কদিন থেকেই মনটা খিঁচরে আছে। আর মন খারাপ থাকলে গদ্য লেখা যায় না। যাই লিখি পদ্য হয়ে যায়। আমার পদ্য অতি অখাদ্য। পাতে দেওয়ার মতো নয়। জন্মের সাথে সাথেই চির নির্বাসনে যায়।
শনিবারের বার বেলায় বিচ্ছিরি রকম খিঁচরে থাকা মন নিয়ে বইমেলায় আমাদের স্টলে বসে হাই তুলছিলাম। চারপাশে প্রচুর মাছি- কিন্তু মাছি তাড়ানোরও উৎসাহ পাচ্ছি না। এমন সময় একজন সৌম্যদর্শন বয়স্ক ভদ্রলোক স্টলে ঢুকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এটাই কি দীপকদের স্টল?’
বললাম, ‘হ্যাঁ, এই তো দীপকদা এতক্ষণ একজনকে কালাচ সাপ আর ঘরচিতি সাপের পার্থক্য বোঝাচ্ছিলেন। আশপাশেই কোথাও আছেন। আপনি বসুন।‘
ভদ্রলোক বসে ব্যাগের চেন খুলে কতগুলি দশটাকা আর কুড়ি টাকার নোট বার করলেন। গুণতে গুণতে বললেন, ‘উঁহু, আপনাদের মধ্যমগ্রাম বইমেলা একেবারে জমজমাট না। এতক্ষণ আগে এসেও সুবিধা করতে পারলাম না।‘
আমি ভদ্রলোকের কথার আগা মাথা কিছুই বুঝতে পারলাম না। ওনাকে আর প্রশ্ন না করে হাই তোলায় মনোযোগ দিলাম। হাই খুব সংক্রামক। গৌরও পাশের চেয়ারে বসে হাই তুলছে। দুজনেই আজ ভোর ছটা থেকে দোহাড়িয়া মিলনপল্লীর খুপরিতে দিন শুরু করেছি। ঘুমে দুজনেরই চোখ বুজে আসছে।
ভদ্রলোক আমাদের বললেন, ‘আমি বহু জায়গায় ঘুরেছি। অভিজ্ঞতা প্রচুর। কিন্তু বইমেলায় স্টলে একসাথে দুজনকে ঘুমাতে দেখিনি। আপনারা দুজনে যদি ঘুমিয়ে পড়েন, তাহলে সে অভিজ্ঞতাটাও হয়ে যাবে।‘
ঘুম কাটানোর চেষ্টা করতে করতে দেখলাম দীপকদা আসছেন। আট দিন লেকচার দিতে দিতে দীপকদার গলা ভেঙে গেছে। গলায় একটা মাফলার জড়িয়ে রেখেছেন। দীপকদা ভদ্রলোককে দেখেই চিৎকার করলেন, ‘আরে মলয়দা যে। কখন এলে?’ যতই মাফলার জড়ান, এতো চিৎকার করলে দীপকদার গলা সহজে ঠিক হবে না।
ভদ্রলোক বললেন, ‘এসেছি অনেক্ষণ। তা তুমি বলবে তো বইমেলা ফাঁকা যাচ্ছে। রেলস্টেশনের পাশের মাঠেই কি একটা মেলা হচ্ছে দেখলাম। ওখানে ঘণ্টা দুয়েক ঘুরে বই মেলায় এলে লাভ হতো। বইও বেশি কেনা যেত।‘
‘আপনার মোট কতো হয়েছে?’
‘আড়াই ঘন্টা খেটে মাত্র দুশ চল্লিশ টাকা।‘
দীপকদা হাসলেন। বললেন, ;সমস্যা নেই। প্রণতি প্রকাশনীর বইয়ের দাম খুব কম। দুশ চল্লিশ টাকাতেই আপনার অনেক পছন্দসই বই হয়ে যাবে।‘
ভদ্রলোক বললেন, ‘দুটোয় মেলায় ঢুকে দেখি চারদিক বেবাক ফাঁকা। একটা লোকও নেই। বুঝতে পারলাম, এখানে কারবার জমাতে পারব না। চৌমাথা থেকে বারাসতের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। একটা বুলেটের শো রুম আছে না- ওই অবধি গেছিলাম। তাতে কিছু হল।‘
কৌতূহলের চোটে ঘুম কেটে গেছে। আমি দীপকদার দিকে তাকালাম। দীপকদা হেসে বললেন, ‘কিছুই বুঝতে পারছো না, তাইতো? এনার নাম মলয় বোস। থাকেন শ্যামনগরে। বিভিন্ন যুক্তিবাদী আন্দোলনের সাথে যুক্ত। বই মেলার খবর পেলেই ইনি প্রেশারের মেশিন নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। বইমেলায় ঘুরে ঘুরে প্রেশার মাপেন, মানুষকে স্বাস্থ্য সম্পর্কিত নানা রকম জ্ঞান দেন। এবং প্রেশার মাপার জন্য সামান্য টাকা নেন। এখন কতো করে নিচ্ছেন মলয়দা?’
ভদ্রলোক হাসলেন, ‘কুড়ি টাকা। সেই আদি ও অকৃত্রিম রেট।‘
দীপকদা বলে চললেন, ‘মলয়দা এই ভাবে টাকা তোলেন বই কেনার জন্য। যে টাকা ওঠে তাই দিয়ে বই কেনেন। শেষবার কলকাতা বই মেলায় একদিন হাজার দুয়েক টাকা তুলে ফেলেছিলেন। তার মধ্যে আবার সাড়ে সাতশ টাকা তুলেছিলেন পুলিশ ক্যাম্পে পুলিশদের প্রেশার মেপে।‘
মলয়বাবু হাসলেন। বললেন, ‘২০১০ সালে আনন্দবাজারে একটা ছবি বেড়িয়েছিল। একজন লালবাজারের সামনে ফুটপাথে বসে প্রেশার মাপছেন। ওই ছবি দেখেই প্রথম ব্যপারটা মাথায় এলো। আমার হাতে অফুরন্ত সময়। ইন্ডিয়ান নেভিতে চাকরি করতাম। যা পেনশন পাই, তাতে একা মানুষের দিব্যি চলে যায়। ঠিক করলাম, এভাবে যে উপার্জন করব সেটা দিয়ে বই কিনব। যদি কিছু বাঁচে তাহলে বিভিন্ন বিজ্ঞান সংগঠন এবং সত্যিকারের অভাবী ছেলেমেয়েদের পাশে দাঁড়াব।‘
‘এই ভাবে সত্যি সত্যি উপার্জন হয়?’
‘হয় মানে, দিব্যি হয়। ঠিক ঠাক জায়গায় ঘণ্টায় দেড়শো দুশো টাকা রোজগার কোনো ব্যপার নয়। বহরমপুর থেকে আসছি। স্টেশনে গিয়ে দেখি ট্রেন অবরোধ। আমি বসে থাকব কেন। কাজে লেগে পড়লাম। প্রেশার মাপতে লাইন লেগে গেল। চার ঘণ্টায় যে টাকা পেলাম, একটা ক্লাস সিক্সের মেয়েকে সিলেবাসের সব বই কিনে দিলাম। প্রথম প্রথম লজ্জা লাগত। এখন আর লাগে না। আমি তো আর চুরি ডাকাতি করছি না। বরঞ্চ কুড়ি টাকার বিনিময়ে মানুষের উপকারই করছি। কতো লোক তো জানতই না তাদের প্রেশার এতো বেড়ে রয়েছে। তাদের প্রেশার দেখে ডাক্তারের কাছে যেতে বলেছি। বলেছি বিড়ি- সিগারেট খাবেন না। ভাজা ভুজি খাবেন না। লবণ খুব কম খাবেন।‘
মলয়বাবু মিশুকে মানুষ। কিছুক্ষণের মধ্যেই নিজের জীবনের গল্প শোনাতে শুরু করলেন। ১৯৭৩ সাল থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত ভারতীয় নেভিতে চাকরি করেছেন। আন্দাবনের এক নির্জন দ্বীপের এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা শোনালেন। সে নিয়ে আলাদা গল্প হয়ে যায়। ৮৮ সালে নৌ বাহিনী থেকে অবসর নেওয়ার পর সৌদি আরবে দু বছর একটি হাসপাতালে প্যারা মেডিকেল স্টাফ হিসাবে কাজ করেন। তারপর দেশে ফিরে যুক্তিবাদী আন্দোলনের সাথে যোগ দেন। ম্যাজিশিয়ান প্রদীপ কুমার সিনহার সাথে যুগ্ম ভাবে সাপ নিয়ে নানা সচেতনতা মূলক কাজ কর্ম করেন। সেই সুত্রেই দীপকদার সাথে আলাপ।
দীপকদা বললেন, ‘কাল চলুন না, বনগাঁতে বিজ্ঞান মঞ্চের অনুষ্ঠান আছে।‘
মলয়বাবু বললেন, ‘কাল হবে না। একটা ক্লাস ইলেভেনের ছেলেকে বই কিনে দিতে হবে। ছেলেটা পড়াশুনোয় ভালো। একদম সকাল সকাল হাইকোর্টের সামনে থেকে প্রেশার মাপা শুরু করব। অনেকটাকার ব্যাপার। সারাদিন লেগে যাবে। শরীরটাও আজকাল ভালো যাচ্ছে না। বয়সও তো প্রায় সত্তর হলো।‘
দীপকদা বললেন, ‘ঐন্দ্রিল, তুমি মলয়দাকে নিয়ে একটা গল্প লিখে ফেল। সবাই জানুক।‘
আমি বললাম, ‘লিখলে আপনার আপত্তি নেই তো?’
মলয়বাবু বললেন, ‘একেবারেই আপত্তি নেই। আমিই তো ভাবছিলাম এই রাস্তায় ঘুরে প্রেশার মাপা নিয়ে একটা মিনিট দশেকের ভিডিও বানাবো।‘
আমাদের চারদিকে বেশ কিছু উৎসাহী মানুষের ভিড় জমে গেছে। তারা এতক্ষণ এক মনে মলয়বাবুর গল্প শুনছিলেন। তাদের একজন বললেন, ‘ডাক্তারবাবু লিখলে একটাই সমস্যা হতে পারে। কোনো ভাবে যদি দিদির কান পর্যন্ত কথাটা পৌঁছে যায়, তাহলে দিদি পরের সভাতেই বিকল্প কর্মসংস্থান হিসাবে চপ, মুড়ি, ঘুঘনীর পাশাপাশি সকলকে ঘুরে ঘুরে প্রেশার মাপতেও বলে দেবেন। সবাই একটা করে বিপি মেশিন আর স্টেথো নিয়ে বেরিয়ে পড়লে মলয়বাবু আর সুবিধা করতে পারবেন না।‘
★ছবির বয়স্ক মানুষটিই মলয়বাবু। একমনে বই পড়ে চলেছেন।🙏