একজন ডাক্তারি ছাত্রের জীবন থেকে নেওয়া….
বিকেলবেলায় হস্টেলে খেতে এসে তোমার বিয়ের চিঠিটা হাতে পেলাম। আজকাল স্পীডপোস্টের কি ছিরি! দশদিন আগে পোস্ট করা চিঠি বেছে বেছে এসে পৌঁছালো ঠিক বিয়ের দিনই, তাও খাস কলকাতার মত শহরে! তোমার বিয়েতে না যাওয়ার এটাই একটা অজুহাত দেখাতে পারতাম, কিন্তু মিথ্যা বলব না। যেদিন খবরটি কানে এসেছিল সেদিনই মনস্থির করেছিলাম কোনদিন তোমার মুখদর্শন করব না।
আজ অন্য পেশায় থাকলে নিজেকে শেষ করে দেওয়ার ইচ্ছেটা হয়তো অবদমিত করতে পারতাম না। ফার্মাকোলজি পড়ে এটুকু বুঝেছি যে এমন কিছু ড্রাগ আছে যা বেশিমাত্রায় নিলে আধঘন্টার মধ্যে যন্ত্রণাহীন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া যায়। টক্সিকোলজিতে তো প্রত্যেকটা পয়জনের ফ্যাটাল ডোজ লেখা আছে। একবার চোখ ঝালিয়ে নিলেই হল। কিন্তু আমি পারব না। আমি ওষুধ দিয়ে শুধু জীবন বাঁচাতেই শিখেছি, জীবনকে শেষ করে দিতে নয়।
আমার কথা না শুনে ভালোই করেছো। আহামরি কী এমন হতো আরও দুটো বছর আমার জন্য অপেক্ষা করলে? আমার এম.ডি. ডিগ্রিটাই শুধু কমপ্লিট হতো। নরওয়ের বিলাসবহুল হোটেলে অরোরা বোরেয়ালিসের আলো-আঁধারিতে তোমার মধুচন্দ্রিমাযাপনের স্বপ্নকে ফুলফিল করতে পারতাম কি? আমার দৌড় তো চিরকাল সেই ধ্যাড়ধেড়ে বসন্ত-কেবিন অবধিই।
হস্টেলের দরজায় কেউ নক্ করছে; গাইনির কলবুক বোধহয়। দাঁড়াও, দেখে আসি। আমার অ্যান্টিসিপেশনটা একশোভাগ মিলে গেল। লেবাররুমের মাসি কলবুক হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। একজন এক্ল্যাম্পসিয়া পেশেন্ট ভর্তি হয়েছে, লেবারে আছে। আমি আর দু’লাইন লিখেই শেষ করব। কারণ, এক্ষুণি আমায় লেবাররুমে ছুটতে হবে। মা আর শিশু, দু-দুখানা জীবন বাঁচানোর চ্যালেঞ্জ আমার সামনে। যাক একদিক দিয়ে ভালোই হল, তোমায় অন্ততঃ কিছুক্ষণের জন্য ভুলে থাকতে পারবো….
ভেবেছিলাম চিঠিটা আর শেষ করব না, ছিঁড়ে ফেলে দেব। কিন্তু পারলাম না। সাতদিন বাদে যখন দেখলাম সেই মা সীজারের সেলাই কাটিয়ে পরমস্নেহে তার শিশুকে কোলে নিয়ে হাসপাতাল থেকে বাড়ী ফিরে যাচ্ছেন তখনই ঠিক করলাম চিঠিটার একটা উপসংহার লিখতে হবে।
আজ আমি ঠিক কতটা খুশি তোমায় তা বলে বোঝাতে পারবো না। তুমি এখন নতুন সংসারে পা দিয়ে হয়তো অরোরা-র মায়াবী আলোয় জীবনসঙ্গীর হাত ধরে নরওয়ের তটভূমি দিয়ে হেঁটে চলেছো। আর আমি দাঁড়িয়ে আছি হাসপাতালের গেটে। নিমেষে ভুলে গেলাম তোমাকে না পাওয়ার যন্ত্রণা। বারবার মনে হতে লাগল জীবন শুধু হারতেই শেখায় না, জিততেও শেখায়।
সন্ধ্যা হয়ে এলো। হস্টেলে ফিরে যাওয়ার পথে দোতলার সিঁড়িতে হঠাৎ লোডশেডিং। অন্ধকারে পথ হাতড়ে বাকি সিঁড়িটা উঠলাম। কোনমতে তালা খুলে ঘরে ঢুকতেই দেখি অদ্ভুত এক অপার্থিব আলোয় ঘরটা ভরে গেছে। আর সেই আলোর উৎসবিন্দুতে শিশুকোলে মা মেরীর মত দাঁড়িয়ে আছেন সেদিনের ক্রমাগত খিঁচুনি হওয়া মহিলাটি। এ কি অরোরা না অন্যকিছু! স্বপ্ন না সত্যি! আবেশে চোখ দুটো বন্ধ হয়ে এলো….