গাঁয়ের মোড়ল বিচার করে বলে তাকে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি বানিয়ে দিলে কেমন হবে? গরুর গাড়ি চলে বলে তাতে করে নিউ মার্কেট থেকে নিউ ইয়র্ক যেতে গেলে কেমন হবে?
না, না.. রোববার দুপুরে বদহজম হয়নি। সত্যিই এমনটা হতে চলেছে। সরকার নোটিশ জারি করেছেন এবার থেকে আয়ুর্বেদবাবুরা আধুনিক সার্জারিতে প্রশিক্ষণ নিয়ে এম.এস হতে চলেছেন। যাঁদের মডার্ন মেডিসিনের ন্যূনতম ধারণা নেই, যাঁদের চিকিৎসা পদ্ধতি এখনও গোমুত্রে নিমজ্জিত, যাঁদের কাছে রোগের মূল কারণ বায়ু-পিত্ত-কফ.. সেই তাঁরা এবার জেনারেল সার্জারি, ইএনটি, মুখ-দাঁতের অপারেশন ইত্যাদি করতে শুরু করবেন। অর্থাৎ, সোজা বাংলায় বললে ক্রসপ্যাথিতে সরকারি শিলমোহর পড়ছে। সরকারি মদতে হাতুড়ে বানানোর প্রক্রিয়া শুরু হবে এবার।
দয়া করে ৫০০০ বছরের ঐতিহ্যের ঢেকুর শোনাবেন না। সুশ্রুত বা চরক তাঁদের সময়ে যা করেছেন সেটা অভাবনীয় কিন্তু সেটা দিয়ে আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যার ‘আ’ টুকুও শেখা যায় না। অবশ্য, যদি আপনি গণেশের মুন্ডুকে প্লাস্টিক সার্জারি কিংবা পুষ্পকরথকে এরোপ্লেন ভেবে ফেলার অসামান্য কল্পনাশক্তির অধিকারী হ’ন তাহলে আলাদা কথা। চর্যাপদের রচয়িতার পক্ষে শক্তি চাটুজ্জ্যের কবিতা লেখা সম্ভব না, সে যতই তার ঐতিহাসিক মূল্য থাক। বিজ্ঞান আবেগে চলে না। আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যার প্রতিটি গাইডলাইন কিছুদিন ছাড়া ছাড়া বদলে যায়। পাশ করা ডাক্তারকেও নিয়মিত নিজেকে গড়ে তুলতে হয়। সে জায়গায় কিছু অপবিজ্ঞান বা অর্ধ-বিজ্ঞানকে তুলে এনে আধুনিক খোলস পরিয়ে দিলে সেটা গাধার গায়ে কালো-হলুদ ডোরা দেওয়া ছাড়া কিচ্ছুটি নয়! সারা পৃথিবীর আর কোথাও এরকম বকচ্ছপ ডাক্তার বানিয়ে জনগণের স্বাস্থ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হয় না।
এই যে করোনা আবহে কিছু মিডিয়া আর হুজুগেদের কল্যাণে আর্সেনিকাম অ্যালবাম কিংবা জড়িবুটি ক্কাথ শিরোনামে উঠে এসেছিল তার ফলাফল কী দাঁড়ালো? মাঝখান থেকে কয়েক গ্যালন অ্যালকোহল ফোঁটা আর কয়েক টন রসুন বিক্রি হয়ে গেল। যাঁরা গোমুত্র, জমজম পানি কিংবা অ্যালকোহল ফোঁটায় রোগ সারানোর কথা বলেছিলেন সেই ন্যাতামোন্তীরাও শেষমেশ ঘাড় মুড়ে মডার্ন মেডিসিনের দ্বারস্থ হলেন। আর একটা বাণী দিচ্ছি, নোট ইট.. কোনও ন্যাতামোন্তী, উচ্চবিত্ত ব্যবসায়ী কিংবা শহুরে শিক্ষিত লোক এসব হাঁসজারু সার্জেনদের কাছে যাবেন না। তাঁদের জন্য কর্পোরেট হাসপাতালের বেডটা বুক থাকবে। তাহলে যাবে কারা? যাবে জঙ্গলমহলের ফুলমণি টুডু, যাবে সুন্দরবনের সনৎ মিস্ত্রি, যাবে পুরুলিয়ার কানু মাহাত। যাদের এতসব বোঝার ক্ষমতা নেই। যারা ভোটের লিস্টে একটা সংখ্যা শুধু। তাদের স্বাস্থ্যের দায়িত্ব নিতে রাষ্ট্রের ভারী বয়ে গেছে!
আরও একটা কথা সাফসাফ শুনুন.. মডার্ন মেডিসিনটাই সত্যিকারের আধুনিক চিকিৎসা। স্বাধীনতার সময়েও দেশের গড় আয়ু ছিল ৩২ বছর। মারী-মড়ক, ওলাউঠা, গুটি বসন্তে গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হয়ে যাওয়ার সময় কোনও জড়িবুটি কাজে আসে নি। সুস্থতা যেটুকু ছিল সেটা মূলত নির্মল দূষণহীন পরিবেশ, মানুষের কায়িক পরিশ্রম কিংবা খাদ্যাভ্যাসের জন্য। আজ যে রোগগুলো বাড়ছে সেগুলো জীবনশৈলী ঘটিত রোগ। আপনার হাতে মাউসের বদলে কোদাল আর বার্গারের বদলে শশা এলে সেগুলো কম হ’ত। পেনিসিলিন আবিষ্কারের পর থেকে আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যা যে দ্রুতহারে উন্নতির শিখরে গেছে সেটা বোধহয় বিজ্ঞানের অন্য কোনও শাখায় হয়নি। পৃথিবীর সমস্ত উন্নত দেশ যখন ওষুধ-বিজ্ঞানকে কোষের আরও গভীরে, অণু-পরমাণুর স্তরে নিয়ে যেতে চাইছে তখন এদেশে গোমূত্র আর অ্যালকোহল ফোঁটার সাধনা শুরু হচ্ছে। কিছু উদ্ভট নামের উল্লেখ করে ‘সবই ব্যাদে আছে’ টাইপ চিকিৎসা ব্যবস্থা এদেশেই সম্ভব। ল্যাপারোস্কোপিক সার্জারীর সময় পেটের মধ্যে হাওয়া ভরে নিতে হয়, যাকে বলে নিউমোপেরিটোনিয়াম। খুব ভয়ে ভয়ে আছি কোনদিন নিউমোপেরিটোনিয়ামের পরিভাষা শুনবো ‘বাতকর্ম’! অ্যানাস্থেশিয়া হবে গাঁজাপাতায়!
এমনিতেই দেশের জিডিপির মাত্র ১% স্বাস্থ্যখাতে খরচ হয়। অনাহার-অপুষ্টি-অশিক্ষাক্লিষ্ট দেশে যা রীতিমতো লজ্জার। এরপর সরকারি খরচে এসব জুড়িবুটি ক্রসপ্যাথ তৈরি হলে অবস্থা কী হবে সহজেই অনুমেয়। ধরুন, রাত্রে অসহ্য পেটেব্যথা.. ডায়াগনোসিস হ’ল অ্যাপেন্ডিসাইটিস। আপনি জানতে পারলেন আপনার সার্জেন এরকম জড়িবুটি ক্রসপ্যাথ। নির্ভয়ে পেট পেতে দেবেন তো?
আমি ভারতবর্ষের সচেতন নাগরিক হিসেবে এর প্রতিবাদ করছি। আপনিও পক্ষ নিন।
বেশ কথা বলেছেন। আমি নিশ্চিতরূপে আপনাদের পক্ষেই।
একটা কথা বলি, কিছু মনে করবেন না, কিছুদিন আগেই গ্রামের হাতুড়ে ডাক্তারদের একটা ব্রীজ করিয়ে চিকিৎসক হওয়ার জন্য একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছিলো। কলকাতা কিছু প্রথিতযশা ডাক্তারবাবু সরকারি হাসপাতালে দাঁড়িয়ে মুক্ত কণ্ঠে সমর্থন দিয়েছিলেন।তখন গেল গেল রব কিছু মুষ্টিমেয় ডাক্তারবাবুই তুলেছিলেন, বাকিরা একটি রা করেননি।
হয়তো বিলটি কথা আপনার মনে আছে অথবা নেই।
এটা ঠিকই ‘চিকিৎসা’ হবে নেই ভোটের মূল্যহীন মানুষকেই, গো মূত্র হোক বা হাতুড়ি!