ইংরাজীতে একটি প্রবাদ আছে ‘Throwing the baby out with the bathwater’– স্নানের নোংরা জল ফেলতে গিয়ে বাচ্চাটাকেই বাইরে নিক্ষেপ করা—অকর্মণ্যতা ও দুর্নীতির অভিযোগে MCI (Medical Council of India)–কে আবর্জনার স্তুপে ফেলে নতুন সংস্থা NMC (National Medical Commission)–গঠনের প্রক্রিয়া—সেই প্রবাদটিকেই মনে করিয়ে দেয়। আসল জিনিষ্টাই বাদ চলে গেলো না তো?
১৯৩৩ সালের আইন বলে ১৯৩৪-এ বৃটিশ ইন্ডিয়ায় MCI–র জন্ম। স্বাধীন ভারতে ‘Indian Medical Council Act’ 1956–দ্বারা তা আরও দৃঢ়প্রতিষ্ঠ হয়। তারপর থেকে এতদিন ধরে সারা ভারতে মেডিকেল শিক্ষার পাঠ্যসূচী গঠন, মেডিকেল কলেজগুলিকে স্বীকৃতি দান ও নিয়ন্ত্রণ, মেডিকেল ডিগ্রীর মান নির্ণয় ও রেজিস্ট্রেশন এবং তার সঙ্গে বিদেশী মেডিকেল ডিগ্রীর সমন্বয়—এ সমস্ত কাজই করে এসেছে MCI।
তাহলে কী কারণ ঘটলো যে, MCI-কে সরিয়ে দেওয়া এতো জরুরী হলো যে সারা ভারতের সমস্ত চিকিৎসকবৃন্দের প্রতিবাদ, বিরোধিতা এবং আই.এম.এ-(Indian Medical Association)-র সারা ভারতব্যাপী কর্মসূচী ও বিক্ষোভকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে তার বিলোপ করতে হলো? এর আগেও বিভিন্ন সময়ে MCI-র কার্য্যসমিতি ভেঙ্গে সরকার মনোনীত প্রার্থীদের নিয়োগ করা হয়েছিলো, তার মধ্যে একবার সুপ্রীম কোর্টের নির্দেশে, ২০১০ সালে। ২০১৬ সালে সুপ্রীম কোর্ট প্রাক্তন বিচারপতি শ্রী আর. এম. লোধাকে নিয়োগ করেন MCI-র কার্য্যকলাপ দেখাশোনার(Supervision) জন্য।
সুপ্রীম কোর্টের নির্দেশেই “Expert Committee” তৈরী হয়। Prof. Ranjit Roychowdhury-র নেতৃত্বে গঠিত “Expert Committee” ছোট পরিচালনা কমিটির পক্ষে রায় দেয়। এই কমিটি MCI–র কাজের বিভিন্ন ত্রুটি বিচ্যুতিও তুলে ধরে। সরকার এর অপেক্ষাতেই ছিলো—সম্পূর্ণ আমলাদের দ্বারা একটি কমিটি তৈরী হয়। শ্রী অরবিন্দ পানাগাড়িয়া, নীতি আয়োগের ভাইস-চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে এই কমিটিতে আরও তিনজন ছিলেন—১) শ্রী পি.কে. মিশ্র, প্রধানমন্ত্রীর উপ-মুখ্যসচিব, ২) শ্রী ভানুপ্রতাপ শর্ম্মা, কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যসচিব, ৩) শ্রী অমিতাভ কান্ড, সিইও, নীতি আয়োগ।
–লক্ষ্যণীয় এই কমিটিতে কোনও চিকিৎসকের উপস্থিতি ছিল না। তাঁরা বলেন যে, তাঁরা কয়েকজন বিশিষ্ট চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করেছিলেন—ফলশ্রুতি বর্তমান NMC যা সম্পুর্ণরূপে প্রতিস্থাপিত করলো MCI-কে।
কয়েকটি বিষয় এবার পরিষ্কার করে নেওয়া উচিত—
১) পুরানো MCI-এর গঠন পদ্ধতি কী ছিলো?
২) MCI-এর বিরুদ্ধ মূল অভিযোগগুলি কী কী?
৩) NMC-এর প্রস্তাবিত গঠন পদ্ধতি কী?
৪) NMC কী MCI–এর ত্রুটিগুলির দূর করতে সর্বতোভাবে সফল হতে পারবে?
৫) NMC-তে উপকৃত কারা হলো—সাধারণ মানুষ, মেডিকেল শিক্ষা ও শিক্ষার্থী না অন্য কেউ? NMC –তে বাড়তি কি আছে যা MCI তে নেই?
পুরানো MCI –র গঠনপদ্ধতি কী ছিলো?
স্বাধীন ভারতে ১৯৫৬ সালে MCI নতুন আইন প্রণয়নের মাধ্যমে পুনর্গঠিত হয়। মেডিকেল শিক্ষার বিভিন্ন সমস্যা মোকাবিলায় এই আইন বারে বারে সংশোধিত ও পরিবর্ধিত হয়েছে। ১৯৬৪,১৯৯৩,২০০১, ২০০৩, ২০০৬—এমনকি ২০১৪ সালেও এই আইনের বিভিন্ন পরিবর্তন (Amendments) ঘটেছে।
একটা ধারণা তৈরী করার চেষ্টা হচ্ছে যে MCI-কে পরিবর্তন করা অসম্ভব। এটা কিন্তু একেবারেই ঠিক নয়। বিভিন্ন সময়ের পরিবর্তন বরং মেডিকেল শিক্ষার অগ্রগতির সঙ্গে সমন্বয় সাধনের চেষ্টারই প্রতিফলন এই সমস্ত amendments, সর্বশেষ MCI-এর চেয়ারপার্সন ছিলেন ডাঃ জয়শ্রী বেন মেহতা (MCI –র ইতিহাসে তিনিই সর্বপ্রথম মহিলা চেয়ারপার্সন- সর্বশেষও বটে) তার সময়ে কাউন্সিল সদস্য ছিলেন সর্বমোট ১০৩ জন—তার মধ্যে রাজ্য সরকারগুলির প্রতিনিধি ছিলেন ২৬ জন। কেন্দ্রীয় শাসিত অঞ্চলের প্রতিনিধি ছিলেন ১ জন। এঁরা মনোনীত সদস্য।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলি (University) থেকে নির্বাচিত সদস্য ৪৯ জন, বিভিন্ন রাজ্যের Registered Medical Graduates থেকে নির্বাচিত ১৯ জন।
কেন্দ্রীয় সরকারের মনোনীত প্রার্থী ৮জন।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য, কিছু বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজ্য থেকে প্রতিনিধির পদ শূন্য ছিল বিভিন্ন কারণে। অর্থাৎ মনোনায়নের পাশাপাশি নির্বাচিত প্রতিনিধির স্থানও MCI-তে কম ছিলো না। চেয়ারপার্সন ও ভাইস চেয়ারপার্সন নির্বাচিত হন কাউন্সিলের প্রতিনিধিদের দ্বারা। সর্বশেষ কমিটিতে ভাইস-চেয়ারম্যান ছিলেন ডাঃ সি. ভি. ভিমানন্দন। Executive Committee-তে ছিলেন ১০ জন। এছাড়া Administrative and Grievance, Ethics, Finance, Non Migration, Registration, PG monitoring, UGC monitoring ইত্যাদি বিভিন্ন Sub–Committee ছিলো।
একটা কথা মনে রাখতে হবে ১৯৩৪ থেকে শুরু করে স্বাধীনতা উত্তর ভারতবর্ষে ৬০ বছর (২০১৭ সালে সুপ্রীম কোর্টের অনুমতিক্রমে MCI–এর দায়িত্ব ৫ জন মনোনীত চিকিৎসকের হস্তে অর্পণ করা হয় এবং ২০১৯ সালে এর অবলুপ্তিই ঘটে) মেডিকেল শিক্ষার সঙ্গে ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলো Medical Council of India, বহু প্রথিতযশা চিকিৎসক ও শিক্ষকের নিরলস অধ্যবসায় ও নিষ্ঠাকে কিন্তু এককথায় উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বিভিন্ন সময়ে MCI–এর বিরুদ্ধে ওঠা সমালোচনাগুলির মধ্যে নিশ্চয়ই বেশ কিছু সারবত্তা আছে। কিন্তু, তাতে তো আর MCI –এর সঠিক কার্যগুলি বা উজ্জ্বল দিকগুলি নস্যাৎ করা যায় না।
MCI –এর বিরুদ্ধে মূল অভিযোগগুলি কী কী?
১) দুর্নীতি (Corruption)—২০১০ সালে MCI-এর চেয়ারম্যান থাকাকালীন CBI ডাঃ কেতন দেশাইকে গ্রেপ্তার করে একটি বেসরকারী মেডিকেল কলেজের কাছ থেকে ২ কোটি টাকার ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে। সুপ্রীম কোর্টের নির্দেশে তাঁকে চেয়েরম্যান পদ থেকে অপসারণ করা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে এই ধরনের অভিযোগ আরও ছিলো। MCI একটি আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত সংস্থা এবং তা ডাঃ কেতন দেশাই ও তাঁর সহযোগীদের কুক্ষিগত – এটাই ছিলো MCI কে অবলুপ্তি ঘটানোর প্রধান কারণ। পরবর্তীকালে, কয়েক বছর MCI পরিচালিত হয় সরকার মনোনীত গভর্নরদের দ্বারা। কিন্তু MCI-এর উপর থেকে দুর্নীতিগ্রস্ত তকমাটা আর তুলে নেওয়া হয়নি। অর্থাৎ একটি ব্যক্তি ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের দুর্নীতির অভিযোগের দায়ে একটা সংস্থা উঠেই গেলো। যদিও এখনও পর্য্যন্ত কোনও কোর্টেই ডাঃ দেশাই-এর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি এবং CBI সেই কেসগুলি নিয়ে এই মুহুর্তে খুব আগ্রাহান্বিত, এমনও ঘটনা নয়। তাছাড়া, MCI–এর ইতিহাসে সদস্য ও চেয়ারম্যান হিসাবে বহু বিখ্যাত ও কৃতী চিকিতসক তাদের যথাযযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে কাজ করেছেন। তাঁরা সবাই চলে গেলেন বিস্মৃতির অন্তরালে। মনে রইলো, শুধু একটা নাম – ডাঃ কেতন দেশাই।
২টি বক্তব্য অবশ্যই রাখা উচিৎ, কোনো প্রতিষ্ঠানের প্রধান যদি দুর্নীতিতে অভিযুক্ত হন, তাহলে কী প্রতিষ্ঠানকেই তুলে দিতে হবে? কিছু প্রশ্ন প্রাসঙ্গিক মনে হয়।
- তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী দুর্নীতির অপরাধে কারারুদ্ধ হন। তামিলনাড়ুর বিধান্সভা, মন্ত্রীসভার কি বিলোপ সাধন হয়েছিল?
- কর্ণাটকের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী দুর্নীতির অভিযোগে অপসারিত হল এবং তাঁর দল তাঁকে দল ছাড়তে বাধ্য করে। তিনি আবার পুরানো দলের প্রধান হিসাবে মুখ্যমন্ত্রীপদে ফিরে এসেছেন। কোনও সাংবিধানিক সংকট হয়েছে কী? এর জন্য সমস্ত বিধানসভাকেই অবৈধ ঘোষণার দাবী উঠেছে কী? প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য এই সমস্ত দুর্নীতির অভিযোগ কিন্তু ২-৩ কোটির নয়। কয়েকশ বা কয়েক হাজার কোটি টাকার।
- শুধু বিভিন্ন রাজ্যে নয় কেন্দ্রেও বহুবার মন্ত্রী এবং এমন কী প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগ এসেছে এবং অনেক ক্ষেত্রে মান্যতাও পেয়েছে। MP, MLA, কাউন্সিলর, পঞ্চায়েত সদস্য, সর্বত্র ভুরিভুরি দুর্নীতির অভিযোগ আছে। ভারতের পুরো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা তুলে দেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে কী?
- কোন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান দুর্নীতির জন্য ভেঙ্গে দিয়ে পুরো আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু করলেই দুর্নীতি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে? ভারতবর্ষে আমলাতন্ত্র ও দুর্নীতির পারস্পারিক অবস্থান কী বলে?
দুর্নীতির অভিযোগে MCI উঠে গেলো, কিন্তু ডাঃ কেতন দেশাই, তার কী হলো?
ডাঃ কেতন দেশাইকে সমর্থনের কোনও প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু এটাও তো ঠিক তাঁর বিরুদ্ধে এখনও পর্যন্ত কোনও অভিযোগই প্রমাণিত নয়। আর প্রমাণিত না হলে, ভারতীয় আইন অনুযায়ী কী কাউকে অপরাধী বলা সম্ভব?
CBI কর্তৃক গ্রেপ্তারীর পরে, পরবর্তী MCI কর্ত্তৃপক্ষ তাঁর ডাক্তারীর রেজিস্ট্রশন বাতিল করে দেয়, ডাঃ দেশাই সেই সময়ে World Medical Association–এর দায়িত্ব নিতে যাচ্ছিলেন। MCI–এর ঐ নির্দেশের ফলে তখনকার মতো তা বাতিল হয়। রেজিস্ট্রেশন বাতিলের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে Gujrat State Medical Council, কারণ সংশ্লিষ্ট ডাক্তারের নাম নথিভুক্ত বা Registered থাকে তার প্রাদেশিক Medical Council –এ, MCI –তে নয়। পরবর্তীকালে, গুজরাট বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট সদস্য হিসাবে মনোনীত হন ডাঃ দেশাই—অবশ্যই গুজরাট প্রদেশের ক্ষমতাবানদের সমর্থনে। পরবর্তীকালে, তিনি আবার ২০১৬-১৭ সালে, World Medical Association –এর President পদে আসীন হন। ওট্মার ক্লোয়েবার (Obnar Kloiber), যিনি WMA-র Secretary General, বলেন “To our knowledge, there is no charges against him – They Have all been dropped” পরে এও যোগ করেন, “There is no proof. Send me proof and I don’t want to see newspaper clippings of which I already have many”. (সূত্র – Article in news minute website). WMA –র মুখপাত্র নাইজেল ডাঙ্কান (Nigel Duncan) ও বলেন, “In our knowledge all criminal charges have been dismissed against Dr. Desai.” বর্তমানে, ডাঃ দেশাই গুজরাট State Medical Council –এর সদস্য—যাঁর জন্যই নাকি একটা সংস্থা উঠে গেলো, তিনি তো রইলেন বহাল তবিয়েতেই—হিসাবটা কী আদৌ মিললো?
২) স্বার্থ সংঘাত (Conflict of interest)
Expert Committee-র রিপোর্ট অনুযায়ী MCI –এর সদস্যদের একটা বড় অংশ বেসরকারী প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার সঙ্গে যুক্ত। সুতরাং স্বার্থ–সংঘাতের একটা বড় সম্ভাবনা থেকেই যায়। স্বার্থ-সংঘাত বা ‘Conflict of interest’ তো সর্বক্ষেত্রেই আলোচ্য বিষয়। সেক্ষেত্রে অন্যান্য সমস্ত ক্ষেত্রে যা যা নিয়ম পালন করা হয়, তা এখানে চালু করতে অসুবিধা কোথায় ছিলো? ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড তো দুর্নীতির জন্য চরম সমালোচিত হয়েছে। প্রেসিডেন্ট অপসারিত হয়েছে। বোর্ড ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ক্রিকেট বোর্ড BCCI তো বিলুপ্তি হয়নি, নিয়মের শৃঙ্খলে বাঁধার চেষ্টা হয়েছে—সে চেষ্টা MCI তে করতে অসুবিধা কী ছিলো? জনগণের কোনও অংশ বা চিকিৎসকদের কোন অংশ কি কখনও দাবী করেছে, MCI –র অবলুপ্তির জন্য আন্দোলন করেছে, তাও তো জানা নেই—অন্ততঃ কোনও রাজনৈতিক দলের ইস্তাহার বা দাবীসনদে এরকম কোন কথা আছে বলে তো শুনিনি।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য, ২০১৬ সালে, সুপ্রীম কোর্টের নির্দেশে প্রাক্তন বিচারপতি শ্রী আর এম লোধার নেতৃত্বে একটি কমিটি MCI –এর কার্য্যকলাপ দেখার জন্য নিযুক্ত হয়। ২০১৫ সালে, এই শ্রী লোধার নেতৃত্বে একটি কমিটি আই.পি.এল. কেলেঙ্কারী ও বিসিসিআই-এর কার্য্যকলাপের অনুসন্ধানে গঠিত হয়। সংস্কারসহ বিসিসিআই থেকে যায় আর MCI বিলুপ্ত হয়। MCI –এ দুর্নীতির অভিযোগ ছিলো কয়েক কোটির আর বিসিসিআই ও আই.পি.এল-এ এই অঙ্কটার পরিমাণ বিশাল। অথচ বিসিসিআই-এ চিকিৎসা ওষুধে (Medicinal) আর MCI তে Total Excision (Surgical)। খুব অদ্ভুত না!!
৩) অকর্মণ্যতা বা অপদার্থতা (Inefficiency)
আজকাল একটা কথা খুব বেশী শোনা যায়। বিভিন্ন রাজনৈতিক স্তরে, রাজ্যে ও কেন্দ্রে—‘বিগত বছরগুলিতে কিছুই কাজ হয়নি’। বিগত বছরগুলি বলতে অনেক ক্ষেত্রে একাধিক দশক বা স্বাধীনতা – উত্তর পুরো সময়টাই ধরা হয়। সাধারণভাবে মানুষ সবসময়েই বিভিন্ন সরকারী ও আধাসরকারী কাজের উপর অসন্তুষ্টই থাকে। সুতরাং, এই ভাষ্য একটা চটজলদি অনুমোদন পেয়ে যায়। কিছুই হয়নি বলার একটা সুবিধা আছে কারণ সেক্ষেত্রে কিছু জানারও দরকার হয় না নির্দিষ্টভাবে কী কী হয়েছে বা হয়নি। এক কথায় সব উড়িয়ে দেওয়া যায় অনায়াসেই বস্তুতঃ কোনওরকম জ্ঞান ছাড়াই (কিছু ক্ষেত্রে অবশ্য জ্ঞান থাকলেও সজ্ঞানে তা চেপে যাওয়া যায় কোনও বিশেষ উদ্দেশ্যে)। এবার অন্য পক্ষ ভেবে ভেবে বলুক কী কী হয়েছে। অবশ্যই যুক্তির অবতারণা করতে হবে। কিন্তু মুশকিল হলো, বর্তমান ভারতবর্ষে এই যুক্তি ( বা সসুযুক্তি) –র হাল সবচেয়ে খারাপ। মাননীয় অমর্ত্য সেন বৃথাই ভারতীয়দের তার্কিক (Argumentative) আখ্যা দিয়েছিলেন। সেসব অতীতের কথা। আজকের ভারত শুধু বিশ্বাস করতে, ভরসা রাখতে চায়—তর্ক বহু দূরে।
MCI –র বিরুদ্ধে এক বড় যুক্তি হলো MCI কিছুই কাজ করেনি। স্বাধীনতার পরে, এই উপমহাদেশে মেডিকেল কলেজ ও সস্কুল মিলিয়ে ছিল ২৮ টি—যার মোট আসন সংখ্যা ২০০০-এর কাছাকাছি। সব ধরনের ডাক্তার মিলিয়েও তার সংখ্যা ৫০০০০-এর বেশী নয়। আর আজ মেডিকেল কলেজের সংখ্যা ৫২৯ টি (সরকারী ও বেসরকারী, প্রায় আধাআধি সংখ্যায়)। সারা দেশে ডাক্তারের সংখ্যা দশ লক্ষের কিছু বেশী, দেশে বিদেশে ভারতীয় চিকিৎসকদের উৎকর্ষতা অবশ্যই স্বীকৃত। এমনকি, উন্নত দেশগুলি থেকে মানুষেরা যে এখানে চিকিৎসার জন্য আসেন, তা কেবলমাত্র সস্তায় হয় বলে নয়—নিশ্চয়ই উৎকর্ষতা বজায় আছে বলেই। বিভিন্ন দেশে ভারতীয় চিকিৎসকদের শ্রদ্ধার সঙ্গেই দেখা হয়। ব্রিটেনের National Health Service-এর বহুদিন ধরেই একটা বিরাট স্তম্ভস্বরূপ হয়ে রয়েছে ভারতীয় চিকিৎসকরা। MCI –কিছুই না করলে, চিকিৎসকরা নিজে নিজেই ভালো হয়েছে? দেশের ক্ষেত্রেও, সরকারের ভূমিকা থাকলেও চিকিৎসকদের কাজের অবদান তো কখনই কম নয়, ১৯৫১ সালের জনগণনায়, আনুমানিক আয়ু (Life expectancy) ছিলো ৩২ বছর, infant mortality rate 145.6 per thousand delivery, MMR (Maternal Mortality Rate) প্রতি লক্ষে এক হাজারের বেশী (১৯৪০ সালে, যা ছিলো ২০০০-এর উপরে)। আর ২০১৫ সালে, আনুমানিক আয়ু ৬৮ বছর, IMR ৩৮ প্রতি হাজারে। MMR ১৭৪ প্রতি লক্ষে। সারা বিশ্বের তুলনায় যদিও পেছিয়ে পড়াদের মধ্যেই পড়ে অন্ততঃ শেষ ২ টির পরিসংখ্যান, কিন্তু এর কৃতিত্ব তো এক কথায় উড়িয়ে দেবার মতো নয়।
4) বড় চেহারা (mega Size)
Expert Committee-র মতে MCI –র বড় আকার (সদস্য সংখ্যা ১০০-র বেশী) তার কাজের অন্তরায়। সেজন্য দ্রুত কাজের জন্য ছোট কমিটি প্রয়োজন। MCI কাজ করছে না করেনি তো সেটাই মূল বিচার্য্য বিষয়। সদস্য সংখ্যা কমালেই কাজ ভালো হবে, এ চিন্তাধারা তো গণতন্ত্রের পক্ষে সমূহ বিপজ্জনক।
………গণতন্ত্রের ধারণা তো ভারতবর্ষে নতুন নয়। বুদ্ধ ও মহাবীরের সমসাময়িক অবস্থায় লিচ্ছবি, শাক্য, মল্ল, কোশল প্রভৃতি রাজ্যে জনগোষ্ঠীগুলিই সর্বসম্মতভাবে রাজ্য পরিচালনা করতো—রাজার ভূমিকা ছিলো মূলতঃ গোষ্ঠীপতির। বৈশালী রাজ্যে শোনা যায় জনগোষ্ঠী প্রতিনিধি ছিলেন ৭৭০৭। এই ‘মহাজনপদ’ গুলি কিন্তু কয়েকশ বছর টিঁকে ছিলো। …পাশ্চাত্য ধারা অনুযায়ী ও ভারতবর্ষে কেন্দ্রীয় আইনসভা ও রাজ্যগুলির সংসদীয় ক্ষেত্রে যথেষ্ট পরিমাণ আসন সংখ্যা কাজের অন্তরায় ঘটাচ্ছে বলে তো কোনওদিন শুনিনি। হয়তো, এর পরে শুনতে হতেও পারে।
প্রসঙ্গত, বর্তমান NMC –তে মূল কমিটিতেই আছে ৩৩ জন। আর বিভিন্ন বোর্ড ও অ্যাডভাইসারি কাউন্সিল নিয়ে সংখ্যাটি খুব কম হবে না।
৫) Inspector Raj
একটা বড় অভিযোগ ছিলো MCI মূলতঃ ‘Inspector Raj’ চালাতো। নীতি আয়োগের ভাইস চেয়ারম্যান শ্রী পানাগাড়িয়া কমিটির রিপোর্টেও এর উল্লেখ আছে। কিন্তু, বাস্তব অবস্থাটা কী? সরকারী বেসরকারী মেডিকেল কলেজগুলোতে শিক্ষকের অভাব, অন্যান্য স্টাফের অপ্রতুলতা, শিক্ষার প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও পরিবেশগত কাঠামোর বিশৃঙ্খলা অবস্থা—এতো সর্বজনবিদিত। সরকারী মেডিকেল কলেজগুলিতে অন্ততঃ রোগীর অভাব নেই। কিন্তু বেসরকারীতে ভাড়া করে রোগী আনতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে ডাক্তারও সেইভাবে আনা হয়। সরকারী মেডিকেল কলেজে পরিদর্শনের সময়ে অন্য মেডিকেল কলেজ থেকে কয়েকদিন বা কয়েক সপ্তাহের জন্য শিক্ষক নিয়ে এসে কোনও রকমে সামাল দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। কোনও ব্যাপারই স্বাস্থ্যকর বা পরিচ্ছন্ন বলা যাবে না। তাহলেও, পরিদর্শনের ভয়ে অন্ততঃ কিছু কাজ তো করতেই হয়। সবটাই ছলচাতুরী দিয়ে ঢাকা দেওয়া যাবে। এ তো সম্ভব নয়। তাহলে, পরিদর্শনের বিরুদ্ধে বক্তব্য কী? প্রচ্ছন্ন একটা বক্তব্য আছে যে, এইসব পরিদর্শনে টাকার হাতবদলের ব্যাপার আছে। কিন্তু টাকার হাতবদলের জন্য পরিদর্শন, সত্যিই খুব জরুরী? আজকাল তো নেতা-মাফিয়া সবাই ঘরে বসেই দূরভাষের মাধ্যমে ব্যাপক উপার্জন করছে—তার জন্য তো তদের দোরে দোরে ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে না। এই ‘Inspector Raj’ কে অপসারণ করে NMC এখন কোন রাজ নিয়ে আসে, তাই দেখার বিষয়।
(চলবে)