শোনা যায়, বহুকাল আগে এক মহাপণ্ডিত ধর্মবেত্তা মাথা গুঁজে অনেক হিসেবনিকেশ করে বার করেছিলেন যে, ঈশ্বর নাকি এই জগৎটাকে বানিয়েছিলেন চার হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দের চৌঠা জুলাই, ঠিক বিকেল চারটের সময়। সে বৃত্তান্ত শুনে মুগ্ধ হয়ে তাঁর এক বোকা-মতো শিষ্য চোখ পিট পিট করে বলে উঠেছিল, ‘তা হলে গুরুদেব, বড় জানতে ইচ্ছে হয়, সর্বশক্তিমান পরমেশ্বর তার আগে বসে বসে কী করছিলেন?’ গুরুদেব তখন প্রিয় শিষ্যের দিকে গনগনে চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে ঠান্ডা গলায় বললেন, ‘জেনে রাখো বৎস, যারা এমনতর প্রশ্ন করে, সেই বিধর্মী আর নাস্তিকদের জন্য ঈশ্বর তখন নরক বানাচ্ছিলেন।’ হয়তো এ স্রেফ গল্পই, হয়তো এ কথোপকথন আসলে কখনও কোথাও ঘটেনি। কিন্তু যে জিঘাংসা এখানে প্রকাশ পেয়েছে বিধর্মী ও নাস্তিকের জন্য, তার চেয়ে বাস্তব আজকের পৃথিবীতে আর কী-ই বা আছে? সে বাস্তবতা টের পাই প্রাতঃকালীন সংবাদে, যখন কোনও এক উন্মত্ত স্বর্গাভিলাষীর অস্ত্রে ঘায়েল হয়ে খবরের কাগজের প্রথম পাতায় হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে থাকে বিধর্মী আর নাস্তিকেরা, রক্তের ঘ্রাণে নোনতা হয়ে আসে সকালের ধূমায়িত চা। সেই বিবিক্ত তরল তাপ আস্বাদন করতে করতে ভাবি, উন্মত্ত ঘাতকের কাছে যে ছিল ‘বিধর্মী’, এই বিপুল পৃথিবীতে তার ‘স্বধর্মী’-ও তো কেউ কেউ আছে। কিন্তু, নাস্তিকের স্বধর্মী তবে কারা? কিংবা, ‘ধর্ম’ শব্দটিকে একটু অন্য অর্থে নিয়ে হয়তো এভাবেও প্রশ্নটা রাখা যায় — নাস্তিকের স্বধর্মটা তবে কী ?
ধর্মবিশ্বাসী যাঁকে ‘নাস্তিক’ আখ্যা দেন, তিনিই কি নাস্তিক? যিনি ধর্মাচরণে আগ্রহী নন, তিনিই কি নাস্তিক? যিনি ধর্ম-নিষিদ্ধ খাদ্য-পানীয় গ্রহণ করেন, তিনিই কি নাস্তিক? হ্যাঁ, এগুলো একজন নাস্তিকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতেই পারে, কিন্তু শুধুমাত্র এগুলোর কারণেই কেউ সত্যিকারের নাস্তিক বলে গণ্য হতে পারেন না। একজন ধর্মবিশ্বাসী অন্য ধর্মবিশ্বাসীকেও নিন্দাসূচক অর্থে ‘নাস্তিক’ বলতে পারেন। একজন ধর্মবিশ্বাসী স্বধর্ম রক্ষার জন্য ধর্মাচরণ তত জরুরি নয় বলে মনে করতে পারেন, বা ইচ্ছে থাকলেও পরিস্থিতির চাপে তা বর্জন করতে পারেন। আবার, উচিত নয় বলে মেনেও স্রেফ অ্যাডভেঞ্চারের জন্য তিনি নিষিদ্ধ খাদ্য-পানীয় গ্রহণে উৎসাহিত হতে পারেন। কাজেই, এসবের জন্য নাস্তিকতা আবশ্যিক নয়। তবে কি সোজাভাবে শব্দার্থকেই গ্রহণ করব, অর্থাৎ, যিনি ‘আস্তিক’ বা ঈশ্বরবিশ্বাসী নন, তিনিই নাস্তিক, এভাবে ভাবব? হ্যাঁ, ঈশ্বর-বিশ্বাস না থাকাটা নাস্তিকতার প্রধান শর্ত তো বটেই, কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। কারণ, ‘নাস্তিকতা’র একরকম সংজ্ঞা নেতিবাচক, ধোঁয়াটে এবং অসম্পূর্ণ। সামান্য কয়েকটা কথায় ব্যাপারটা ব্যাখা করা যেতে পারে।
প্রথমত, নিছক ‘ঈশ্বরবিশ্বাসী নন’ এই কথাটুকু থেকে নাস্তিক কীসে বিশ্বাস করেন না সেটা জানা গেলেও, তিনি কীসে যে আদৌ বিশ্বাস করেন, তা বোঝা হয় না। তাছাড়া, ওভাবে বললে, ‘অ্যাথেইস্ট’ বা নাস্তিকের সঙ্গে ‘অ্যাগনোস্টিক’ বা অজ্ঞেয়বাদীরও তফাত করা যাবে না। নাস্তিক মনে করেন ঈশ্বরের অস্তিত্ব নেই, আর অজ্ঞেয়বাদী মনে করেন ঈশ্বর আছেন কি না কোনওদিনই জানা যাবে না। উভয়েরই ঈশ্বর-বিশ্বাসের অভাব আছে, অথচ দেখুন, ঈশ্বর প্রসঙ্গে দার্শনিক অবস্থান ও মানসিক ভঙ্গি — এই দু’টোতেই আবার গুরুতর পার্থক্যও আছে!
আচ্ছা, নেতিবাচকতার কথা হল, এবার তা হলে ধোঁয়াশার কথাটাও একটু হোক। ধরুন, আপনি বলতে চান যে আপনি কিছু একটা মানেন না, তো আপনাকে পরিষ্কার করে বলতে হবে যে, আপনি ঠিক কী মানেন না, না হলে লোকে আপনার কথা বুঝতেই পারবে না। যদি বলেন স্পাইডারম্যান মানেন না কিংবা পক্ষীরাজ মানেন না, কোনও কতা হবে না। কিন্তু যদি বলেন ঈশ্বর মানি না, মহা গণ্ডগোল, কারণ সবার ঈশ্বর একরকম নয়। আপনাকে ভেঙে বলতে হবে, প্যান্ডেলশোভিনী ‘দুগ্গা’-কে মানেন না, না নিরাকার ‘আল্লা’-কে মানেন না, না সাঁওতালদের ‘সিঙবোঙা’-কে মানেন না, না পলিনেশীয় ‘আকু আকু’ মানেন না, না কি অ্যারিস্টটলের ‘আনমুভ্ড্ মুভার’ মানেন না! এদিকে আবার, এইসব পুরোপুরি ভেঙে বলতে যাওয়ারও অর্থ হয় না। অসংখ্য রকমের ঈশ্বর হয়, নাস্তিক কটার উল্লেখ করবেন? আর তার চেয়েও বড় কথা, ঈশ্বরের স্বরূপ নির্দিষ্টভাবে ব্যাখ্যা করার দায়িত্ব তো স্বয়ং ঈশ্বর-বিশ্বাসীর, নাস্তিক খামোকা সে দায় নিতে যাবেন কেন? কাজেই, ধোঁয়াশার ব্যাপারটা এখন বোঝাই যাচ্ছে। আর, নেতিবাচকতা এবং ধোঁয়াশা যেখানে আছে, সেখানে অসম্পূর্ণতা প্রায় স্বতঃসিদ্ধের মতো।
তা হলে প্রশ্ন, কোথায় নাস্তিকের সেই স্বধর্ম — যা কিনা ইতিবাচক, ধোঁয়াশাহীন, পূর্ণাঙ্গ? জ্যামিতিক বিন্দু বা সরলরেখার মতো করে এর সংজ্ঞা দেওয়া যায় — এমনটা মনে করি না, তবু ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে দেখি একবার। একটু ভাবলে বোঝা যায়, ঈশ্বর যেমনই হোন, ঐশ্বরিকতা আসলে জাগতিক কার্যকারণের কোনও না কোনও একরকমের ব্যত্যয়। ঈশ্বর জগৎকে সৃষ্টি ও রক্ষণাবেক্ষণ করেন জগতের নিজস্ব বাস্তব সম্পর্কজালের ঊর্ধ্বে থেকে, এবং সেইজন্যই সম্ভব হয় জগতের নিজস্ব নিয়মকানুনের ওপর তাঁর অলৌকিক হস্তক্ষেপ। মাদার টেরিজার ‘অলৌকিক নিরাময়’ হোক, কিংবা নজরুলের ‘কালো মেয়ের পায়ের তলায় আলোর নাচন’ — অলৌকিকতার দাবির বাস সবসময়ই জাগতিক কার্যকারণের জালটির মধ্যেকার কোনও এক কাল্পনিক ফুটোর মধ্যে। কাজেই, বিপত্তারণের জন্য ভক্তের যত আকুল আর্জি, সবই ওই ফুটোর মাপে।
অবশ্য কেউ কেউ বলবেন, কেন, সম্পূর্ণ উদাসীন ঈশ্বরও তো থাকতে পারেন, যিনি বিশ্ব সৃষ্টি করেছেন ভক্তের প্রার্থনায় কান দেওয়ার জন্য নয়, কোনও এক অন্তর্লীন সৃষ্টি-তাড়নায়, স্রেফ এ বিশ্ব লয়ে এক বিরাট শিশুর মতো খেলার জন্য। হ্যাঁ, সত্যিকারের কোনও ধর্মীয় গোষ্ঠী এরকম ঈশ্বরে বিশ্বাস না করলেও, কোনও কোনও দার্শনিক এরকম ঈশ্বরের ধারণা দিয়ে গিয়েছেন বটে। তবে তাতেও কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিস্তার মেলে না জাগতিক যুক্তি অতিক্রমী অলৌকিকতার হাত থেকে। যেমন ধরুন, নিউটন সায়েব যদি বলেন যে, ঈশ্বর গ্রহ-তারাদেরকে মাধ্যাকর্ষণ দিয়েছেন, এবং তিনি সেটাই আবিষ্কার করেছেন — তা হলে কিন্তু তাঁর তত্ত্ব দিয়ে শুধু গ্রহ-তারাদের ঘোরাঘুরির ব্যাখ্যাই হল, কিন্তু তারা যে ঠিক কোন প্রক্রিয়ায় ওই মাধ্যাকর্ষণ-ক্ষমতা লাভ করল, সেটা যুক্তি-বুদ্ধির আওতার বাইরেই থেকে গেল।
এবার কথা গুটিয়ে আনতে হয়। নাস্তিকের সত্যিকারের স্বধর্ম তা হলে কোথায় গিয়ে দাঁড়াল? যখন তিনি বলেন যে তিনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন না, তিনি আসলে ঠিক কী বলতে চান? খুব সহজ। তিনি বলতে চান, যে, তিনি সম্পূর্ণ বস্তুময় ও যুক্তিচালিত এক মহাবিশ্বে বিশ্বাস করেন, যেখানে ঠাসবুনোট কার্যকারণের সর্বব্যাপী জালটিতে কোনও রহস্যময় ফুটো নেই। তিনি মনে করেন মহাবিশ্ব মায়া নয়, বাস্তব, এবং তা যুক্তি-বুদ্ধির দ্বারা বোধগম্য। এ-জগৎ মানুষের মঙ্গলের বা অমঙ্গলের জন্য মাপমতো বানানো নয়, একে যুক্তি-বুদ্ধি দিয়ে বুঝে, কখনও বা একটু পাল্টে নিয়ে, ক্রমশ আরও বেশি বেশি বাসযোগ্য করে তোলা যায়। শুধু ঈশ্বর নয়, তিনি ভূত-প্রেত-পরলোক-তন্ত্র-মন্ত্র-জ্যোতিষে অবিশ্বাস করেন, অবিশ্বাস করেন দানিকেন তত্ত্ব ও পরামনোবিদ্যার মতো আধুনিক বিজ্ঞানের ছদ্মবেশ পরা অলৌকিকতাকেও, যেহেতু এই সবকিছুরই শেষ আশ্রয় অযুক্তি আর অন্ধত্ব। তিনি বিশ্বাস করেন সব মানুষই মর্যাদাবান, পৌরাণিক অমৃত সেবনের কারণে নয়, একই মহাবিশ্বের ধুলো থেকে তৈরি বলে।
এইসব বিশ্বাসের কথা ভেবে দেখলে বোঝা যায়, একজন নাস্তিক আসলে তথাকথিত আস্তিকের চেয়ে ঢের বেশি ‘বিশ্বাসী’। কেউ ভাবতে পারেন, নাস্তিক হলে হয়তো বিজ্ঞান-টিজ্ঞান করা যায়, কিন্তু পাপ-পুণ্য আর পরকালে বিশ্বাস না থাকলে নৈতিকতা রক্ষা হয় কি? এর পরিষ্কার উত্তর আজ আমাদের হাতে আছে। সমাজবিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন, যে দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি যত বেশি, শিক্ষাদীক্ষা যত বেশি, অসাম্য-অপরাধ-দুর্নীতি যত কম, সে দেশের মানুষের ধর্মবিশ্বাসও ততটাই কম। ধর্মবিশ্বাসের বাড়বাড়ন্তের সঙ্গে সমাজের উন্নতির সম্পর্কটা সম্পূর্ণ বিপ্রতীপ। পার্থিব জীবনযাপনের গ্লানি যেখানে বেশি, অপার্থিবকে আঁকড়ে ধরার তাগিদটাও সেখানে স্বভাবতই বেশি। সংবাদমাধ্যমে ধর্মোন্মাদদের বীভৎস হত্যালীলা দেখে যাই মনে হোক, আজকের পৃথিবীর প্রতিষ্ঠিত সত্যিটা এটাই যে, সারা পৃথিবী জুড়ে মানুষ অতি দ্রুত ধর্মের মোহ থেকে মুক্ত হচ্ছেন। এইরকম মানুষরা আজ সংখ্যার দিক থেকে তৃতীয়—খ্রিস্টান ও মুসলমানদের ঠিক পরেই—তারপর চতুর্থ স্থানে হিন্দুরা। বিশ্বজুড়ে নানা রঙের ধর্মোন্মাদরা যতই ধর্মতন্ত্র প্রতিষ্ঠার খোয়াব দেখুক, তাদের তাণ্ডব যতই বাড়বে, মানুষও ততই বেশি করে ধর্মের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়তে থাকবে।
একদিন জন লেনন যা গেয়েছিলেন, গোটা পৃথিবী আজ তা গাইবে।
‘ইম্যাজিন দেয়ারস নো হেভেন ইট্স্ ইজি ইফ ইউ ট্রাই নো হেল বিলো আস অ্যাবাভ আস ওনলি স্কাই…’
খুব ভালো লেখা, দাদা। প্রতিদিন-এর রবিবার-এ হুবহু এটাই দিয়েছিলে কি? চমৎকার লেখা।