আগে যখন যৌথ পরিবার ছিল তখন এমন ঘটনা আকছার ঘটতো। মায়ের অবর্তমানে কাকিমা, মাসিমার বুকের দুধ খেয়েই বড় হত শিশুরা। তারপর দিন বদলালো, মায়ের দুধ না পেলে কৌটোর দুধই ভরসা। আগে হাসপাতালেও দেখা যেত যদি কোনো মায়ের বুকের দুধ না আসতো সিস্টার দিদিরা অন্য মায়ের দুধ তার বাচ্চাকে দিত। মধ্য কলকাতায় এক নার্সিং হোমে একবার শুনি তুলকালাম কাণ্ড, এক ধর্মের শিশুকে অন্য ধর্মের মায়ের দুধ দেওয়া হয়েছে। গরু বা ছাগলের ধর্ম দেখে কি তাদের দুধ বাচ্চাদের খাওয়ানো হয়?
আর একটা ঘটনার কথা মনে পড়লো। ওয়ার্ড রাউন্ডে গেছি, আমাকে দেখেই পেশেন্ট হাউ মাউ করে কেঁদে উঠে বললো, ‘ স্যার আমি ভালো মা হতে পারলাম না ‘।
– মানে?
– সব মায়েদের বুকের দুধ আসছে, আমার আসছে না। আমার বাচ্চার বুদ্ধি হবে না। আমি মা হয়ে ওর ভবিষ্যত অন্ধকার করে দিলাম।
আমি ভাবতাম, দিনকাল আমূল বদলে গেছে, কিন্তু কিছুই বদলায়নি।
ও, আমূল বলতে গিয়ে, ওই বিজ্ঞাপনের কথা মনে পড়ে গেলো – দুধ দুধ দুধ দুধ, দুধ ওয়ান্ডারফুল দুধ। আর সেই বিজ্ঞাপনটা মানেই ছোটবেলা। যখন নাক টিপলে দুধ বেরোয়। ছোটবেলার আমার প্রিয় খাবার ছিল কৌটোর গুঁড়ো দুধ। টাকরার ওপর আটকে নিয়ে জিভ দিয়ে চেটে চেটে খাওয়া। আর পায়েস করার জন্য মিল্ক মেড এর যে কনডেন্সড মিল্ক পাওয়া যেত সেগুলো লুকিয়ে খাওয়া। একবার মা জিজ্ঞেস করেছিল কৌটোর দুধটা কী করে শেষ হলো। আমি পাশের ঘরে পড়ছিলাম, কৌটো কথাটা না শুনেই বলে দিয়েছিলাম বেড়ালে খেয়ে গেছে।
ছোটবেলায় আর একটা জঘন্য কাজ ছিল ভোরবেলা খাটালে গিয়ে গরুর দুধ নিয়ে আসা, বিশেষ করে শীত কালে। বাড়ি থেকে বালতি নিয়ে গিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে গরুর দুধ দোয়াতে হতো। গোবর মারিয়ে, গরুর প্রস্রাব বাঁচিয়ে। তখন অবশ্য ওই বস্তুগুলোর সে রকম দাম ছিল না। তবে ওই বয়েসেও একটা খারাপ লাগা ছিল। বাছুরটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে, আর আমি সব দুধ বাড়ি নিয়ে চলে যাচ্ছি। তারপর ওই খারাপ লাগা ধীরে ধীরে কমে গেল, আমিও বড় হয়ে গেলাম। বুঝলাম চায়ে দুধ না খেলে স্ট্যাটাস বাড়ে।
এই করোনা কালে দুধ আবার শিরোনামে, গোবর ঘুঁটে-কে সরিয়ে। করোনার প্রথম দিকে স্বাস্থ্যকর্মীদের গ্যাসে বুক ফুলে উঠলো। হাততালি, থালা বাজানো, আকাশ থেকে পুষ্পবৃষ্টি। তার পর একদিন সেই গ্যাস বেরিয়ে বুক চুপসে গেল। করোনা শুরু হওয়ার পর থেকে সবচেয়ে যাঁরা বেশি নিগৃহীত হয়েছেন তাঁরা হলেন চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী। তাঁদের সবচেয়ে বড় অপরাধ ছিল তাঁরা করোনা রোগীদের সেবা করতেন। কাউকে বাড়ি থেকে উতখাত করা তো কাউকে পাড়ায় ঢুকতে না দেওয়া এমনকী শারীরিকভাবেও বারবার হেনস্থা হতে হয়েছে তাঁদের। যদিও তাঁরা তাঁদের নিজেদের কাজে অটল। শুধু তাই নয়, অনেক সময় যে কাজ হয়তো তাঁদের করার কথা নয় তেমন কাজও করেছেন। যেমন আর জি কর হাসপাতালের এক নার্স। ওই হাসপাতালে এক শিশু জন্ম নেয় যার মায়ের কিছু শারীরিক সমস্যার জন্য বাচ্চাকে দুধ খাওয়ানো সম্ভব ছিল না। হাসপাতালের অন্য কেউ ওই বাচ্চাকে দুধ দিতে রাজি ছিলেন না।করোনার সময় সবার ভয়, যদি তাঁদের এ কাজ করতে গিয়ে সংক্রমণ হয়। তখন এগিয়ে আসেন ওই নার্স। তিনি নিজেও কিছুদিন আগে মা হয়েছেন। তাই অপত্যস্নেহে অন্যের বাচ্চাকে কোলে নিয়ে দুধ পান করান। বাচ্চাটি বেঁচে যায়।
একইভাবে দক্ষিণ ২৪ পরগণার এক হাসপাতালের স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ তিনজন শিশুকে নিজের দুধ খাইয়ে শান্ত করেন। কারণ তিনজন শিশুই মায়েদের শারীরিক অসুস্থতার জন্য দুধ না পেয়ে কান্নাকাটি করছিল। নিজের বাড়িতে রেখে আসা আট মাসের শিশুকে দুধ খাওয়াতে না পারলেও অন্য শিশুদের আপনার করে নিতে কোনও অসুবিধা হয়নি।