আজ আবার একটা গদ্য ইয়ে গল্প লেখার চেষ্টা। বেশ তো ছিলাম কবিতা লেখার নাম করে হাবিজাবি লেখায়। আবার এই সব কেন?
কারণ আছে। এই কালিম্পং গুহাবাসের সময়েই মনে হল কবিতার নাম করে যা লিখি তা আদতে পদ্যও নয়। বোদ্ধারা সেই আবর্জনাকে বলে ‘কোবতে’। তো কবিতা আসুক না আসুক সে আমার জন্ম প্রেয়সী। আমি তাকে ছুঁয়েছি বলে তার এত হেনস্থা।
তার চেয়ে আমি গদ্যই লিখি বরং। যে প্রকরণে বাজারের ফর্দ, পুজোর চাঁদার রসিদ, কেজো চিঠি লেখা হয় তাতো জানিই। তিন বাঁড়ুজ্জে থেকে শুরু করে আজকের ঐন্দ্রি্ল, সব্য সিদ্ধার্থ যা লেখে তা হবে না। না হোক। জয়দীপ লাহিড়িকে জিজ্ঞেস করতে সে বলল, তাকে এক সম্পাদক-লেখক বলেছে, গল্প লিখতে গেলে আগে সেটি ভিসুয়ালাইজ করতে হবে। মানে চোখের সামনে দেখতে হবে। উরিঃ বাবা!
তবুও গদ্য লিখি।
তবুও তবুও… দিল মাঙে মোর…
*
একটি রাজকীয় মৃত্যু
___________________
রাজামশাই গতকাল রাত তিনটেয় মারা গেল।
ওর নাম যে সত্যিকারের রাজামশাইই ছিল তা না। যখন প্র্যাকটিশ করতাম সেই আমলে ওর সঙ্গে আলাপ। সাধুর মোড়ে যেখানে চার রাস্তা মিলেছে তারই এক কোণে গুটিশুটি বসে থাকত। ভিক্ষে যে চাইত, তা না। তবে দিলে অস্বীকারও করত না। এই রাজামশাই নামটা লোকটা নিজেই নিজেকে দিয়েছিল।
তখন আমার পসার বেশি ছিল না। জনান্তিকে বলি কোনওদিনই ছিল না। তাই হাতে প্রচুর উদ্বৃত্ত সময় থাকত। সাইকেল বাহন আমি দাঁড়িয়ে ওর সঙ্গে গল্প করতাম। ওর বাড়ি ছিল নাকি খড়দার দিকে। আসল নাম ছিল নাকি দিব্যসুন্দর। হ্যা হ্যা করে হাসত। একদিন খড়দাতেও দেখেছিলাম। বলরাম হাসপাতাল পেরিয়ে যে পোস্টাপিসের মোড়, সেখানে।
ওই যে, যেখানে একটা রাস্তা চলে গেছে লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দিরের দিকে আর অন্যটা নাথুরাম ঘাট শ্মশানের দিকে।
– ডাক্তার দ্যাখো এই তো আমায় দেখতে। আমি নাকি দিব্য সুন্দর! হাঃ!
– তবে তোমার নাম কী?
– নিজেই নিজের নাম রেখিচি বুইলে… রাজামশাই। আরে সেই যে এক রাজা মাঝরাতে বউয়ের মুখটা দেখে ছেলের কপালে চুমো খেয়ে ঘর ছেড়ে গেছিল না। তার মত তো হতে পাল্লুম না। কিন্তু তার মত বেরিয়ে তো আসতে পেরিচি, বলো!
পানকৌড়ি পানের দোকানের মালিক হেসে বলত
-ডাক্তার বাবুর দেখি পাগলটার সঙ্গে বেশ ভাব হয়ে গেছে।
-আরে না ভাব টাব না। ওরও কাজ নেই, আমারও… তাই একটু ইয়ে আর কী। তা হ্যাঁ হে সুব্রত, এর বাড়ির লোকজন একে ফিরিয়ে নিয়ে যায় না?
– নিতে চায়ই তো। এ মহা কামচোর, আর দারুণ পাগল টাইপেরও। বাড়ির লোক ট্রিটমেন্টেরও চেষ্টা করেছে। এ সেই সবে সাড়া দিলে তো ! আজ এখানে ভোম্বোলা মোড়ে, কাল হয় তো দেখবেন কেয়ার মোড়ে।
কোনও জীবিত মানুষের নামে যে মফসসলের ভৌগোলিক নাম হতে পারে তা এই সোদপুরেই দেখেছিলাম। কেয়া আসলে একটা মিষ্টির দোকানের নাম। মালিক মেয়ের নামে দোকানের নাম রেখেছে। সেই জলজ্যান্ত কেয়া নামের মেয়ে দোকানে দাঁড়িয়ে ক্যাশ বাক্স সামলায় বাপের। আর অবলীলায় ঢুকে গেছে পোস্টাপিসের ঠিকানায় আর গুগল ম্যাপেও।
ওই চত্বর ছেড়ে চলে এসেছি কবেই। কিন্তু সেই লোক আমাকে ছেড়ে যায়নি। মাঝে মধ্যে হানা দেয়। বেশির ভাগটাই ঘুমের মধ্যে। জেগে থাকার সময়েও কখনও কখনও।
সেই রাজামশাই বলে পাগলটা… নাকি ভিখিরিটা, সেই কবে থেকেই মোক্ষমভাবে আমার মাথার মধ্যে বাসা গেড়েছে।
এই কালিম্পঙয়ে গুহা বাসের সময়ও।
এক গাল হেসে ডাম্বার চকের ওখানে আমাকে জিজ্ঞেস করল,-ভালো আছো ডাক্তার?
দেখলাম বয়েসের ছাপ পড়েছে চেহারায়। আগের মতনই সাত নোংরা জামাকাপড়। গাল চুপসে গেছে। সামনের দাঁতগুলো ভাঙা ভাঙা। আগে বিড়ি খেত খুব। এখনও খায় কী না কে জানে।
-আরেঃ তুমি এখানে?
চোখ নাচিয়ে বলল – না এসে করি কী? বিদেশ বিভূঁই… একলা আছো।
– এখানেই থাকো আজকাল? এই পাহাড়ে?
– না ডাক্তার, শোনো বয়েস হচ্ছে তো। আমি দ্যাখো না… এই তো তোমাকে দেখেই জলপাইগুড়ি দৌড়ুবো।
– সে কী, ওখানে কী?
– আরে তোমায় বলাই হয় নি। ওখানে যে তোমার রাজামশাইয়ের এক রাজপুত্তুর জন্মেছে গো! সব্যসাচী নাম তার। তোমার মতই ডাক্তার সে। টিবি হয়েছিল আমার। তাই তার কাছে গেসলুম। সেই তো সারাল। রাজপুত্তুর বানিয়ে নিইচি তাকে? সেই তো বিড়ি খাওয়া ছাড়াল আমার। একটু দেখা হোক আজ।
চমকে উঠি। ধ্যাত, তাই আবার হয় নাকি? কোথায় কালিম্পং আর কোথায় জলপাইগুড়ি। বুঝতে পারি, আসলে আমার মাথার মধ্যের নির্জনতায় মগ্নচৈতন্যে হানা দিয়েছে মাথার মধ্যে বসে থাকা সেই রাজামশাই।
তবু তার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে গল্প জমাই।
-ওই একটাই রাজপুত্তুর?
-নাঃ তা কেন, এই তো জলপাইগুড়ি সেরেই আবার চলে যাব ভোম্বোলা মোড়ে সোদপুরে। সেখানে আর এক রাজপুত্তুর, এই করোনার বাজারেও দিন রাত এক করে লোক বাঁচিয়ে বেড়াচ্ছে। ও স্কুটারে হুস করে বেরিয়ে যাবে, আমার সঙ্গে এট্টু কথা সেরে নিয়েই। ওদিক পানে থাকলে ওকেই তো দ্যাকাই!
-কী নাম সেই ডাক্তারের? শুধোই তাকে
– ও তুমি চিনবে নাকো । নাম হল ইন… ইন…
– কী নাম, ইন্দ্র?
এক গাল হাসে রাজামশাই।
-অ্যাই দ্যাকো , মনে পড়েচে নাম এই রাজপুত্তুরের … ঐন্দ্রিল ডাক্তার।
ঠাট্টা করে বলি, রাজামশাই তাহলে তো সংসার বেশ জম্পেশই হয়েছে তোমার। জমে উঠেছে রাজ পরিবার। তা হ্যাঁ হে, আর কোনও রাজকন্যেটন্যে নেই ভাঁড়ারে?
এক চোখ ছোট করে হাসি দিয়ে কিছু লুকোয় রাজামশাই,- ইল্লি, তোমাকে বলব কেন সব কথা।
রাজামশাইকে বলি,-মাস্কটা ঠিকমত এঁটে নাও হে। থুতনির কাছে ঝুলঝুল করছে যে। অপ্রস্তুত মুখে নাকের ওপরে টেনে তোলে সে মাস্কটাকে।
কালিম্পংএর ডি এম অফিস এসে পড়েছে। রাকিব সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে হবে। মণিদা বার বার করে বলে দিয়েছেন। চড়াই ভাঙতে ভাঙতে দেখি নীচের রাস্তায় দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছে মুখোস পড়া রাজামশাই।
কালিম্পং থেকে শিলিগুড়ি নবীনের গাড়িতে। তিস্তা পাওয়ার প্রোজেক্টের বাঁকে চোখ জড়িয়ে আসছিল। মনে হল ভুটিয়া কম্বল গায়ে জড়িয়ে রাজা মশাই কে তিস্তা পারে দেখলাম এক ঝলক। শিলিগুড়ি থেকে ফিরোজের গাড়িতে বারাসত।
এখানে এসে আমার তো তেমন কাজ নেই। এখানে এখন তিনতলার ছাদে রাজামশাই সটান উঠে আসে। মুখে থুতু ছেটায়।
আমি চোখ পাকিয়ে বলি,- ত্রিভুবন পেরিয়ে এলে। হাত ধুয়েছ? তলায় স্যানিটাইজার রাখা আছে । নিয়েছ ওটা? আর হ্যাঁ, ওই কোণার দিকের ট্যাপে পাটাও ধুয়ে নাও ভালো করে।
এতো সব স্বাস্থ্যবিধি মানতে তার ভারি বয়েই গ্যাছে। ধুলোমাখা পা গুটিয়ে দোলনাটার ওপরে জম্পেশ করে বসে। আর শুরু করে তার অন্তহীন বকুনি।
আমি বলি, -কী হচ্ছে কী রাজামশাই। দেখছো না লিখছি!
সে ঠাট্টার গলায় বলে – ভারি তো লেখা। কেউ তো পোঁছেও না। মানে বোঝা যায় না আদ্দেকেরই, যা লেখো!
এত সব বলে, তার পরেই দ্যাখ না দ্যাখ, ঘাড়ের ওপর ঝুঁকে পড়ে গলা জড়িয়ে ধরে বলে,-একটা কথা বলব ডাক্তার, ওই যে ফেসবুক না কী যেন করো, শিকিয়ে দেবে আমায়?
নোংরা লোকটার গায়ের গন্ধে ভূত পালাবে যেন। তার ওপর ভাইরাসের ভয়। আমি সশঙ্ক বলি
-অ্যাইও কী হচ্ছে কী? যাও ওপাশে , সরে বোসো। সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং শোননি টিভিতে…বক্তৃতায়?
ফ্যাক ফ্যাক করে হেসে ও বলে, -ডাক্তার, সোশ্যাল না বলো ফিজিক্যাল।
বলে আবার ওর অন্তহীন কথার প্যাঁচে ফেলে আমার লেখালিখির অপচেষ্টার বারোটা বাজায়।
গতকাল এলো মাঝরাতে। আমি মশারির মধ্যে তখন। এসে আমার সঙ্গে কথা না বলে দেখি আমার মোবাইলটা হাতিয়ে নিয়ে বসেছে। আর ঝড়ের বেগে টাইপ করছে। মুখ দিয়ে উত্তেজনায় লালা গড়াচ্ছে। চোখ বড়বড়। ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছে। একবার যেন ফিসফিস করে বলে, কাজ শেষ। এবার তবে শান্তিতে যাওয়া যায়।
উত্তেজনায় আমারও ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম ভেঙে দেখি কোথায় কী। কেউ নেই। আমার সারা গা ভিজে গেছে ঘামে।
কেউ কোথাও নেই। ঘুমটা চটকে যায়। বারান্দায় যাই ঠাণ্ডা হবার জন্য। দেখি গেটের কাছে হাত পা ছেতড়ে পড়ে আছে রাজামশাই। উজ্জ্বল স্ট্রিট লাইটের আলোয় স্পষ্ট দেখি কয়েকটা নীল মাছি ওড়াউড়ি করছে হতভাগাটার ভাঙাচোরা মুখের ওপর।
বুঝতে পারি, আজ এতদিনে, পুত্রকন্যা সমেত উধাও হয়েছে হাড় জ্বালানো নোংরা লোকটা।
*
পড়া শেষ করে প্রথম পাঠক বলল, ছাইয়ের গদ্য লেখা হয়েছে।