ধূমপান করলে পা কেটে বাদ। সত্যিই চরম তালিবানি ব্যাপার স্যাপার।
খুপরি ছেড়ে আলিসান পলিক্লিনিকে গিয়েও হাতুড়ে ওভ্যেস ছাড়েননি। সেই পেঁকো খালপাড়ে সন্ধ্যাযাপন ওনার নৈমিত্তিক ব্যামো। সেদিনও সেই খালপাড়ের এক মশক গুঞ্জরিত ত্রিকোণ উদ্যানে বসে হাত পা নাড়ছিলেন (মশকহত্যার অনিবার্য তাগিদে) -এমন সময় দূরে একজন পাড়াতুতো ভদ্রলোককে দেখা গ্যালো। এটুকু জানা আছে ভদ্রলোক চমৎকার সব বাঙাল রান্না করেন। আসলে মা বাবাকে নিয়ে হাতুড়ে যখন ভাড়াবাড়িতে ছিলেন এবং হাত না পুড়িয়েই মা বাবার জন্য রান্না করছিলেন, তখন এই উত্তম ভদ্রলোকটি চমৎকার সব রান্না করে করে পাঠাতেন।
ভদ্রলোক একটু হাঁটছেন আবার মুখ বিকৃত করে একটু দাঁড়াচ্ছেন। হাতুড়ের চোখ গম্ভীর হলো, ভ্রূপল্লবে কুঞ্চন জাগলো। ভদ্রলোক লোকাল ট্রেনের মতোন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আসছেন ক্যানো? কাছাকাছি এসে উনি দাঁড়ালেন এবং দেশলাইএ চকমকি তুলে একটা সিগারেট ধরালেন। সিগারেট শেষ করে বড়ো কষ্টে বাকি পথটা পার হয়ে চারটে কেঠো পাত লোহা দিয়ে আটকানো বেঞ্চিতে বসলেন। হাতুড়ে উদগ্রীব হয়ে ওনার বক্তব্যের জন্য অপেক্ষা করতে থাকলেন। এই শরৎ সাঁঝের কম গরমেও ঘর্মাক্ত। রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মোছেন। “ভাই হাতুড়ে, বড়ো অসুবিধেয় পড়েছি ভাই”
হাতুড়ে জিজ্ঞাষু হয়ে তাকিয়ে থাকেন।
“একটু হাঁটলেই পায়ে অসম্ভব ব্যথা হচ্ছে… দাঁড়িয়ে পড়তে হচ্ছে।….আর রাতেও শুলে ব্যথা হয়….পা ঝুলিয়ে বসে থাকতে হয়….”
ভদ্রলোক আবার পকেট হাতড়ে সিগারেট বার করলেন, ধরিয়ে দেশলাই কাঠি সযত্নে দূরে ফেললেন।
হাতুড়ের সার্জারি বই ‘বেইলি & লাভ”য়ের একটা কথা মনে পড়লো “একজনের হাত পা কেটে(অ্যাম্পুট করে) বাদ গেছে, অন্য একজনকে সিগারেটটা ধরিয়ে দিতে অনুরোধ করছেন” হাতুড়ে শিউরে উঠে ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে অস্ফুটে প্রশ্ন করলেন
“কতো দূর?…কতটা হাঁটলে পায়ে ব্যথা হচ্ছে?”
“আগে প্রায় দুশো তিনশো মিটার মতো বিনা কষ্টে যেতে পারতাম….এখন দশ পা হাঁটলেই….পা ছিঁড়ে যায়… রাতেও পা ঝুলিয়ে বসে থাকি, নইলে অসম্ভব যন্ত্রণা…” ভদ্রলোকের মুখে শারীরিক কষ্ট তার সুতীব্র ছাপ রেখে গেছে।
“টাও (থ্রম্বো অ্যাঞ্জাইটিস অবলিটারেন্স), ডাকা হয় বার্জার’স ডিজিজ বলে”
“সেটা কি?”
“লিও বার্জার, নিউ ইয়র্ক, আঠেরোশো আশিতে জন্ম” হাতুড়ে ফিসফিস করেন “অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায়, সাহিত্যের ব্যাচলর ডিগ্রী, পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রী, তারপর এম.ডি করেন ঊনিশশো এক সালে। শিরা ধমনীর বিশেষজ্ঞ ছিলেন…”
“এগুলো কী বলছেন ভাই? এটা কী রোগ? আমার গিন্নীরও তো হাঁটলে পায়ে ঝিঁঝিঁ ধরে, অবশ হয়ে যায়, পড়েও যায়। আমারটা কি সেই রকম কিছু?”
কানে হিয়ারিং এইড লাগানো বীরেন স্টোভে বসানো চায়ের কেৎলি নিয়ে যাচ্ছিল। হাতুড়ে ওকে ডেকে দুটো লেবু চা দিতে বললেন। ভদ্রলোক আরেকটা সিগারেট ধরালেন। বাজ পাখির মতো ছোঁ মেরে হাতুড়ে সিগারেট কেড়ে নিয়ে পায়ে পিষে দুমড়ে মুচড়ে ফেললেন। উনি আহত বিষ্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। হাতুড়ে পাগল কিন্তু এরকম অভদ্রতা কোনও দিন করে নি। পাগলামি বোধহয় মাত্রাছাড়া হয়ে যাচ্ছে-ভেবে ভদ্রলোক বসে রইলেন। উশখুশ করলেও আবার সিগারেট ধরানোর সাহস হারিয়ে ফেলেছেন। বলা যায় না, যদি কামড়ে দ্যায়? দৌড়ে পালাতেও পারবেন না। চা পীতে পীতে কথা শুনতে থাকেন। চা শেষ হতেই হাতুড়ে ওনাকে চিৎপাৎ হয়ে শুতে বললেন। মাথার ওপরে হ্যালোজেন বাতি, খালপাড়ে ব্যাংয়ের অনৈসর্গিক ঘ্যানঘ্যানানি, ঝিঁঝিঁ পোকার (উই চিংড়ির) একঘেয়ে ডানা ঘসার শব্দ, তার মধ্যে ভীত সন্ত্রস্ত ভদ্রলোক লম্বা দিলেন। হাতুড়ে তীক্ষ্ণ চোখে ওনার পদযুগল পর্যবেক্ষণ করতে থাকলেন। “আপনার পায়ের আঙ্গুলগুলো কালচে হয়ে গেছে”
ভদ্রলোক সায় দিলেন। গোড়ালির কাছে বুড়ো আঙ্গুলের হাড় আর দ্বিতীয় আঙ্গুলের হাড় যেখানে শুরু হয়েছে সেখানে নিজের আঙ্গুল রেখে পালস দেখার মতো করে কি য্যানো অনুভব করতে চাইছেন (আর্টারিয়া ডর্সালিস পিডিস)। মনে হচ্ছে একেবারে বাঞ্ছারামের বাগানের ডাক্তার রবি ঘোষ। ঠিক ঐভাবে,রবি ঘোষের মতোই, হাতুড়ে স্বগতোক্তি করলেন “নাড়ি নাই!”। তারপর ভদ্রলোকের একটা পা ধরে সোজা কোমর থেকে তুলে ধরলেন।
ভদ্রলোক কাত্রে উঠলেন “আঃ তুলবেন না, বড্ড লাগে”
হাতুড়ে মহোদয় পা নামিয়ে রেখে বললেন “তুললেই আপনার পা আরও ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে”
উনি উঠে জানু চেপে ধরে পা দুটো ঝুলিয়ে দিলেন। “কী হয়েছে আমার? গিন্নীর মতো একই অসুখ?”
পকেটে হাত দিয়েও সিগারেট বার করলেন না হাতুড়ে। “আপনার যেটা হয়েছে সেটা ধমনী আর শিরার অসুখ। সিগারেট খেলে হাত আর পায়ের ধমনী শিরাগুলো বন্ধ হয়ে আসে। ক্রমশঃ হাত পায়ের রক্ত সঞ্চালন বন্ধ হয়ে আসে। হার্টের ধমনী বন্ধ হলে যেমন হাঁটলেই ব্যথা হয়, কেননা হার্টের কাজ বাড়লে বেশী অক্সিজেন দরকার হয়, তেমনি হাত পায়ের শিরা ধমনী বন্ধ হলেই কাজ করলে বা হাঁটলে হাত পায়ে তীব্র ব্যথা হয়, এই ঘটনাকে ক্লডিকেশন বলে। হার্ট অ্যাটাক বা মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন মানে হার্টের অক্সিজেনহীন টিস্যুর মৃত্যু এবং পচন, তেমনই এতেও শেষের দিকে হাত পায়ে পচন ধরে বা আরও পরে গ্যাংগ্রিন হয়। অবশ্য প্রথমে ঐ অংশের রং ক্রমশঃ কালচে বা নীলচে হয়ে আসবে।”
“আমার শুয়ে থাকলে কেন পায়ে ব্যথা হয়?”
“পা ঝুলিয়ে বসলে কমে যায়, তাইতো ঝুলিয়ে বসলেই অক্সিজেন সরবরাহ বেড়ে যায়। ক্রমশঃ আপনার হাঁটার ক্ষমতা কমে আসবে। একটু হাঁটলেই ব্যথা হবে। আপনি ব্যথাহীন যতটা পথ যেতে পারবেন, সেটাকে ক্লডিকেশন ডিস্ট্যান্স বলে। এই দূরত্ব ক্রমশঃ কমে আসবে।”
“এটা কি কোলেস্টেরল জমে হয়?” ভদ্রলোক উদ্বিগ্ন প্রশ্ন করেন।
“না গো দাদা। এটা তামাক থেকে হয়। বিড়ি, সিগারেট বা যে কোনও তামাক থেকেই হতে পারে। আর কিছু থিয়োরি আছে, ইমিনোলজি, এইচএলএ অ্যান্টিজেন….এই সব থেকে হয়। তাতে চিকিৎসার কিস্যু তফাৎ হয় না। এটা সবথেকে বেশী হয় ভারত, মধ্যপ্রাচ্য, জাপান, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায়। ভারতে মোট শিরা ধমনীর অসুখের মধ্যে প্রায় ষাঠ শতাংশই এই রোগে ভুগছেন।”
“এটার চিকিৎসা কিছু আছে?”
বীরেনদা ফিরছিলো। চেয়ে চিন্তে এক কাপ লিকার চা আমাদের চা চাতক হাতুড়ে পেলেন। “এর প্রথম চিকিৎসা হচ্ছে সম্পূর্ণ তামাক বর্জন। এর পর অ্যাঞ্জিওগ্রাম করে শিরা ধমনীর চিকিৎসা, লাম্বার সিম্প্যাথেক্টমি, পারকিউটেনিয়াস কেমিক্যাল সিম্প্যাথেক্টমি… আরও যষ চিকিৎসা আছে” হাতুড়ে সুকৌশলে অ্যাম্পুট করার কথাটা বাদ রাখেন।
অদম্য গৃহিণী প্রেমে উনি জিগ্গেস করেন “গিন্নীর কি হয়েছে?”
হাতুড়ে ইন্দ্রলুপ্ত (টাক) চুলকে বলেন “ওটা নিউরোলজিক্যাল ক্লডিকেশন, এটার কারণ সম্ভবতঃ এনট্র্যাপমেন্ট নিউরোপ্যাথি, বাংলায় নার্ভ মেরুদণ্ডের ফাঁদে বা ট্র্যাপে পড়ে। কোমরে স্পন্ডাইলোসিস থাকলে অনেক সময় নার্ভে চাপ পড়ে। এটা বয়স হলে অনেকেরই হয়। অনেক সময় সুষুম্না কান্ডে এপিড্যুরাল ইঞ্জেকশন দিলেই এটা ভালো থাকে… বেশী বাড়াবাড়ি হলে কখনও অপারেশন লাগে।”
একজন রিকশাচালক, বেসুরো গান গাইতে গাইতে বাড়ি ফিরছিল। হাতুড়ে এমন একটা তেড়ে মেরে ডান্ডা, মুখে মারি ভঙ্গিতে ওর কাছে গেলেন যে ওর তরল নেশা বায়ুভূতে মিলিয়ে গেল। ভদ্রলোক গৃহাভিমুখে প্রত্যাবর্তন করলেন। হাতুড়েও তথৈবচ।
০৩/০৯/২০২১
পুনশ্চঃ-ধূমপান নিয়ে হাতুড়ে এখন বিষম চিন্তিত। বিষময় জীবন ওনার। লাং ক্যানসার তবুও ঠিক ছিলো। হলো মরলাম। এতে তো হাত পা কেটে বাদ যাবে। বোৎল ধরবো কি ভাবে? এই সব সাত পাঁচ পঁয়ত্রিশ ভাবতে ভাবতে বাড়িতে রান্না করতে চললেন।
আমার ও claudication শুরু হয়ে বেশ জানান দিচ্ছে।