গত এগারোই মার্চ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনা ভাইরাস কোভিড 19 ঘটিত অসুখকে বিশ্বব্যাপী মহামারী ঘোষিত করেছে । এমন সময়ে সেই প্রায় ভুলে যাওয়া অধ্যায় চতুর্দশ শতাব্দীর কুখ্যাত “কালো মৃত্যু”-র ইতিহাসে একটু চোখ বোলানো যাক না কেন, পৃথিবীর ইতিহাসে যা এখন পর্যন্ত সবচেয়ে উঁচু মৃত্যু মিনার! ইতিহাস তো বর্তমানকে টর্চের আলো দেখায়।
মাত্র পাঁচ বছর , 1347 থেকে 1351 সালের মধ্যে মারা গিয়েছিলেন পৃথিবীর 200 মিলিয়ন মানুষ। ইওরোপের জনসংখ্যাই বিভিন্ন দেশে 30-60% কমে গিয়েছিল। সেই জনসংখ্যা পূরণে পরবর্তী দুশো বছর সময় লেগেছিল। প্রাচীন কবরের কঙ্কালে প্লেগ জীবাণু, ইয়ারসেনিয়া পেসটিসের ডিএনএ আজ প্রমাণিত। কালো ধুমসো ইঁদুরের পিঠে চেপে যেসব ফ্লি এই জীবাণু বয়ে নিয়ে গিয়ে মানুষের শরীরে ঢোকাত তারাও দায়ী বই কি। কিন্তু এক আশ্চর্য সমাপতন যে তখনও বিশ্বজুড়ে ছিল সেই ভয়ানক মন্দা, তখনও ইওরোপে চার্চ আর রাষ্ট্রের ক্ষমতাদখলের লড়াইয়ে জর্জরিত জনতা।
মোঙ্গোল নেতা জানি বেগ। তিনি পৃথিবীর প্রথম জীবাণু যুদ্ধের নায়ক! বেশ কয়েকবার ক্রিমিয়া রাজ্যের বন্দর নগরী কাফ্ফা আক্রমণ করেছিলেন। 1345 সালে যখন কব্জা করার চেষ্টা করলেন তখন সৈনিকদের অধিকাংশ প্লেগে আক্রান্ত। বিনাযুদ্ধে কাফ্ফার নাগরিকদের মেরে ফেলার বেশ একটা ফন্দী আঁটলেন জানি খান বেগ –এমনিতেই তার নিষ্ঠুরতা ভুবনবিদিত। প্লেগে মৃত সৈনিকদের রাশি রাশি মৃতদেহ ঝুলিয়ে রেখে দিলেন কাফ্ফা নগরপ্রাচীর জুড়ে। হু হু করে ছড়িয়ে পড়ল রোগ। সালটা 1347, তার আগেই পনেরো বছর ধরে এশিয়ার পঁচিশ মিলিয়ন লোক মারা গেছে প্লেগে।
সূত্রপাত চীনদেশে। তিনটে বিশ্ব প্লেগ মহামারীই চীন থেকে শুরু। সাতশো বছর পর করোনা ভাইরাসও পূর্বজ ব্যাকটেরিয়াদের পথ অনুসরণ করছে। 1330 সালে চীনদেশ মোঙ্গোল অধিকৃত হবার পর আর্থসামাজিক অবস্থা ভেঙে পড়ে –দুর্বল অর্থনীতি যে কোনো মহামারী ছড়িয়ে পড়ার জন্য দায়ী। 1331 সালে চীনে মহামারী হল প্লেগ। এবার সিল্ক রুট ধরে ব্যবসায়ী আর মোঙ্গোল সৈন্যদের মাধ্যমে পৌঁছাল ক্রিমিয়ায়। ক্রিমিয়ার সেই কাফ্ফা নগরী তখন জেনোয়ার বণিকদের হাতে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ক্রীতদাস বাজার ছিল এই শহরে। জেনোয়ারা সারা পৃথিবীতে ওয়াইন, জলপাই তেল, মশলা, ভুট্টা, উল আরো কত কিছুর যে ব্যবসা করতেন। কাফ্ফা নগরীতে যেই রোগ ঢুকল, বণিকরা নগর ছেড়ে পালাতে শুরু করলেন। 1347 এর অক্টোবরে বারোটি জেনোয়া বণিকদের জাহাজ ইটালীর সিসিলি পৌঁছাল, জাহাজের আনাচেকানাচে গাদা গাদা ইঁদুর আর ইঁদুরের পিঠের এঁটুলির মত পরজীবী ফ্লীর পেটে কোটি কোটি প্লেগ জীবাণু। পুরো ইটালী জুড়ে প্লেগ মহামারী। করোনার মতোই আবার সেই ইটালী । ব্যাস! ইটালীর ভৌগোলিক অবস্থান এমন যে এবার মহামারী এগোল উত্তর পশ্চিমে ফ্রান্স, পর্তুগাল, স্পেন, ইংল্যান্ড। 1348-এ পূবে ও উত্তরে জার্মানি, স্কানডিনাভিয়ান দেশগুলোতে, 1351 সালের মধ্যে রাশিয়া ও অন্যান্য দেশে। একমাত্র বেলজিয়াম আর নেদারল্যান্ডস নিজেরা নিজেদের মতো থাকত, বাইরের কারো সঙ্গে ব্যবসাবাণিজ্য করত না বলে এই দুটো দেশ শুধু কিছুটা বেঁচে গিয়েছিল। ইওরোপ জুড়ে পথেঘাটে শুধু মৃতদেহের স্তুপ –শিল্পী সাহিত্যিকরা অনেক গুলো শতাব্দী ধরে ফিরে ফিরে দেখেছেন সে মর্মান্তিক দৃশ্য। আরো কতদিন চলত কে জানে। প্রাক-অ্যান্টিবায়োটিক যুগে প্লেগের কোনো ওষুধ ছিল না (করোনা ভাইরাসেরও এখন পর্যন্ত কোনো ওষুধ নেই)। এরমধ্যে সব কালো ইঁদুরগুলোই মরে গিয়ে মহামারী থামাল (করোনা ভাইরাসের মানুষ ছাড়া অন্য কোনো বাহনের খোঁজ মেলেনি, এটা রোগ ছড়ানো নিয়ন্ত্রণে রাখতে একটা প্রাকৃতিক সদর্থক ব্যাপার)।
“কালো মৃত্যু”-র যুগে না ছিল ফোন, ইন্টারনেট, উড়োজাহাজ না রোগ প্রতিরোধের কোনো সচেতনতা। এখন প্রতিটি মানুষের কানে মোবাইল ফোনের কলার টিউনে সচেতনতার বার্তা আসছে। সন্দেহের তালিকার সবাইকে কোয়ারেন্টাইনে রাখা হচ্ছে। আধুনিক প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে মানুষ যদি একটু সহযোগিতা করে, একটু বুঝদার হয় –হয়তো বড় বিপদ এড়ানো সম্ভব।
দেখা যাক সময় কি বলে –সাতশো বছর পর হয়তো কোনো বৈজ্ঞানিক আর ঐতিহাসিক মিলে বর্তমান অর্থনৈতিক মন্দা আর মহামারীর সঠিক বিশ্লেষণ করবেন।