লক আপের দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসেছিল মনীশ। আকাশ পাতাল ভাবছিল কত কিছু। নিজের সারাটা জীবন যেন সিনেমার মত বয়ে যাচ্ছিল তার স্মৃতির পর্দায়।
আজ নয়, সেই ছেলেবেলা থেকেই সে খুব ভীতু। মনীশের স্বভাব ছিল ভয়কাতুরে। গ্রামে থাকত তখন। কারেন্ট থাকার প্রশ্নই নেই। রাত্তির হলে লম্ফ নইলে হারিকেন ভরসা। লম্ফের হলুদ আলো অল্প বাতাসেই লাফাতো খুব। আর ঘরের মেটে দেওয়ালে লাফাত ছায়ারা। দেওয়ালজোড়া সেই ভূতের নাচ দেখে মাকে জড়িয়ে থাকত মনীশ। গরীব বাড়ি। কখনও সাধ্যাতীত বায়না করলে মা ওই ভূতেরই ভয় দেখাত।
বাচ্চাদের ভয় না দেখানোর যে আধুনিক নিয়মকানুন তা জানত না সেকালের বড়রা। বাবা, কাকা, মেসো কেউই জানত না। বাবার বাবা মারা গেছিলেন আগেই। বাবার চাকরি পাবার আগেই। বাবার মা বেঁচে ছিলেন। সেই ঠাকমার জানা ছিল নানা কিসিমের দৈত্যদানোর গল্প। সেই সব শুনে সিঁটিয়ে থাকত মনীশের ছেলেবেলা। তারপরে ইস্কুল শুরু হল। গ্রামের ইস্কুল। সেখানে মনীশ তেমন ভালো ছাত্র ছিল না।
শিক্ষা জিনিসটার সম্বন্ধে সেকালে ধারণা ছিল কিছু আলাদা। গুরুমশাইরা ছিলেন সবাই পিটুনি বলা ভাল গোবেড়েন-নির্ভর। ছড়ি, ছড়ির অভাবে পেটে চিমটি মাথায় গাট্টা জুলফি টানা। কানমলা, কিল-চড় তো একেবারে জলভাত। বাড়িতেও অবস্থা তাইই। ইস্কুলের হেনস্থা হবার কথা বাড়িতে জানাজানি হলে, ফের আর এক প্রস্থ পেটানি। যেন নাটকে এনকোর এনকোর বলে ঝাঁপিয়ে পড়ছে জীবন নাট্যের কঠোর দর্শকেরা। তাই পুরো বিদ্যালয় জীবনটাই ডাকসাইটে মাস্টারদের আর বাড়ির বড়দের ভয়ে একেবারে ভাসাভাসি।
এই ভয় কাটল না স্কুল পেরোনোর পরেও। কলেজে ইউনিয়নের জিএস আর তার চেলাদের ভয়, এমনকি সহপাঠীদের কী পাড়ার সমবয়সীদেরও ভয়ে কুঁকড়ে থাকত বেচারা মনীশ। চেষ্টা করলে, খেলত খারাপ না। খেলার মাঠও ছেড়েছিল ওই ভয়েই। যদি জিতে যায় সেই ভয়। হেরো টিমরা ভারি মারপিট করত কিনা মাঝে মধ্যে।
ব্যায়ামবীর নরেশ কাকুর মেজমেয়েটার নাম ছিল তুলি। সেই তাকে চিঠি দিয়েছিল মনীশের বন্ধু ভূতো। ভূতো মানে পালিতবাড়ির অমল। ওরকম চিঠিটিঠি অনেক দেওয়াটেওয়া হয় ওই বয়সে। মনীশের তখন ক্লাস ইলেভেন। টানা দশদিন ভয়ের চোটে ইস্কুলে গেল না মনীশ। ভূতোর সঙ্গে মেলামেশার কারণে যদি তুলির মারকুটে বাবা আর দাদা ওই চিঠির জন্যে তাকেই দায়ী ঠাওরায়!
গোবিন্দ পাল তার বউ আর দুই মেয়েকে নিয়ে থাকে মনীশের বাড়ির পাশে একটা চোখে না পড়ার মত ঝুঁকে পড়া হাড় বার করা একতলা বাড়িতে। একচিলতে এই পৈতৃক জমিটুকু তার সম্বল। সে নিজে মাটির পুতুল তৈরি করে মেলায় বিক্রি করে।
ইলেকশনে জেতা পাড়ার নতুন কমিশনার বরুণ, যে নিজেকে পৌরপিতা বলতে ভালোবাসে, আদতে উঠতি জমি মাফিয়া। এখন ছোটোখাটো হলেও ওই লাইনে বড় হবার আকাঙ্ক্ষা খুবই। সেই তার চোখ পড়েছে ওই জমির ওপর। পাশের জমিটা গস্ত করেছে আগেই।
গোবিন্দকে ওই সামান্য একদেড় কাঠা জমির জন্য না হক চড় থাপ্পড় মেরে গেল বরুণ যে দিন, ভীতু মনীশ ওপাশের জানলাটা বন্ধ করে শুধু দিল তাই না আধঘণ্টা বাদে পেছন দরজা দিয়ে বেরিয়ে দক্ষিণপাড়ার অশেষদের বাড়িতে গিয়ে বসে রইল দুপুরতক। কেন? সেও ওই ভয়েই, ভয়ের চোটেই। ভয় কীসের? যদি গোবিন্দ তার এই অযথা হেনস্থার ব্যাপারে মনীশকেই সাক্ষী মেনে বসে এই তার ভয়।
মনীশের অফিসে একবার খুব ঝামেলা। ঝামেলা মনীশের অফিসে ঠিক না। কর্তারা হঠাৎ করেই কলকাতা অফিসের চারপাঁচজন স্টাফকে নানান উটকোপাটকা অজুহাতে বরখাস্ত করে দিল। কাউকে মিথ্যে আর্থিক চুরির কেসে, কাউকে সার্ভিস রুল অমান্যর নানান ভজকট অভিযোগে। ঠিক হল তার প্রতিবাদে মফস্বলে এই শাখা অফিসেরও সবাই ধর্মঘট করবে। ওই পেন ডাউন স্ট্রাইক যাকে বলে।
কিন্তু যে দিনটা ঠিক করা হল, সেদিন অফিসের সব কজন স্ট্রাইকপন্থীই মাথা নীচু করে কাজে ঢুকল। সবারই স্ট্রাইক না করার কোনও না কোনও কারণ রয়েছে। কারওর ট্র্যান্সফারের ভয়। কারও অ্যানুয়াল কনফিডেন্সিয়াল রিপোর্টে খারাপ মার্কা পড়ার ভয়। কারও অন্য কোনও কারণ। অফিসের টপ বস সকাল থেকে খোঁজ রাখছিল। সে ভীত অধস্তনদের এ হেন বাধ্যতা দেখে বেজায় খুশি। মনীশও সবার মত সেদিন কাজ করল ঠিকই কিন্তু তার বড় আত্মগ্লানিও হল। সে কেন চাকরি চলে যাওয়াদের পাশে দাঁড়াতে পারল না। এত ভয় কীসের তার?
ছোটোবেলার সেই ভয় জড়ানো সময়ে, যখন সবাইকে ভয় পেত সে, মনীশ একমাত্র বিশ্বাস করত কানাইদাদুকে। এ বাড়িতে থাকত না। লোকটা বাবার কেমন যেন কাকা হত। মনীশকে ডাকত মনু বলে। জানত শুনত অনেক। বেশি দেখা হত না। একটু বাউন্ডুলে টাইপের। ঠাকমা বলত, নাকি সন্ন্যাসীরই মত। মাসে ছমাসে এসে ঠাকমাকে বলত, কই গো বউঠান, খাবার কী আছে দাও। কী জানো, লছমনঝোলার পাশের পাহাড়ে বসে বড্ড তোমাদের কথা মনে পড়ছিল। তোমার এই নাতি মনুটার মুখ মনে পড়ত। বুইলে তো সেই ভরতরাজার কেস। এই তুচ্ছ সংসারের মায়ায় পড়ে আমার আর শেষ অবধি সন্ন্যাসী হওয়া হল না।
মনীশের বয়স তখন পাঁচ কী ছয়। কানাইদাদু ওর মুখে ভয় পাবার ব্যাপারটা শুনে হাহা করে হাসত। বলত, ‘একদিন তোকে এই এত যে ভয় পাস কেন বোঝাব।’
মানুষটাকে দেখলে মনের ভেতরে সাহস যে বাড়ত, ব্যাপার তা না। কিন্তু নিজের দাদু ছিল না বলে, যে কদিন থাকত বাড়িতে, কানাইদাদুকে ছেড়ে থাকতে ইচ্ছে করত না।
মনীশের নিজের বিচারে সেই ছেলেবেলার একজন বেশ সাহসী মানুষ ছিল কানাইদাদু। পাহাড়ে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়। হয় তো বাঘভালুকেরও চোখে চোখ রেখে কথা কয়। তা সেই কানাইদাদুকেও আর বছরদশেকের পর আর পাওয়া গেল না। বাবা ঠাকমাকে একটা পোস্টকার্ড দেখিয়ে বলল হরিদ্বার থেকে এসেছে নাকি। কানাইদাদু মারা গেছে। ওখানেই দাহ করেছে সাথে যারা ছিল। বাড়ির সবার মন খারাপ হল যদিও কাঁদল না কেউই। শুধু মনীশ আলগোছে একবার কেউ যেন না দেখে এমনভাবে চোখ মুছে নিল। যদি ওকে কাঁদতে দেখে কেউ খেপায় সেই ভয় তার।
এরপর থেকে, নতুন ব্যাপার হল একটা। আগে কানাইদাদু ন মাসে ছ মাসে আসত। এখন দেখা হয় তার চেয়ে ঘন ঘন। ঘুমের মধ্যে, স্বপ্নের মধ্যে আসে। অসুবিধে একটাই। দাদু তার হাসিতে ভাসা চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে শুধু। অনেক কথাবার্তা হয় তা না। তবে দেখা হয়। আর সুবিধা এই যে মনীশ বড় হল। তার বাবা বুড়ো হল। মনীশ চাকরিতে ঢোকে। বিয়ে করে। তার দুটি একটি ছেলেপুলেও হয়। ঠাকমা মরে যায়। কানাইদাদুর কিন্তু বয়স বাড়ে না।
গোবিন্দর মার খাবার পর অশেষদের ওখান থেকে বাড়ি ফেরার পর মন খুব খারাপ ছিল তার। সে দিন রাতে তার স্বপ্নে কানাইদাদু এসেছিল। কানাইদাদু কোনওদিনই স্বপ্নে এসে কিছু বলে টলে না। মনীশ… স্বপ্নের ভেতরেও প্রবল আত্মগ্লানিতে ভোগা মনীশ, আজ কিন্তু খুব আকুল হয়ে শুধোলো তার ছোটোবেলার স্মৃতির মানুষটাকে, ‘ ও দাদু, আমি এত ভীতু কেন?’
দাদুর চোখদুটো সেই আগেরই মত, হাসিতে টইটম্বুর। স্বপ্নের মধ্যেই জবাব দিল, ‘কী জানিস মনু, এই ভয় ব্যাপারটা খুব সংক্রামক। তুই জানিস এই ভয়ই তোকে রক্ষা করবে। তাই এর হাত থেকে তোর রক্ষা নেই। এই যে তোরা সেদিন আপিসশুদ্ধু লোক ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেলি, চাকিরিটা বাঁচল। ঠিক কিনা?’
আরও দু চারটে কথা জিজ্ঞেস করার ছিল। কিন্তু হঠাৎই ঘুমটা ভেঙে গেল। পরে আবার ভোর রাতের দিকে ঘুম এল যদিও, কানাইদাদু আর ফিরল না।
দাদু আর না ফিরলেও মনীশ তার পুরোনো প্রশ্নের জবাব পেয়ে গেছে। মনীশ খুব ভাবত তার এই ভয় রোগটাকে নিয়ে।
আজ জেনে গেল, আসলে তার এই ভয়টা একরকমের ছোঁয়াচে রোগ। এ রোগ সারবে না।
ভয়টা সারল না কিন্তু এরপর থেকে ভয় নিয়ে ভাবনাটা সেরে গেল। কী করা যাবে! সেল্ফ ডিফেন্সের সংক্রামক রোগ। একজনের থেকে অন্যজনের ভেতরে চাড়িয়ে যায় এই ভয়মুহূর্তগুলো। এ থেকে তার মুক্তি নেই।
যে ঘটনাটা বলতে যাচ্ছি তা ঘটল এইসবের বছর তিনেকের মাথায়। এবারের এই ঘটনায় মনীশের জড়ানোর কথাই নয়। বিকেলে অফিস থেকে ফেরার পথে অটো থেকে নেমে বাড়ির রাস্তাটা ধরেছে। মফস্বল শহরের এই রাস্তাটা একটু নির্জন। বাড়িতে পৌঁছোতে পৌঁছোতে বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যে। দুপাশে পুটুশ ঝোপে ঝিঁঝিঁরা কলতান তুলেছে। একফালি চাঁদও কি যেন বলতে চাইছে রাস্তার পাশের বাড়ির ছাদ ডিঙিয়ে। দিব্যি মায়াবী আবহাওয়া।
বাড়ি ফিরে দেখে পাশের সেই গোবিন্দের বাড়িতে আবার ব্যাপক গণ্ডগোল। দশ বারোটা ছেলে ছোকরা ভিড় করেছে সে বাড়িতে। ভিড় করেছে না বলে হানা দিয়েছে বলাই ভালো। গোবিন্দ এখনও ফেরেনি। ভেতর থেকে তারস্বরে চেঁচাচ্ছে ওর বউ আর দুই মেয়ে। বড় মেয়েটার বয়স সতেরো আঠারো। ওকেই নাকি তুলে নিয়ে যেতে এসেছে বুল্টে আর তার সঙ্গীরা। বুল্টে ওই মিউনিসিপ্যালিটির ভোটে জেতে লোকটার সব অপকর্মের ডানহাত। এ রকম কেস এই এলাকায় আগেও দু চারটে ঘটেছে।
পাড়ার লোকেরা একটু দূর থেকে উঁকিঝুঁকি মারছে বটে, কাছে এগোচ্ছে না কেউই। একে জমিজমার ব্যাপার, তায় মেয়েছেলে জড়িয়ে। কে জানে সোমত্ত বয়সের মেয়ের সঙ্গে বুল্টেদের সত্যিই তলায় তলায় কোনও সাঁট আছে কিনা! এখন ভয় পেয়ে খামোকা চেঁচাচ্ছে হয় তো। কিম্বা গোবিন্দই হয় তো রফা করে নিয়েছে। সব হয় আজকাল। সবই সম্ভব! সত্যিই তো, কী দরকার এই সব আনকা বিপদে জড়ানোর।
ব্যাপার শুনে মনীশের মাথার মধ্যে কেমন যেন করে উঠল। সে মোটেই গোবিন্দর বাড়ির দিকে গেল না যদিও। অতগুলো লোকের মহড়া সে একা নিতে পারবে না জানতই।
তবে সে নিজের বাড়িতেও ঢুকল না। সটান চলে গেল বিষ্টু পালিতের মোড়ের পার্টি অফিসে। সেটা যে ওই পাজি পৌরপিতার দিনরাত্তিরের আড্ডাখানা সেটা এলাকার তামাম লোক জানে। ভেতরের দিকের একটা ঘরে বসে ওই বরুণলাল তার স্যাঙাতদের নিয়ে। মুখচোরা মনীশের ওই ঘরটায় ঢোকার সাহস কোনও দিনই হয়নি। আজ কোনমন্ত্রে কে জানে, সে দরজায় টোকাটি অবধি না দিয়ে ধাক্কা দিয়ে ঘরের দরজাটা দরাম করে খুলে ফেলল। বিস্মিত লোকগুলোর চোখের সামনে সে বরুণের চোখে চোখ রেখে বলল, ‘শোন রে উল্লুক, বুল্টেটাকে গোবিন্দর বাড়িতে পাঠালি যখন, নিজের মা কী বোনের কথা কি একবারও মনে পড়ল না গর্দভ?’
উত্তেজিত হলে কথা গুলিয়ে ফেলে মনীশ। নইলে একটা লোক যে কিছুতেই এক সঙ্গে উল্লুক আর গাধা হতে পারে না এটা সে বুঝত। তবে হারু পণ্ডিতের পেটানি খেয়ে শেখা, ঠিক কথাটা যে গর্দভ, আর মোটেই গর্ধপ নয় সেটা তার মাথায় ছিল।
এইটুকু শুনেই বরুণ আর তার চেলাদের চোখ ছানাবড়া। কী বলে রে এই চিরকাল মাথা নীচু করে থাকা লোকটা? একে তো স্রেফ এই অপরাধেই পিঁপড়ের মত টিপে মেরে ফেলা যায়। কিন্তু এতসব ভাবার আগেই মনীশ সামনের চেয়ারগুলোকে ঠেলে ঝড়ের মত হাজির বরুণের মুখোমুখি। গদীওলা চেয়ারে বসে থাকা বরুণ নামের জননেতাটাকে কলার ধরে তুলে সপাটে একটা চড় মেরে মনীশ সিংহগর্জনে বলল, ‘ফের যদি এরম বেয়াদবি করেছিস, তোকে আমি… তোকে আমি…’। কী যে করবে গুছিয়ে বলার আগেই বরুণের চেলারা ঝাঁপিয়ে পড়ল মনীশের ওপর। শুরু হল বৃষ্টির মত কিল চড় লাথি ঘুষি।
মনীশ হয়তো ওই গণপিটুনিতে মরেই যেত। কিন্তু বরুণই মাঝে পড়ে আটকাল। বক্তৃতার ঢঙে বলল, ‘বন্ধুগণ, আইন চলবে আইনের পথে। তার চে এটাকে থানায় দেওয়া যাক। বেঁধে রেখে ওসিকে ফোন লাগা এখুনি।’
থানার গাড়ি তুলে নিয়ে এসেছে মনীশকে। হাসপাতাল ঘুরিয়ে আনার কথা। বেশ বেশিই জখম। পুলিশবাবুদের মতে দরকার নেই অবিশ্যি। কালকে কোর্টে প্রোডিউস করার আগে হাসপাতালের ইমারজেন্সিতে নিয়ে গিয়ে ডাক্তারকে দিয়ে লিখিয়ে নিলেই হবে, ‘নো ইনজুরি, নো কমপ্লেইন’। সেই ডাক্তার বেচারাও তো ভীতু। বাড়ির আর পাড়ার লোকজন খবর পেয়ে এসেছিল। যঅদি কী নাকি থানার থেকেই জামিনটামিন পাওয়া যায়। থানার মেজবাবু ছিল চার্জে। স্রেফ হাঁকিয়ে দিয়েছে, নন বেলেবল কেস বলে। কী সব ধারায় নাকি অ্যারেস্ট করেছে। অ্যটেমপ্ট টু মার্ডার আর তাছাড়াও গাঁজা কেসটেস, সে এক মহাভারত। কোন একটা কোথাকার অম্বিকেশকে যেরম কেসে ফাঁসিয়েছিল।
মনীশ ওর মুখ আর শরীরের রক্ত শুকিয়ে আসা কালো ক্ষতস্থানগুলোর ব্যথা যন্ত্রণা কিছুই তেমন টের পাচ্ছিল না। আসলে চেতনা কেমন যেন আচ্ছন্ন মতন হয়ে যাচ্ছিল। হাজতের দেওয়ালে হেলান দিয়ে ঘোরের মাথায় শুধু ভাবছিল, ভেবেই চলছিল, এই এমন আদৌ বেমানান কাজটা ও করল কী ভাবে?
এই রকম ভাবতে ভাবতে একটু ঝিমুনি মত এসেছিল। হঠাৎ লক আপের দরজার ঝনঝনানিতে চটকাটা ভেঙে গেল। অবাক হয়ে দেখল গারদের ভেতরে কনস্টেবলরা ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলছে বুল্টে কালু মুন্নাদের গোটা দশেককে। সব কজনই গোবিন্দর মেয়েকে তুলতে গেছিল। হাজতের আলোটা নিষ্প্রভ। তার মধ্যেও মনীশের মনে হল, ওরাও বেশ ঘায়েল। ওদেরও সারা গায়ে কালশিটে।
কী করে ওদের এমন হল জানবার আগ্রহ হচ্ছিল যদিও, সেই সন্ধেবেলা থেকে নানান ধকলের মধ্যে থাকা মনীশ আবার ঘুমিয়ে পড়ল। এবার আর হেলান দিয়ে না। হাজতের নোংরা মেঝেতেই। মনীশ অনুভব করল ওর খুব জ্বর এসেছে। চরাচরব্যাপী এক বেভুল অবস্থা। বাড়ি ফেরার সময়ের ফালি চাঁদটা কি ডুবে গেছে এতক্ষণে? তবে এত জ্যোৎস্না এল কোত্থেকে?
আজ আবার লকআপে ঘুমের মধ্যে কানাইদাদু এল। সেই হাসি হাসি মুখচোখ। ওর সারা গায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। ওর তো ব্যথা লাগার কথা। লাগছে না। বরং ব্যথা কমে যাচ্ছে।
কানাইদাদুই আগ বাড়িয়ে বলল,’তাহলে মনু, আজকের ব্যাপারটা কী বুঝলি কিছু দাদুভাই?’
স্বপ্নেই ঘাড় নাড়ল মনীশ। না, বোঝেনি। কিছুই বোঝেনি। এ যেন সেই ছোটোবেলার দস্যু মোহনের গল্পে পড়া। কোথা হইতে কী হইয়া গেল টাইপের ব্যাপার।
কানাই দাদু বুঝিয়ে বলল, ‘কী জানিস, ওই যে বলেছিলাম না ভয়টা খুব সংক্রামক এক ব্যামো, মনে আছে তোর? ভাবলে, আসলে কিন্তু সাহসও তাই। নইলে তোর ওপর হামলার খবর পেয়ে এলাকার লোকজন কাতারে কাতারে গিয়ে ওই বরুণ শীলের অফিসটাকে ভাঙল কী করে? আর এই বুল্টে কালুদের গ্যাংটাকেই বা এ ভাবে সাইজ করল কীভাবে? সাহসও দাদুভাই মনে রাখিস ওই ভয়ের মতনই এক সংক্রামক জিনিস।’
★