নোয়া হারারি তার ‘সেপিয়েন্স’ বইতে ‘লাক্সারি ট্র্যাপের’ বিষয়টা খুব সুন্দরভাবে বুঝিয়েছিলেন। উনি সেক্ষেত্রে যে উদাহরণ দিয়েছিলেন সেটা কৃষির আবিষ্কারের সাথে যুক্ত ছিল। যাযাবর শিকারি মানুষের (ইতিহাসে যে সময়টা অনেক লম্বা) জীবন ছেড়ে মানুষ যখন ধীরে ধীরে কৃষিতে অভ্যস্ত হচ্ছে তখন তার শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ায় ও সমাজবদ্ধ জীবনে কিছু মৌলিক পরিবর্তন ঘটে যায়।
মানুষ শারীরিকভাবে দূর্বল হতে থাকে। তার ইমিউনিটি কমতে থাকে- সহজেই বিভিন্ন রোগের শিকার হয়ে পড়ে। অন্যদিকে কৃষিতে উদ্বৃত্ত শস্য বিপণন ও বন্টনকে কেন্দ্র করে এক সুবিধাভোগী, ক্ষমতাশালী শ্রেণীর সৃষ্টি হয়, সেখান থেকেই রাজতন্ত্র, রাষ্ট্র ও ‘এলিট’ শ্রেণীর উদ্ভব হয়। যে এলিট শ্রেণীর প্রতিনিধি আমি নিজেও। আজকের পৃথিবীর দিকে ভালোভাবে তাকালেও আমরা এই নিয়মের খুব বেশি পরিবর্তন হয়েছে বলে দেখতে পাই না।
এবার ‘লাক্সারি ট্র্যাপের’ কথায় আসি। যদিও এটা কি বিষয় অনেকেই তা জানেন তবু আমার লেখার ভূমিকা হিসেবে এটা বলা প্রয়োজন। মানুষ যত বিলাস ও আরামে অভ্যস্ত হয় তার পক্ষে সেই সুখকর পৃথিবী থেকে বেরিয়ে আসা মুশকিল হয়ে পড়ে। ক্রমে এক সুবিধে থেকে আরেক সুবিধে- এভাবেই সে ধীরে ধীরে সহজ থেকে সহজতর জীবনের দিকে এগিয়ে যায়।
এই সহজতর জীবনযাপন কিন্তু সহজে হয় না। এর জন্য তাকে যথেষ্ট অর্থব্যয় করতে হয়। সেই অর্থের যোগানের জন্য তাকে আরও বেশি করে আনন্দহীন কাজে আত্মনিয়োগ করতে হয়। এতে তার মন ও শরীর দুয়েরই ক্ষয় হয়। এভাবেই সে ধীরে ধীরে একে বিলাসজনিত শারীরিক দুর্ভোগ, অন্যদিকে আনন্দহীন কাজের চাপে নিজের জীবনকে আরও সমস্যার মধ্যে এনে ফেলে। এটাকেই মোটের ওপর ‘লাক্সারি ট্র্যাপ’ বলা যেতে পারে।
পৃথিবীতে অন্যান্য অনেক পেশাদারদের মতই আমরা ডাক্তাররাও লাক্সারি ট্র্যাপের অন্যতম শিকার। কিছুটা সামাজিক পরিকাঠামো, কিছুটা নিজেদের স্ট্যাটাসের প্রতি নজর, কিছুটা অর্থের আধিক্য- এই সবকিছুই তাদের এই ফাঁদে জড়িয়ে ফেলে।
আমি ছোটবেলা থেকেই খুব অর্থকষ্টে বড় হয়েছি। সে গল্প আগে অনেকবার করেছি। নতুন করে বলার কিছু নেই। আজ আমি আর্থিক ও সামাজিকভাবে যথেষ্ট স্বচ্ছল হলেও আমার ছোটবেলার সেই ফাটা টিনের চাল, বৃষ্টির জলে ভেসে যাওয়া ঘর, পাছায় রিফু করে পরা প্যান্ট এগুলো আমার ভেতরে রয়ে গেছে। তাই ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজেকে সেই ফাঁদ থেকে কিছুটা দূরে রাখতে সফল হলেও সবসময় পারি না, পারা সম্ভব হয় না।
ডাক্তারি পাশ করে যখন ভাড়াবাড়ির খুপড়িতে রুগি দেখি, তখন কেবল সাইকেলই চালাতাম। ক্লাস এইটে পৈতেতে মামাবাড়ি থেকে উপহার হিসেবে পাওয়া হারকিউলিস সাইকেল। সেই সাইকেলে চেপে আমি কখনও কখনও পেশেন্টদের হোম ভিজিটও করেছি। আমার তাতে বিন্দুমাত্র লজ্জাবোধ হত না।
সেই সাইকেলে চেপে একবার এলাকার বিখ্যাত এক ওষুধের দোকানে গেলে সেই দোকানের মালিক দাদা বললেন, “ডাক্তার হয়েছ, এবার সাইকেল ছাড়তে হবে। গাড়ি না হোক। অন্তত একটা বাইক কিনতে হবে”।
দাদা তার নিজস্ব সামাজিক ট্যাবু থেকে সঠিক কথাই বলেছিলেন। আমিও তখন নিজের পায়ের নীচের মাটি শক্ত করার কাজে ব্যস্ত। তাই দাদার উপদেশ গ্রহণ করলাম। এরপর থেকে রুগিদের বাড়ি যাওয়া দূরে থাক, পাড়া থেকে বেশি দূরে সাইকেল চালিয়ে যেতাম না। কিন্তু মায়ের প্রচন্ড বিরোধিতায় বাইক কেনা ও চালানো আমার আর হয়ে ওঠে নি।
আমি বত্রিশ বছর বয়সে যখন বিয়ে করি তখনও চাকরি করতাম না। আমার ভিজিট ত্রিশ টাকা থেকে বেড়ে চল্লিশ টাকা হয়েছে। বউ চাকরি করে। বাড়ি তৈরি করছি। নির্মীয়মান। শ্বশুরমশাই কী দেখে যে আমার সাথে তার মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন জানি না। রীতিমতো ধারদেনা করে বিয়ের পয়সা জোগাড় করতে হয়েছিল।
বছর ঘুরতে না ঘুরতেই মেয়ে। তার তিনবছর হতে না হতেই স্কুল। কিছুতেই স্কুলে যেতে চায় না। তাই গাড়ি কিনতে হবে। তারপর যেমনই হোক না ডাক্তারবাবুর মেয়ে বলে কথা! কিন্তু টাকা কোথায় যে গাড়ি কিনব? ব্যাঙ্ক লোন দিল না। কারণ তখনও চাকরি নট্। তাই আমার কিছু জমানো টাকা আর বউ লোন নিয়ে গাড়ি কিনল।
গরিবের ভরসা মারুতি আর ধনীর ভরসা তিরুপতি! অল্টো ৮০০। নিজেই চালাই। ড্রাইভার নেই। নতুন গাড়ি চালালে ঠোকা ধাক্কা লাগেই। লাগেও। আরেক ওষুধের দোকানের ছেলে একদিন বলল, “ডাক্তারবাবু এত সোটো গাড়ি কিনলেন ক্যান?” সে বাংলাদেশ থেকে সবে এসেছে। বড় বাড়ি, বড় গাড়ি, বিরাট দোকান।
এর মধ্যে চাকরি হয়ে গেছে। কলেজে মাঝেমধ্যে গাড়ি নিয়ে যাই। পার্কিং-এ বেশিরভাগই সেডান। হন্ডা সিটি, টয়েটা, আই ২০। মাঝে মধ্যে মার্সিডিজ ও বি এম ডব্লিউ উঁকি দেয়। ছাত্ররাও অনেকে পনের লাখি গাড়ি চালিয়ে পড়তে আসে।
মনটা খচখচ করে। গাড়ি সবে সাতবছর হয়েছে। দিব্যি চলছে। কোনো অসুবিধে নেই। এই সবে পাঁচ বছরের রোড ট্যাক্স এতগুলো টাকা দিলাম। বন্ধুদের কারও কারও দুটো তিনটে গাড়ি। দুম করে ফোক্স ওয়াগনের পোলো কিনে ফেললাম। যারা গাড়ি চালান তারা জানেন একবার ভালো গাড়িতে অভ্যস্ত হয়ে গেলে অন্য গাড়ি চালাতে অসুবিধে হয়। তাই নামা যায় না, ওঠা যায়। আর ভালো গাড়ি মানেই বেশি মেন্টেন্যান্স খরচ, বেশি ইন্সুরেন্স।
এরই মধ্যে আরেক ওষুধের দোকানের ছেলে বলতে শুরু করেছে, “স্যার, কিনলেন যখন এক্স ইউ ভি কিনতে পারতেন!” তার কাকা মাহিন্দ্রার টি ইউ ভি চালায়। আমি কিন্তু খেলাটা ততদিনে বুঝে গেছি। তাই আমার হাসি পেল। আমি জানি আমার এবার দাঁড়াবার সময় এসে গেছে।
এটা একটা উদাহরণের বিবর্তন উপমা হিসেবে দেখালাম। এরকম বহু উদারণ আমার মত মধ্যবিত্ত ডাক্তারবাবুর ক্ষেত্রে দেয়া যায়। রাঘব বোয়ালদের কথা তো ছেড়েই দিন।
“বাগচিদা, কলকাতায় একটা ফ্ল্যাট কিনে ফেল। এখন না থাকলে ফেলে রেখে দেবে। পরে তোমার মেয়ে বড় হলে একা একা (পড়ুন নৈশজীবন) কাটাতে পারবে”।
“দশকাঠা জায়গা কিনে রেখে ফেলে রেখে দিন ডাক্তারবাবু। জমি আর সোনা। এদের দাম দিন দিন বেড়েই যায়”।
“এস বি আই –এর নতুন স্কিম এসেছে। ২০ লাখ টাকা এককালীন দিন। ২০ বছর পর আপনাকে আর চিন্তা করতে হবে না”। এরা তো নিরন্তর আছেই।
জানি ওরা কেউই খুব মিথ্যে বলছে না। এদের যুক্তিগুলোও ঠিক। কিন্তু এতদিন বাদে আমার মনে হচ্ছে এইসব তুচ্ছ আর্থিক নিরাপত্তার ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে এসে বেঁচে থাকার মন্ত্র আমি যেন শিখে গেছি। সেটা আমার পেশা বাদে কিছুটা আমার লেখালেখির জগৎ, আর কিছুটা প্রকৃতির মগ্ন ঐশ্বর্যে ডুবে থাকার, আত্মগত হয়ে থাকার অবকাশ।
বিগত পাঁচ-ছয় বছরে হিমালয় আর বনজঙ্গলের মধ্যে নিজেকে মুক্ত করে দিয়ে দেখেছি আমার লেখা চিঠি প্রতিবার সঠিক ঠিকানায় পৌঁছে গেছে। আমার এই সামান্য কয়েক বছরের বন্যজীবন আমাকে এতটাই শান্তি ও আনন্দ দিয়েছে যে আমার মনে হয় আজই যদি আমাকে চলে যেতে হয় তবু জীবনের কাছে আমার কোনো অভিযোগ নেই- জীবনের কাছে এর মধ্যেই আমি অনেক ঋণের বোঝায় জড়িয়ে বসে আছি।
তাই আপাতত জমি-জায়গা দরকার নেই, SUV-XUV কোনোটাই দরকার নেই। দরকার নেই দক্ষিণ কলকাতা বা রাজারহাটের ফ্ল্যাট। যে ডাক্তারবাবুরা বিলাস ও বিত্তের যৌথ ফাঁদে জড়িয়ে পড়ে সারাদিন পাগলের মত এ চেম্বার থেকে ও চেম্বার, এই নার্সিং হোম থেকে ওই নার্সিং হোম করে বেড়াচ্ছেন তাঁদের আমি শ্রদ্ধা করি, তাঁদের কর্মসংস্কৃতিকে মান্যতা দিই, তবে তাঁরা আমার রোলমডেল নন।
বরং যারা দু-পয়সা জমলেই বনে জঙ্গলে পাহাড়ে বেরিয়ে পড়েন। অভিযাত্রীর নেশা যাদের রক্তে আমি তাদেরই দলে। যারা দিনের অনেকটা সময় নিজের প্রফেশনের বাইরে অন্য বিষয়ে জ্ঞান সংগ্রহ ও চর্চার জন্য রাখেন- আমি তাদের মত ‘আনপ্রফেশনাল’। তারাই আমার রোল মডেল।
সবার শেষে যা না বললেই নয় তা হল আমার এই বেয়াড়া ও অনিশ্চিত জীবনযাপন যে কল্যাণীর কল্যাণে সম্ভব হচ্ছে তিনি আমার অর্ধাঙ্গিনী। তিনি আমার জন্য কত যে ত্যাগ করে চলেছেন তার ফিরিস্তি দিতে হলে রায় ও মার্টিনের কোয়েশ্চেন ব্যাঙ্ক হয়ে যাবে। তিনি এই বারো বছরের জীবনে আমার পকেট থেকে চার আনাও ঝাড়েন নি কিন্তু সেই কৃতজ্ঞতায় আমি তাকে প্রতিবার পুজোয় একটি শাড়ি বই অন্যকিচ্ছুটি দিই নি। পটি করতে গিয়ে বিয়ের আংটিটি বারাকপুর মিউনিসিপালিটিকে দান করার পরেও আমি তাকে নতুন কোনো আংটি কিনে দিই নি।
সে কিছুই চায় না। শুধু চায় একক ও একমুখী প্রেম। কিন্তু মেরে দিল তো বেচারা হ্যায় ইয়ার। এই মন এতজনে, এতস্থানে ছড়ানো যে তাঁর ভাগে শেষ পারানির কড়িটুকুই পড়ে থাকে।
জীবনে তাঁর আরেকটি শখ ছিল। বরের বাইকের পেছনে বসে কোমর বা কাঁধ জড়িয়ে ধরবে। কল্যাণী রোড দিয়ে বাইক হু-হু করে ছুটে চলবে। তার চুল পাগল হাওয়ায় উড়বে। লাল লালা লা, লাল লালা লা…। সে সাধও তার অপূর্ণ থেকে গেল। তাঁর ‘কৃষ্ণেন্দু’ বাইকই চালাতে পারে না।
তাই সে আর কী করবে? সব কিছু ‘মুখ বুজে’ সহ্য করে চলেছে। কখনও প্রেম উত্তুঙ্গ হলে বলবে, “এর থেকে তুমি সাধারণ চাকুরে হলে আমার অনেক লাভ হত। একে ব্যস্ত ডাক্তার, তারপরে লেখক, তারপর ট্রেকার, সবশেষে ফটোগ্রাফার! তোমার এত কিছুর ইচ্ছের ফাঁকে আমি নিজেই হারিয়ে যাচ্ছি”।
একদম সত্যি কথা। প্রতিটি শব্দ বর্ণে বর্ণে খাঁটি। কিন্তু কী আর করা যাবে বলুন? শুধু রোল মডেলরাই যে চাপে থাকেন তা নয় তাদের বউদেরকেও প্রচুর আত্মত্যাগ করতে হয়।
(শেষ)