। চিকিৎসকের সৎ প্রয়াস সত্ত্বেও।
৩. হাইটেক চিকিৎসা পরিকাঠামো হলে কিছু ক্ষেত্রে মৃত্যু ঠেকানোর সম্ভাবনা বাড়ে। কিন্তু ওই সম্ভাবনাটুকুই বাড়ে, নিশ্চয়তা মেলা মুশকিল। তবুও যেটা বাড়ে, তা হলো চিকিৎসা বা বাঁচানোর চেষ্টা করার সুযোগ।
৪. কিছু অসুখের ক্ষেত্রে নিদেনপক্ষে চেষ্টাটুকু করতে পারার জন্যও একটা ন্যূনতম পরিকাঠামো জরুরি। পরিকাঠামো যেখানে নেই, সেখানে “চেষ্টা করা”-র অর্থ সময় নষ্ট – অতি মূল্যবান সময় নষ্ট – যা কিনা আরোগ্যের সম্ভাবনা বাড়ায়। (এরপরও অবশ্য আপনি প্রশ্ন করতেই পারেন, বড়সড় হার্ট অ্যাটাকের মতো প্রাণঘাতী অসুখের “চিকিৎসা” ডাক্তারবাবু বাড়ির বৈঠকখানায় করার “চেষ্টা” করেননি কেন!!)
৫. আমাদের দেশ বা আমাদের রাজ্যের কথা ছেড়েই দিন, প্রথম বিশ্বের দেশগুলোতেও প্রত্যন্ত অঞ্চলে এমন কিছু হাইটেক চিকিৎসা পরিকাঠামো নেই। যেটা আছে, সেটা হলো স্বচ্ছ রেফারাল সিস্টেম এবং অত্যুন্নত পরিবহন ব্যবস্থা। অর্থাৎ, গুরুতর অসুস্থ রোগীকে চটজলদি উন্নততর সেন্টারে রেফার করা এবং তাঁরা যাতে অতি দ্রুত সেখানে পৌঁছাতে পারেন, তা নিশ্চিত করা।
৬. প্রতিটি দেশেই চিকিৎসা ব্যবস্থা একটি পিরামিড সিস্টেমে চলে। সারা দেশের প্রতিটি অংশে ছড়ানো প্রাইমারি হেলথকেয়ার সেট-আপ। সেখানে যে রোগের চিকিৎসা হবে না, তাদের জন্য সেকেন্ডারি হেলথকেয়ার সেট-আপ – সেখানেও না হলে টার্শিয়ারি হেলথকেয়ার। কোনও ব্যক্তি-রোগী নিজের ইচ্ছেমত শুরুতেই টার্শিয়ারি হেলথকেয়ার সেট-আপে গিয়ে হাজির হতে পারেন না। আমাদের এখানে মেডিকেল কলেজের ওপিডি ভর্তি জ্বর-সর্দিকাশি-পেটখারাপের রোগীতে। গুরুতর অসুস্থ রোগী রেফার হয়ে এলেও প্রায়োরিটি পান না।
৭. অর্থাৎ, সুষ্ঠু স্বাস্থ্যব্যবস্থা বা স্বাস্থ্য-পরিকাঠামোর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কথা হল সঠিক রেফারাল সিস্টেম। এদেশে সমস্যা হল, কোনও রেফারাল ছাড়াই রোগীদের সরাসরি টার্শিয়ারি কেয়ার হাসপাতালে চলে আসতে পারা। কিন্তু সেই সমস্যার কথা ভুলে সবাই “রেফার রোগ”-এর দাওয়াই খুঁজতে ব্যস্ত।
৮. “রেফার রোগ” নিয়ে হইচইয়ের অনিবার্য অনুষঙ্গ হলো এমন বার্তা যে, রেফার ব্যাপারটাই গোলমেলে। অর্থাৎ প্রায় সব অসুখেরই চিকিৎসা স্থানীয় স্তরে করতে পারা উচিত। কথাটা ভুল। শুধু ভুলই নয়, বিপজ্জনকও। কেননা, সেক্ষেত্রে গুরুতর অসুস্থ রোগীকে রেফার করা হলেও পরিজনের ক্ষোভ স্বাভাবিক। আর, টার্শিয়ারি হেলথকেয়ার সেট-আপে অকারণ ভিড়ের সুবাদে রেফারাল সহ গুরুতর অসুস্থ পেশেন্টের হয়রানি তো স্বতঃসিদ্ধ। সব মিলিয়েই…
৯. এতদসত্ত্বেও, সব কিছু নিখুঁত হলেও, উন্নততম ও চূড়ান্ত ব্যয়বহুল চিকিৎসা পরিকাঠামো অব্দি পৌঁছেও মানুষ মারা যান। কেননা, এক নম্বর পয়েন্ট থেকে পড়তে থাকুন। ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে পয়েন্টটা ভ্যালিড। মুকেশ আম্বানি ও গৌতম আদানি, প্রত্যেকেই একদিন না একদিন মারা যাবেন, এটুকু নিশ্চিত (ঈশ্বর তাঁদের দীর্ঘজীবী করুন)।
১০. উন্নত স্বাস্থ্যব্যবস্থার দেশে উন্নত চিকিৎসা পরিকাঠামো রয়েছে, মানুষের গড় আয়ুও বেশি। কিন্তু সেই বাড়তি আয়ুর পেছনে হাইটেক চিকিৎসা পরিকাঠামোর অবদানের চেয়ে ঢের বেশি গুরুত্বপূর্ণ প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা। এবং তার চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ, শিক্ষা, পুষ্টি, পরিশ্রুত পানীয় জল ইত্যাদি। এদেশের সেসবের পরিস্থিতি… নাহ্, থাক।
আপাতত এটুকুই বলার।
পুলিশ অপরাধীদের গ্রেফতার করুক, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক ইত্যাদি অবান্তর দাবি আর করছি না। কেননা, প্রত্যাশা থেকেই হতাশা জন্মায়। তাই প্রত্যাশার জায়গাটাই কমিয়ে আনছি। ডাক্তারদের বাপ-চোদ্দপুরুষ উদ্ধারের চাইতে স্বাস্থ্য বিষয়ে বা দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার বেহাল দশা বিষয়ে আপনি সচেতন হবেন, এ প্রত্যাশাও করছি না। কেননা, ওই যে বললাম, প্রত্যাশা থেকেই…
পুনঃ– একটু চোখকান খোলা রাখলেই দেখবেন, আজকালকার ‘চশমখোর’ ‘জালি’ ‘এথিক্স-বর্জিত’ ডাক্তাররা পরিচিত মহলে যেকোনও প্রয়োজনের মুহূর্তে চিকিৎসা সংক্রান্ত অ্যাডভাইস দিয়ে থাকেন। “পয়সা ছাড়া কিচ্ছু বোঝে না”, “দিনরাত টাকার পেছনে দৌড়াচ্ছে” – তবুও বিনেপয়সাতেই অ্যাডভাইস দেন। (আরেক “ঘৃণিত” পেশার মানুষ, অর্থাৎ অধ্যাপক-শিক্ষক, তাঁরাও আপনার ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার ব্যাপারে চাইলেই পরামর্শ দেন – ওই, বিনেপয়সাতেই!) অন্যান্য পেশাদার যেমন উকিল বা চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট, এঁদের কাছে আইনি বা আয়কর সংক্রান্ত শলা চেয়ে দেখবেন প্লিজ – তাঁরা “ডিটেইলস” না দেখে কিছুই বলেন না। (কোনও এক অজ্ঞাত কারণে, এঁরা অবশ্য আপনার চিকিৎসা ঠিক কোথায় কত ভালো হতে পারে, সে বিষয়ে ঢালাও পরামর্শ দিয়ে থাকেন। বিনেপয়সাতে। “ডিটেইলস” না জেনেই। অনেকসময় অযাচিতভাবেও।) আর “ডিটেইলস” জানানোর পথটি যদিও… নাঃ, থাক। ডাক্তার অবশ্য অসুখের ডিটেইলস না জেনে ওষুধ বলতে না চাইলেই আপনি নিশ্চিত, “মালটা পয়সা না পেলে…”
গতকালকের মতো প্রতিটি ঘটনা ডাক্তারদের আরও বেশি করে “সম্মাননীয় পেশা”-র মানুষদের তুল্য আচরণে উদ্বুদ্ধ করবে।