বিভিন্ন অভিধান ঘেটে দেখলাম বিপ্লব ও বিপ্লবী সম্পর্কে সাধারণভাবে যেটা বলা হয়েছে তা হল বড় ধরনের সামাজিক বা অন্য কোন পরিবর্তন ও পরিবর্তনকারী (বা করতে সচেষ্ট)। বিপ্লবীদের আমরা খুব সম্মান করি। বাসুদেব বলবন্ত ফারকে, বাঘা যতীন, রাসবিহারী বসু, সূর্য সেন, ভগৎ সিং প্রমুখের নাম শুনলে আমাদের মাথা নত হয়ে যায়। আমার ক্ষুদ্র জীবনে কিছু বিপ্লবীর সান্নিধ্য পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে করি। এক্ষুনি যাঁদের নাম মনে পড়ল: কাজী নজরুল ইসলাম, গণেশ ঘোষ, বীণা দাস, কমলা দাসগুপ্ত, ইলা মিত্র, তেভাগার রাঙা ডাক্তার পূর্ণেন্দু ঘোষ, নাগভূষণ পট্টনায়ক, খোকন মজুমদার, নেমু সিংহ, মহেশ্বর …। যত বয়স বাড়ছে নির্দিষ্ট মতবাদ সম্পন্ন (Indoctrinated) বিপ্লবীদের থেকে মানুষের কাজে যারা বেশি লাগছেন সেই বিপ্লবীদের বেশি ভালো লাগছে। যেমন বিহারের গয়া জেলার দশরথ মাঝি যিনি একাই একটা ছেনি নিয়ে পাহাড় কেটে প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষের জন্যে রাস্তা তৈরি করেছেন কিংবা অসমের যোরহাটের যাদব পায়েং যিনি একাই ব্রহ্মপুত্রের বুকে এক চরে একটি গভীর অরণ্য গড়ে তুলেছেন। অতীতে ডাঃ উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী যিনি কালান্তক কালাজ্বরের ওষুধ আবিষ্কার করেছিলেন। সেরকম কয়েকজন বিপ্লবী সম্প্রতি গত হলেন। অধ্যাপক ডাঃ দিলীপ মহালনববিশ যিনি বাংলাদেশ যুদ্ধের সময় উদ্বাস্তু শিবিরে কলেরা মহামারীতে ‘ ওরাল রিহাইড্রেশন সলিউশন(ORS)’ প্রয়োগ করে লক্ষ লক্ষ বাঙালি উদ্বাস্তু কে বাঁচিয়েছেন। অথবা, ফাদার স্টান স্বামী যিনি সারাটা জীবন গরীব প্রান্তিক দলিত আদিবাসীদের অধিকার অর্জনের লড়াই চালিয়ে শহীদ হন। ……….
বিহারের বৈশালীর সন্তান বিন্দেশ্বর পাঠক (১৯৪৩ – ২০২৩) পাটনা ও এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি ও সমাজতত্বে স্নাতকোত্তর করে গান্ধীবাদী ‘ভাঙ্গি মুক্তি আন্দোলনে ‘ যুক্ত হন ১৯৬৮ নাগাদ। দলিত ভাঙ্গি সম্প্রদায়ের মানুষের মলমূত্র মাথায় নেওয়া ও হাত দিয়ে পরিষ্কার করার (Manual Scavenging) পদ্ধতির বিরোধিতা করেন এবং গবেষণার কাজে সারা ভারত ঘুরে বেড়ান।
এর পর তিনি এই মেথর সম্প্রদায়কে সংগঠিত করে ১৯৭০ এ ‘সুলভ ইন্টারন্যাশনাল ‘ নামে একটি সমাজ কল্যাণ সংস্থা গড়ে তোলেন যার বর্তমান সদস্য সংখ্যা ৫০ হাজারের বেশি। তাঁর কাজ ও গবেষণার দিশা ছিল: (১) হাত দিয়ে মলমুত্র সাফাই (Manual Scavenging) থেকে মুক্তি দিয়ে মেথর বা বাল্মিকী সম্প্রদায়কে আধুনিক যান্ত্রিক বর্জ্য সাফাই ব্যবস্থায় (Mechanized Scavenging System) এনে তাদের কর্মসংস্থানের এবং তাদের শিক্ষা ও উন্নয়নের ব্যবস্থা করা। (২) মলমূত্র সহ মানুষের বর্জ্য (Human Excreta) স্বাস্থ্য বিধি ও পরিবেশবান্ধবভাবে প্রকৃতিতে সংস্থাপন এবং (৩) জনপরিসরে (Public Places) ভদ্রসভ্য ও সম্মানজনক ভাবে এবং স্বাস্থ্য বিধি মেনে প্রাকৃতিক কাজ সম্পন্ন করার সুযোগ ও ব্যবস্থা করা। তাঁর গবেষণালব্ধ ‘ টু পিট পোর ফ্ল্যাশ উইদাউট স্ক্যাভেনজিং টয়লেট ‘ সারা বিশ্বে জনপ্রিয় হয় এবং তাদের শৌচাগার রূপান্তরিত প্ল্যান্টের স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকরণজাত বর্জ্য থেকে নির্গত দুর্গন্ধহীন বায়ো-গ্যাস এবং ফসফরাস সহ অন্যান্য জৈবযুক্ত পরিষ্কার জল শক্তি ও সার উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়ে সর্বত্র সমাদৃত হয়।
এর পর তিনি ‘ পে অ্যান্ড ইউজ ‘ ‘সুলভ শৌচালয় ‘ এর ধারণা (Concept) নিয়ে এসে কাজে পরিণত করে স্যানিটেশন ও জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থায় বিপ্লব নিয়ে আসেন এবং কর্মক্ষেত্রে ও যাত্রাপথে জনপরিসর, বাস স্ট্যান্ড ও টারমিনাস , রেল স্টেশন ও টারমিনাস, বাজার, বন্দর ও বিমানবন্দর প্রভৃতি স্থানে এবং বিস্তীর্ণ বস্তি, শ্রমিক ও কলোনি এলাকায় ভদ্র ও সুস্থভাবে প্রাকৃতিক কাজের সুবন্দোবস্ত করে মানুষের প্রভুত সুবিধা করে দেন। প্রতিদিন এক কোটির বেশি মানুষ ‘পে অ্যান্ড ইউজ সুলভ শৌচালয় ‘ ব্যবহার করেন এবং এই মডেলের টয়লেট বিভিন্ন বস্তি, জনবসতি, কলোনি প্রভৃতি জায়গায় আরও কয়েক কোটি মানুষ ব্যবহার করেন। কারখানা ও পুরসভার বর্জ্যর সুসংস্থাপন নিয়েও তিনি ও তাঁর সংস্থা কাজ করেছে।
এছাড়াও তিনি মানবাধিকার, পরিবেশ দূষণমুক্তকরণ, অপ্রচলিত শক্তি, বর্জ্য সংস্থাপন, সমাজ কল্যাণ, শিক্ষা প্রসার প্রভৃতির উপর গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেন। বায়ো – টয়লেট প্রভৃতি আধুনিক ও পরিবেশ বান্ধব শৌচাগার নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করেন। এক সময় ভাগলপুর থেকে জাতীয় কংগ্রেসের সাংসদ ছিলেন। ছিলেন ‘ স্বচ্ছ ভারত মিশন ‘ এবং ‘ স্বচ্ছ রেল মিশন ‘ এর ব্র্যান্ড এম্বেসেডর।
এটা ঠিকই ভারতের বিষাক্ত ব্রাহ্মণ্যবাদী মনুবাদী সামন্ততান্ত্রিক হিন্দু জাত কাঠামোয় তিনি মেথর সম্প্রদায়কে ‘ বিধির বিধান ‘ জন্মগত বর্জ্য সাফাইয়ের পেশা থেকে মুক্তি দিতে পারেন নি। তাদের একাংশের মধ্যে কিছুটা সংস্কার আনতে পেরেছেন। এটা ঠিকই তিনি দেশের সমস্ত গ্রামে পৌঁছতে পারেন নি। কিন্তু জনবহুল মহানগরী, অসংখ্য ঘিঞ্জি শহর ও মফস্বল গুলিতে সুলভ শৌচালয় বা তার ধরনের শৌচালয় সকলের পরিচিত, বহুল ব্যাবহ্রিত এবং খুবই কার্যকর। বিদেশের অনেক জায়গাতেও জনপ্রিয়। যেটুকু করতে পেরেছেন তা এককথায় অকল্পনীয়। এই বিপ্লবী গত ১৫ আগস্ট ২০২৩ প্রয়াত হলেন। তাঁর মহান কর্মকাণ্ডের প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধা। তিনি ২০১৭ তে লাল বাহাদুর শাস্ত্রী জাতীয় পুরস্কার এবং ১৯৯১ এ পদ্মভূষণ সম্মাননা পান। বিদেশেও তিনি বহু পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। সম্প্রতি ভারত সরকার তাঁকে মরণোত্তর পদ্মবিভূষণ সম্মাননা দিলেন।
২৮.০১.২০২৪