সংক্ষিপ্ত প্রেক্ষিত: ইসলামী মৌলবাদী কর্তৃক অবিভক্ত পূর্ববঙ্গ, পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্তান, পরবর্তীতে বাংলাদেশে হিন্দু এবং বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, জনজাতি, আহমদিয়া, বাউলদের উপর আক্রমণ, অত্যাচার, নারী নির্যাতন ও ধর্ষণ, নারী অপহরণ, মন্দির বিগ্রহ অপবিত্রকরণ ও ধ্বংস, বলপূর্বক ধর্ম পরিবর্তন, সম্পত্তি দখল, উচ্ছেদ ও বিতাড়ন নতুন কিছু নয়। গত শতাব্দীর ২০ – র দশক থেকে ব্রিটিশ পৃষ্ঠপোষকতায় এবং নবধনী পাট ব্যবসায়ী, মুসলমান রাজা জমিদার ও মুসলিম লীগ এর প্ররোচনায় এটি বাড়তে থাকে যা চূড়ান্ত রূপ নেয় ১৯৪২ এর পর ‘ লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান ‘ এর পর্বে যার পরিণতি নোয়াখালী থেকে কলকাতা একের পর এক গণহত্যা ও গণধর্ষণের রক্তস্নান এবং ১৯৪৬ এর দেশ ভাগ।
পাকিস্তানের দুঃস্বপ্ন: বাঙালি হিন্দুদের মূলত উচ্চবর্ণের শিক্ষিত প্রতিষ্ঠিত জমিদার, ব্যবসায়ী, উকিল, মাষ্টার, চাকরিজীবীদের একটি অংশ দেশভাগের আগে এবং আরেকটি অংশ দেশভাগের সময় উদ্বাস্তু হিসাবে প্রধানত পশ্চিমবঙ্গে ও কলকাতায় চলে আসেন। পূর্ব পাকিস্তানে থেকে যান মূলতঃ গরীব ভাগ চাষী, কৃষি মজুর নমঃশূদ্র, রাজবংশী, কৈবর্ত, কাপালি প্রভৃতি দলিত এবং সাঁওতাল, হাজং, চাকমা প্রমুখ জনজাতি সম্প্রদায়। যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, কলিম শরাফী, মণি সিংহ, সনজীদা খাতুনদের স্বপ্ন ক্রমশ বিভীষিকায় পরিণত হয়।
ওখানকার হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের উপর চলতে থাকে ইসলামি মৌলবাদী এবং পাক সামরিক শাসনতন্ত্রীদের অমানুষিক অত্যাচার। এর ফলে একাংশ মুসলিম ধর্ম গ্রহণ করেন, একাংশ কোনরকমে প্রাণ নিয়ে ভারতে পালিয়ে এসে অবৈধ নাগরিক হিসাবে মানবেতর জীবন যাপন করতে থাকেন। যাঁরা সেটি পারেন না তাঁরা মুখ বুঝে এই অত্যাচার সহ্য করে থেকে যান। এদের উপর সবচাইতে ভয়াল আক্রমণ নেমে আসে ১৯৭১ এর বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধের সময়। পাক সেনা, রাজাকার, আল বদর, জামাতের সন্ত্রাসী অপরাধীরা বীভৎস অত্যাচার চালায়। প্রায় ৩০ লক্ষ মানুষকে গণহত্যা এবং প্রায় চার লক্ষ নারীকে গণধর্ষণ করা হয় যাঁদের প্রায় পুরোটাই হিন্দু। প্রায় দেড় কোটি মানুষ শরণার্থী হয়ে ভারতে চলে আসেন।
সমাজতন্ত্রী ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের জন্ম: ভারতের তদানিন্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে ভারতীয় সেনা বাহিনীর সহযোগিতায় মুক্তি যুদ্ধের সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ে উঠে। কিন্তু মাত্র চার বছরের মাথায় ১৯৭৫ এ তার পুরোধা মুজিবর রহমানকে হত্যা আবার পাকিস্তানপন্থী ইসলামি মৌলবাদী রাজাকার জামাত অশুভ শক্তিকে শক্তিশালী করে তোলে ও রাষ্ট্র ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনে। তারপর গত ৫০ বছর ধরে পরিকল্পিতভাবে চলছে হিন্দুদের উপর আক্রমণ ও হিন্দু সম্পত্তি দখল। যার ফল হিন্দুদের ধর্মান্তর, ভারতে নিষ্ক্রমণ। এই এথনিক ক্লিন্সিং এর ফলে বাংলাদেশে হিন্দুদের সংখ্যা অনেক কমে যায়। যদিও মুজিব কন্যা আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা তাঁর দীর্ঘ শাসনে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দেওয়ার চেষ্টা করেন।
সাম্প্রতিক তালিবানি বিপ্লব: এটি ঠিকই হাসিনার শাসনে বাংলাদেশের অর্থনীতি এবং বিভিন্ন উন্নয়ন সূচকের যথেষ্ট অগ্রগতি হলেও তাঁর শাসনের শেষ দিকে স্বৈরাচার, স্বজনপোষণ, এক শ্রেণীর দুর্নীতিগ্রস্ত অতি ধনীর লুঠপাট, বৈষম্য জনমানসে প্রবল অসন্তোষ সৃষ্টি করে। হাসিনার আত্মপ্রত্যয় মার্কিন, চিন, ব্রিটেন প্রভৃতি বৃহৎ শক্তিকে চটিয়েও দেয়।
এই সুযোগে ছাত্র আন্দোলনকে সামনে রেখে যুদ্ধবাজ বাইডেন সরকারের সিআইএ, পাকিস্তানের আইএসআই সমস্ত ইসলামি মৌলবাদী ও সন্ত্রাসী শক্তি এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে একত্রিত করে গত ৫ আগস্ট হাসিনাকে গদীচ্যুত করে। তারপর থেকে শুরু হয় বাংলাদেশ জুড়ে নৈরাজ্য, তালিবানি তাণ্ডব এবং আওয়ামী লীগ, হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের উপর বিএনপি, জামাত, হেফাজতে ইসলাম, ছাত্র শিবির, জেএমবি, হরকত উল আনসার ইত্যাদি ইসলামি ও সন্ত্রাসী দল ও সংগঠন গুলির নেতৃত্বে মার্কিন ও পাকিস্তানের কাঠ পুতুল তত্ত্বাবধায়ক ইউনুস সরকার ও বাংলাদেশ সেনার প্রশ্রয়ে লাগাতার হামলা।
নীরব কেন্দ্র সরকার, নীরব রাজ্য সরকার: হিন্দুত্বের পরাকাষ্ঠা মোদি সরকার বাংলাদেশ বিষয়ে শুধু চূড়ান্তভাবে গোয়েন্দা ও কূটনৈতিক ব্যর্থই নয় মনিপুরের মত নিশ্চুপ। পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ৩৫% ছাকা মুসলিম ভোটের উপর নির্ভরশীল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর তৃণমুলও নিশ্চুপ।
নিশ্চুপ পশ্চিমবঙ্গে নিজেদের শুধু প্রান্তিক নয় হাস্যকর করে তোলা বাম, অতি বাম, আসল বাম, খাঁটি বাম, সেকুলর, পোগোতিশীল বিদ্দ্বজনরা যাঁরা তাঁদের আত্মকেন্দ্রিক সুবিধাবাদী রাজনৈতিক লাইন, নির্বাচিত প্রতিবাদ (Selective Protest), ভেদ্শক্তিহীন দায়সারা আন্দোলন এবং শাসকদের কাছ থেকে কিছু সুবিধা নিয়ে তাঁদের স্তাবকে পরিণত হওয়ার জন্য ইতিমধ্যে খ্যাতি অর্জন করে ফেলেছেন।
কিছু প্রতিরোধ: এই দুর্দিনে বাংলাদেশের যাঁরা বাম, প্রগতিশীল, সেকুলর বলে দাবি করা দল, সংস্থা ও ব্যক্তিদের প্রতিবাদ করা উচিত ছিল। তাদের একাংশ হয় তালিবানিদের হাতে নিহত অথবা তালিবানি সরকারের হাতে বন্দী অথবা পলাতক। অন্য অংশটা তালিবানিদের দলে ভিড়েছে।
মধ্য ও দক্ষিণ লাতিন আমেরিকার দেশগুলিতে যেমন র্যাডিকাল চার্চ নিপীড়িতদের পাশে দাঁড়ায় সেইরকম প্রায় দেড় কোটি বাংলাদেশী সংখ্যালঘুর হয়ে মাঠে নেমেছেন শ্রী চিন্ময় এর মত সংখ্যালঘু ধর্মীয় নেতারা যাঁরা লাখো লাখো সংখ্যালঘু মানুষদের সরকার, সেনা ও ইসলামি মৌলবাদীদের ভয়ঙ্কর অত্যাচারের মধ্যেও গণ আন্দোলনে সামিল করছেন, নিজেরা গ্রেফতার বরণ করে নির্যাতিত হচ্ছেন।
অদ্ভুত পরিহাস এই রাজ্যেও প্রতিবেশী রাষ্ট্রে এত বড় ঘটনার পরেও যেখানে তৃণমূল, সিপিএম, কংগ্রেস, বুদ্ধিজীবী, এসইউসি, নকশাল প্রমুখেরা নির্বিকল্প সমাধিতে তখন প্রতিবাদ অন্দোলনের ধ্বজা তুলে নিয়েছেন বিজেপির শুভেন্দু অধিকারী।
২৭.১১.২০২৪