মহামারী হঠাৎ আসে, সম্প্রতি আমফান যেমন বলে-কয়ে এলো তেমনি একটু সময় দিয়ে আসে না। এসে যখন পড়ে, তা জীবন নিয়ে খেলার পুতুলের মতো লোফালুফি করে। প্রাচীন কাল থেকেই দেখা গেছে এই অসহায় মুহূর্তে মানুষ আঁকড়ে ধরার একটা খড়কুটো খোঁজে। এই সুযোগেই পৃথিবীতে জন্ম নেন মহামারীর দেব দেবীরা।
ইতিহাস সাক্ষী। প্রাচীনকালে সবচেয়ে বেশি উল্লেখ পাওয়া যায় প্লেগ মহামারীর। ইয়ারসিনিয়া পেস্টিস জীবাণু তো এই সেদিনের আবিষ্কার। যুগে যুগে প্লেগ কত জনপদ নিশ্চিহ্ন করেছে তার লেখাজোকা নেই। দেবদেবীরা কিন্তু থেকে গেছেন। গ্রীকদের প্লেগ দেবীর নাম নসোই। তিনি প্যান্ডোরার বাক্স থেকে বেরিয়েছিলেন আর কুপিত হলে হামেশাই মনুষ্য সমাজে জীবাণু ছেড়ে দিতেন। নসোই দেবীকে রোমানরা ডাকত মর্বাস বা মর্বি নামে। ইনি দেব না দেবী তা নিয়ে কিঞ্চিত ধন্দ আছে কারণ ঝাপসা ধোঁয়ার মত তাঁর শরীর।
প্রাচীন মেসোপটেমিয়া সভ্যতায় প্লেগ ঠাকুর হলেন নার্গেল। তাঁকে কেউ বিশেষ পাত্তা দিত না বলে তিনি বোর হয়ে গিয়ে ব্যাবিলন শহরে প্লেগ ছড়ালেন। হিব্রু বাইবেলে নার্গেলের উল্লেখ আছে। ব্যাবিলনের প্রাচীন পোড়ামাটির রিলিফের কাজে দাড়িয়ালা নার্গেলের মূর্তি পাওয়া গেছে। নার্গেলের সঙ্গে প্লেগের বাহক ইঁদুর থাকত। ওল্ড টেস্টামেন্টে দশরকম প্লেগের উল্লেখ আছে। সুতরাং প্লেগের দেবদেবীও অগুনতি। চীনা লোককথায় হান বংশের আমল থেকে ওয়েন সেন বিরাজমান। তিনি রুষ্ট হলেই এই মহামারী ছড়ায়। এমনকি বৌদ্ধরাও পর্ণ শর্বরী নামে এক দেবীর পুজো করতেন প্লেগের হাত থেকে বাঁচতে। এত দেবদেবী মিলেও পৃথিবীতে চতুর্দশ শতকের কুখ্যাত “দ্য ব্ল্যাক ডেথ” আটকাতে পারেননি। 1894 সালে প্লেগ জীবাণু আর 1943 সালে স্ট্রেপটোমাইসিন আবিষ্কারের পর এনাদের মহিমা কিছুটা খর্ব হল।
1817 সালে প্রথম কলেরা মহামারী রূপে দুনিয়াতে এল । তারপর বার বার । বঙ্গভূমিও বাদ যায় নি । 1894 সালে রোগের জীবাণু ভিব্রিও কলেরি আবিষ্কারের আগেই আবির্ভূত হলেন ওলা দেবী বা ওলাইচন্ডী । হলুদ বর্ণ, নীল শাড়ি, কোলে শিশু , গা ভরা গয়না । মুসলমান সম্প্রদায়ের কাছে ইনি ওলাবিবি–মাথায় স্কার্ফ টুপি , পায়ে নাগরা , হাতে লাঠি । বেশ জমকালো রূপ –যাতে লোকের মনে এই দেবীর শক্তি ও মাহাত্ম্য সম্পর্কে একটা বিশ্বাস জন্মে । যদিও ওলাদেবীকে ময়দানবের স্ত্রী বলা হয়, ইনি অসাম্প্রদায়িক দেবতা -হিন্দু মুসলমান উভয়েই এই দেবীর পুজো করতেন । 1971 সালে বাংলাদেশে কলেরা মহামারীতে ডাঃ দিলীপ মহলানবীশ ওআরএস (ওরাল রিহাইড্রেশন থেরাপি)র সাফল্য প্রমাণ করলেন , তারপর ডাঃ সরকার মণিপুরের কলেরা মহামারীতে ওআরএস ব্যবহারে শতকরা আশিভাগ সাফল্য পেলেন । বর্তমানে হাতের নাগালে অনেক অ্যান্টিবায়োটিক । মানুষের কলেরা ভীতি যে কোনো ওলাবিবির হাত ধরে দূর হয়নি তা দেরীতে হলেও , মানুষ বুঝেছে ।
1979 সালের আগে আর এক ভয়ের অসুখ ছিল গুটি বসন্ত । প্রতিবছর পৃথিবীর শতকরা দশভাগ মৃত্যুর কারণ ছিল এই স্মল পক্স । 1796 সালে জেনার সাহেব টিকা আবিষ্কারও করে ফেলেছেন কিন্তু কোন দেবী রুষ্ট না হলে কি আর এমনি এমনি মহামারী হয় ? বাংলায় শীতলাদেবী প্রাচীন কাল থেকে আজও পুজো পান । দেবী গাধা পৃষ্ঠে বিরাজমান, মাথায় মুকুট, লাল শাড়ি, একহাতে কলসী আর এক হাতে ঝাড়ু ।
চীন দেশে স্মল পক্সের দেবতা তাউ সেন নিয়াং নিয়াং । সবচেয়ে ভয়ঙ্কর চেহারার গুটি বসন্তের দেবতা মূর্তি পুজো প্রচলিত ছিল নাইজেরিয়ায় জরুবা অঞ্চলে । তার
নাম সপোনা । বাঁদরের খুলি, হাড় দিয়ে তৈরী তার দেহ , গায়ে নানারঙের ছোপ । 1979 সালে গুটি বসন্ত পৃথিবী থেকে নির্মূল হবার পর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার যাদুঘরে রাখা আছে এক সপোনা মূর্তি । তা –এসব গল্প তো আধুনিক বিজ্ঞান পূর্ববর্তী যুগের ।
তবু আজও জল বসন্ত হলেও লোকের মুখে হামেশাই শোনা যায়– “মায়ের দয়া” হয়েছে । মানুষ যেখানে শান্তির আশ্রয় খোঁজেন সেই “ঈশ্বর” আর মহামারীর দেবদেবীর মধ্যে এক বিস্তর পার্থক্য আছে
। মানুষের লোকায়ত বিশ্বাস , সমাজে বহমান ধারনা , আচার আচরণ , ভৌগোলিক অবস্থান সব মিলিয়ে সেই অঞ্চলের “ঈশ্বর ” প্যারাডাইম নির্মিত হয় যুগযুগান্ত ধরে । এই “ঈশ্বর” কনসেপ্টকে মঙ্গলময় ভাবা হয়, যিনি কারো অনিষ্টের কথা কদাচ ভাবেন না । লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, মহামারীর দেবদেবীরা ঠিক বিপরীত–সদা রুষ্ট হয়েই থাকেন আর তাকে তুষ্ট না করলেই অসুখ ছড়িয়ে দেন পৃথিবীতে । শান্তি নয় –কষ্ট, অসুখ, অশান্তি ছড়ানোই এদের কাজ । মহামারীর ক্রাইসিসের সময়ে, মানুষের অসহায় মন দ্বারা
এনারা অকস্মাৎ নির্মিত হন । পুজো পান ভক্তিতে নয় –ভয়ে ! পৃথিবীতে দেবদেবীর এজেন্ট–মন্দির , পুরোহিত-তাঁরা মানুষের অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে, অসুখের ব্যাপারে নানাভাবে সমাজকে ভীতসন্ত্রস্ত রাখতেন আর নিজেদের ট্যাঁক ভারী করতেন ।
প্রাকবিজ্ঞান যুগে যখন রোগের কারণটা সঠিক জানা যাচ্ছে না, চতুর্দিকে ছড়িয়ে থাকা মৃত্যুজাল কেটে বেরোনোর কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছে না মানুষ–সে সময়ের কথা না হয় বোঝা গেল । কিন্তু আজকের দিনে কোভিড করোনা অতিমারীর সময়ে যা ঘটল–বিজ্ঞানের সতর্কতা নস্যাৎ করে কোনো দূরত্ব বজায় না রেখে , মাস্ক না পরে দলে দলে মহিলা করোনা পুজো করলেন ! পুজো করলেন কলকাতা ময়দানে, দুর্গাপুরে, আসানসোলে, আরো কোথায় কোথায় কে জানে । বিপদসীমা লঙ্ঘন করেই । করোনা ভাইরাস খালি চোখে অদৃশ্য , কিন্তু তার দেহের জিনের সম্পূর্ণ গঠন , তার চরিত্র,সংক্রমণ পদ্ধতি সব আজ বিজ্ঞানের জানা । গত তিন মাস প্রায় পৃথিবীর সব ধর্মস্থান বন্ধ ছিল–রোগমুক্তির আশ্বাস কোনো ধর্ম দিতে পারেনি সেটাও কারো অজানা নেই । বিজ্ঞানের সেই আবিষ্কারকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে , পুজোর মাধ্যমে করোনা ভাইরাসকে নাকি মাটি খুঁড়ে পুঁতে দেওয়া হল । এই ঘটনাকে যদি এখন সামান্য ঘটনা, অশিক্ষিত কে কি করেছে –এসব বলে লঘু করে দেখা হয় –সামনে বড় বিপদ অপেক্ষা করছে । কোনো বৈজ্ঞানিক বিধিনিষেধকে মান্যতা না দিয়ে , অদূর ভবিষ্যতে সমাজ নতুন দেবীর সৃষ্টি করবে, করোনাদেবীর মন্দির নির্মাণে হাত লাগাবে, চাঁদা তুলবে , বাধা পেলে হয়তো দাঙ্গাও বাঁধাবে । এত বছর বিজ্ঞান সাধনার ফল কি এই ? এত যুদ্ধাস্ত্র ,এত মহাকাশ গবেষণা , এত বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান তাহলে সাধারণ জনমানসে “শূন্য ” হয়েই রইল ! হাজার বছরেও কোনো প্যারাডাইম শিফট ঘটল না !!
A very interesting article on human beliefs which may be interpreted as superstition. Rightly said that even if science has reached its peak, the common people are yet to be scientifically educated to do away with superstition. So man depends more on superstition rather than on science in his helplessness. True, its science that comes for rescue but man can’t do away with his age old superstition even it poses a danger for human life