সারাজীবনে কতো মানুষের সাথে পরিচয় হয়- বন্ধুত্ব হয়। খুব অল্প জনই থেকে যায় বাকি জীবনের জন্য। একসময় যাকে ছাড়া এমুহূর্তও চলবে না মনে হয়, তাকে ছাড়াও দিন কেটে যায়। মেলট্রেনের মতো বিপরীত দিক থেকে আসা দুটি মানুষ যতো তাড়াতাড়ি কাছে আসে, ঠিক ততটা তাড়াতাড়িই দূরে চলে যায়। কিন্তু সত্যিই কী দূরে চলে যায়, নাকি পরস্পরের দেখা হওয়া সে মুহূর্তটি চিরকালের মতো স্থির হয়ে থাকে। যেন সেই মুহূর্তটুকুই সত্যি, তার আগে পিছে বাকি সব মিথ্যে।
আমি খুপরিজীবী চিকিৎসক। এসব জটিল বিষয় নিয়ে আমায় চিন্তা করতে নেই। জ্বর জারি, গ্যাস অম্বল, ঘা প্যাঁচরা, সুগার প্রেশার এসব নিয়ে দিব্যি আছি। ভোর থেকে রোগী দেখি। আর রাতে যেটুকু সময় পাই বড় মেয়েকে অঙ্ক করাই। দুজনের চোখই ঘুমে ঢুলে আসে। মাঝে মাঝে মেয়ে আমাকে কলমের খোঁচা দেয়, ‘বাবা, তুমি যে ঘুমিয়ে পড়লে…’। মাঝে মাঝে আমি মেয়েকে খোঁচা দি। বইয়ের পৃষ্ঠার অংকগুলো আমাদের খোঁচাখুঁচি দেখে হাসাহাসি করে।
আজও যথারীতি বাড়ির খুপরিতে দিনগত পাপক্ষয় করছিলাম। পাপক্ষয়ই বটে। কাউকে সুস্থ করা আমার কম্ম নয়। প্রায় কেউই কথা শোনেন না। যাকে বারবার সামান্য একটা রক্ত পরীক্ষা করতে বলা হয়েছিল, তিনি কিছুই করে আনেননি। আর যাকে কিছু করতে বলা হয়নি, তিনি গুচ্ছের পরীক্ষা করে এনেছেন। কেন করেছেন জিজ্ঞেস করায় বললেন, ডাক্তারবাবু, হেব্বি ছাড় দিচ্ছিল। মাত্র ৯৯৯ টাকায় সব পরীক্ষা হয়ে গেল। একটু যদি দেখে দেন। অগত্যা আমি রোগী না দেখে রিপোর্ট দেখি। রোগীর চিকিৎসা করতে গিয়ে হামেশাই রিপোর্টের চিকিৎসা করি।
হাঁপানি রোগীর মুখ থেকে বিড়ির গন্ধ পাই। ডায়াবেটিসের রোগী বিজ্ঞাপন দেখে ওষুধ বন্ধ করে আয়ুর্বেদিক ওষুধ খান। ক্রনিক প্যানক্রিয়াটাইটিস রোগী মদ খেয়ে বমি করতে করতে আসেন। দুহাত ধরে বলেন, ব্যথাটা এবারের মতো কমিয়ে দেন ডাক্তারবাবু। আপনাকে ছুঁয়ে বলছি আর মদ খাবো না। আমি প্রথমদিকে উৎসাহ নিয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করি। তারপর বেলা যতো গড়ায়, তত উৎসাহ কমে। মনে হয় কখন এই যন্ত্রণার শেষ হবে।
চেম্বারের শেষদিকে এক মহিলা এসেছেন। শীর্ণ অ্যানিমিক চেহারা। বোঝা মুশকিল বয়স ঠিক কতো। ২৫ থেকে ৪৫এর মধ্যে যা কিছু একটা হতে পারে। এধরণের রোগীদের শারীরিক সমস্যা আর সেগুলোর চিকিৎসা মোটামুটি একই রকম। ঘুম হয়না, খিদে হয়না, মাথা ঘোরে, দুর্বল লাগে, হাত পায়ে ঝিন ঝিন করে ইত্যাদি। মুল অসুখটা আসলে মানসিক অবসাদ। সংসারের যাঁতাকলে পিষে এঁদের জীবনের প্রায় সবটুকুই আনন্দ বিদায় নিয়েছে।
এই মহিলাকে দেখে অবশ্য একটু অন্যরকম লাগল। তাঁর শাড়ি পরার ধরণ, সাজ সজ্জা, ঠোঁটের গাঢ় লিপস্টিক দেখে মনে হচ্ছিল ইনি পুরোপুরি অন্যদের মতো নন। মুখ খুলতেই বুঝলাম আমার অনুমান ঠিক। ভাঙা ভাঙা বাংলা শুনলেই বোঝা যায় ইনি জন্মসূত্রে বাঙালী নন। যদিও পদবী বলেছেন মণ্ডল।
বাঙালি না অবাঙালি জেনে আমার কোনো লাভ নেই। কারণ ওনার রোগের বিবরণ আর পাঁচজন নিম্নবিত্ত বাঙালি মেয়েদের মতো। অতএব চিকিৎসাও এক। চোখের পাতা টেনে দেখলাম, ফ্যাকাসে। অথচ চোখে মোটা করে কাজল পরেছেন।
মহিলা বললেন, কী হয়েছে? খারাপ কোনো অসুখ হয়নি তো?
আমি বললাম, চোখে কাজল পরে কী হবে, ভেতরের পাতা তো কাগজের মতো সাদা। আপনার পা এতো ফুললো কী করে?
মহিলা হেসে বললেন, সারাদিন মেশিন করি। হয়তো সে জন্যই।
আমি বললাম, কারেন্টের মেশিন না পা দিয়ে চালানো সেলাই কল।
মহিলা এতো দুঃখ দুর্দশার মধ্যেও হাসি ভুলে যাননি। আবার হেসে বললেন, কারেন্টের মেশিন কেনার পয়সা কোথায় পাব?
বললাম, তাহলে একটু কম মেশিন করুন।
কম করলে সংসার চলবে কী করে? চারটে পেট। আমি একা রোজগার করি।
আর আপনার স্বামী? উনি কী কাজ করেন?
মহিলার মুখ ম্লান হয়ে গেল। বললেন, উনি নেই।
থতমত খেয়ে বললাম, দুঃখিত, কিছু মনে করবেন না। আমি বুঝতে পারিনি।
মহিলা আবার হাসলেন। বললেন, আপনি এখনও বুঝতে পারেন নি। আমার স্বামী মারা যান নি। উনি বহাল তবিয়তেই বেঁচে আছেন। কিন্তু উনি আমার সঙ্গে থাকেন না।
তাহলে?
তাহলে আর কী? আপনার এসব জেনে কী লাভ? ওষুধপত্র লিখে দেন। গায়ে যাতে একটু জোর হয়। একটা স্কুলের ইউনিফর্মের কাজ পেয়েছি। তিনদিনের মধ্যে ডেলিভারি দিতে হবে। রোজ ষোলো সাতেরো ঘণ্টা মেশিন না করলে হবে না।
বললাম, আপনার বাড়িতে আর কে কে আছেন?
বয়স্ক শ্বশুর স্ট্রোক হয়ে বিছানায় পড়ে আছেন। আর শাশুড়ি, তিনি হাঁপানির রোগী। মেয়ে আছে পাঁচ বছরের। শাশুড়ি মেয়েটাকে সামলাতেই হিমসিম খান।
আর আপনার স্বামী?
মহিলার মুখের হাসি আবার মিলিয়ে গেল। বললেন, আশ্চর্য, আমি কী করে জানব সে কোথায় আছে? গত চার বছরে সে আমাদের সাথে কোনো যোগাযোগ করে নি। একটা পয়সাও পাঠায় নি। লকডাউনের সময়ও খোঁজ নেয়নি কি করে চলছে। তবে জানতে পেরেছি, বেঁচে আছে। আবার বিয়ে করেছে। আমি কী আমার কাজ কর্ম ফেলে রেখে তাকে খুঁজতে বের হবো?
আপনার বাপের বাড়ি কোথায়?
বিহারের পূর্ণিয়ায়।
সেখানে কেউ নেই?
হ্যাঁ, সবাই আছেন। বাবা মা, দাদা বৌদি।
তাহলে সেখানে চলে যাচ্ছেন না কেন?
মহিলা বললেন, যেতে তো ইচ্ছে করে, কিন্তু ওই দুজন বুড়ো বুড়িকে ফেলে কী করে চলে যাব? ও যতো সহজে সম্পর্ক অস্বীকার করতে পারে, আমি তো পারিনা। হয়তো যখন দুজন থাকবেন না, তখন চলে যাব।
চেম্বার শেষ হওয়ার পরও মনটা খারাপ লাগছিল। কেউ কেউ সম্পর্কের বড্ড বেশি মূল্য দেয়। অলীক বন্ধুত্বকে সারাজীবন আঁকড়ে ধরে থাকে। নাকি সেই বন্ধুত্ব আদৌ অলীক নয়। দুটি মেলট্রেনের পরস্পরকে অতিক্রম করার মুহূর্তটুকুই সত্য। তার আগে পিছে বাকি সব অলীক।