তুই মিথ্যে বলতিস না।
কারণ মিথ্যে বলা
তোর আসত না।
উনিশশো বিরাশির
যেদিন থেকে তোকে চিনি,
সেদিন থেকে, বদ্বীপের মতো
অনেক ছোট ছোট বিচ্ছিন্ন ঘটনা তোর সত্যি বলার স্বভাবকে বারে বারে প্রমাণিত করেছে।
তুই বলতিস,
থিওরি ক্লাস করতে ভাল লাগেনা।
সেই একই ঘ্যানঘেনে ভাটানি।
ঘুম পেয়ে যায়।
আরও দুচারজনকে নিয়ে কলেজ ক্যাম্পাস ঘুরে বেড়াতিস তুই, অথবা ক্যান্টিনে ভেজ রোল খেতিস।
বলতিস, চিকেন রোলটা বেশি ভাল। কিন্তু ও খাওয়ার পয়সা কোথায়?
বাবাকে চাইব কেন অত পয়সা? কেউ খাওয়ালে অবশ্য খেতে পারি!
অতি বামপন্থী ছাত্র রাজনীতি করতিস কলেজে।
প্রথম তিন বছর কলেজ ইলেকশনে জিতে তোর দল ইউনিয়নে।
বলতিস, এতে আমাদের কোনও কৃতিত্ব নেই।
এরপর ওরা জিতবে।
তাতে ওদেরও কোনও কৃতিত্ব থাকবে না।
মানুষের এক জিনিস বেশিদিন ভাল লাগে না। তাই পাশা ঘোরে। ইতিহাস তার প্রমাণ।
ঠিক হয়েছিলও তাই।
তারপর তুই ভাবলেশহীন মুখে
বিরোধী দলের ব্যাচমেটের সঙ্গে ক্যান্টিনে চলে গেছিলি এগরোল খেতে।
বলেছিলি, আমরা সব বন্ধু।
মতবাদ আলাদা শুধু।
গান গাইতিস, পোস্টার লিখতিস, কার্টুন বানাতিস অসাধারণ, আর বলতিস, ধ্যাত! কিচ্ছু ভাল লাগেনা এসব।
শুধু কাউকে নকল করা।
চল, বরং আড্ডা মারি।
শেয়ালদা আর হাওড়া স্টেশনে গিয়ে উঠে পড়তিস উল্টো পথের ফাঁকা ট্রেনে।
নেমে পড়তিস যত্রতত্র।
গল্প জুড়ে দিতিস গেঁয়ো মানুষদের সাথে।
বলতিস এরা সত্যি আর আমরা মিথ্যে ।
শুনে ওরা হাসত। তুইও যোগ দিতিস সেই হাসিতে।
সিনেমা বা নাটক দেখতে গিয়ে
সামনের সিটে বসা অচেনা মুড়ি খাওয়া মানুষের দিকে হাত বাড়িয়ে বলতিস,
দাদা একটু মুড়ি দিন তো!
কলেজের অ্যানুয়াল সোশ্যালে নিজের লেখা গণসঙ্গীত গাইতিস। হাততালি পড়লে লজ্জা পেতিস।
কলেজ পরীক্ষায় বিশ্রী ফল হলে বলতিস,
আরও বিশ্রী হওয়া উচিত ছিল।
না পড়ে কেউ পাশ করে?
আমার পড়তে ভাল্লাগে না।
ও তো অন্যের জ্ঞান মুখস্থ করা। আমার কি কৃতিত্ব?
নতুন কিছু করতে হয়।
করতে হবে। করব এক সময়।
তোর সঙ্গে ভিড়ে যাওয়া বন্ধুদের বলতিস,
সাবধান। পড়াশোনাটা করবি।
আমার কিন্তু সময় লাগেনা পড়তে। আগে থেকে বলে রাখলাম। দোষ দিসনা ফেল করলে।
বলতিস, যতদিন পারিস পৃথিবী দেখে নে প্রাণ ভরে।
কাজে লাগা পাঁচ ইন্দ্রিয়কে। ঘরে বসে নির্বোধের মতো কেবল পড়াশোনা করে কেউ বড়লোক হয়নি।
বন্ধু ভাল বাসতিস।
জীবন ভালবাসতিস তার থেকে বেশি। তাই তোর বন্ধু বেড়েই চলত।
অপরিচিত, শত্রু সবাই। অবশেষে।
তোর বলয়ে থাকা মানুষেরা তোর মানসিক শক্তি আর ভালবাসার আকর্ষণের ভরসায় বাঁচত।
তুই জানতিস, তোর সম্পদ তোর অকপটতা।
ভালবাসতে পারার ক্ষমতা।
যে কারণে একদিন বস থাকা, স্যার থাকা শ্রদ্ধেয়রাও তোর মানুষকে ভালবাসতে শেখানোর ক্লাসের ছাত্র হয়ে গেছে।
রসগোল্লা সন্দেশ খেতিস। ইলিশ মাছ খেতিস।
আর বলতিস শরীর খারাপ হলে হবে।
মনখারাপ তো হবে না।
আমরা তোর এসব সত্যির ভরসায় বাঁচতাম।
তারপর দিন ঘনিয়ে এল তোর।
ততদিনে ভারতকে বিশ্বের ব্যথা চিকিৎসার ইতিহাসে এক সম্মানজনক স্থান করে দিয়েছিস তুই।
দু হাজার কুড়ি সালে তোর মোটর নিউরন ডিজিজ হওয়ার পর ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের ফোন করলি।
জনে জনে জানালি তোর সে রোগের কথা, যে রোগে পাঁচ বছরের বেশি বাঁচা প্রায় অসম্ভব।
সেই প্রথমবার তুই নিজের বুকে যন্ত্রণা চেপে রেখে মিথ্যেবাদী হলি।
তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিলি সবকিছু। বললি, ভয় নেই।
অন্ততঃ দশ বছর টেনে দেব।
হা হা হা।
মিথ্যে বললি বন্ধু,
যাতে বন্ধুরা ভয় না পায়।
বললি, এ রোগ না হলে বুঝতেই পারতাম না কত মানুষ আমাকে ভালবাসে।
এরপর ঘটনাগুলো ঘটল, যথারীতি, দ্রুতলয়ে।
ক্রমশ শিথিল হয়ে এল তোর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। শ্বাস প্রশ্বাস।
তবুও জিজ্ঞাসা করলে মিথ্যে করে বলতিস ভাল আছিস।
ঈশ্বর বা দৈব এ রোগ সারাতে পারে বলে কোনও শুভাকাঙ্ক্ষী সাহায্য করতে এলে বলতিস,
হলো তো অনেক। আর কতদিন?
তোমাদের অশ্রদ্ধা করি না,
কিন্তু নিজের দর্শন আর বিশ্বাসকে শ্রদ্ধা করি আরও অনেক বেশি।
শেষমেশ মিথ্যে করে মৃত্যুকে ভালবেসে তুইও জুলাইয়ের পাঁচ তারিখ ভোরবেলা চলে গেলি শান্ত মুখে।
মিথ্যে শান্তি।
কারণ আমরা জানি
জীবন কত ভালবাসতিস তুই।
সঙ্গে এও জানি, অন্যের জীবনযাপন তোর কারণে যাতে নষ্ট না হয়,
এ জন্যে কত ব্যাকুলতা ছিল তোর।
জানি, তুই খারাপ নেই।। থাকতে পারিস না।
দেখ, তোর দর্শনকে শ্রদ্ধা জানাতে আমরাও আবার শিখছি নতুন করে ভাল থাকতে।
শুধু তোর জন্য।
আমাদের জন্য,
আমাদের ভাল থাকার জন্য সত্যবাদী থেকে শেষদিকে মিথ্যাবাদী হয়ে যাওয়া,
স্রেফ তোর জন্য।
সবার বন্ধু, তোর জন্য।
০২.০৮.২০২৩
প্রতিটি কথা সত্যি এই কবিতার। এটা আসলে কবিতা নয়। স্বতস্ফূর্ত স্মৃতিচারণ। অচেনা সুব্রতকে অনেকটা চেনা যাবে এর থেকে। ডক্টরস ডায়ালগ কে ধন্যবাদ এ লেখা প্রকাশ করার জন্য।