এযেন সেই ছিল “রুমাল, হয়ে গেল বিড়াল” অথবা “ ছিল বন, হয়ে গেছে বাদা”র মতো ঘটনা। এ তো আর জাদুকরী কেরামতি নয় যে ঘোর কাটলেই তা আবার সশরীরে বেরিয়ে এসে বলবে, এই দেখো আমি ফিরে এসেছি! এ হলো উন্নয়নের খেল ! এখানে একবার যা লোপাট হবে তার আর খোঁজ মিলবে না। যা একবার ভ্যানিশ হয়ে গেছে তা চিরকালের জন্য হারিয়ে গেছে । কষ্ট হলেও মেনে নিতে হবে এই নির্মম সত্যকে। একটা ছোট্ট প্রতিবেদন গোয়া রাজ্যের এক হারিয়ে যাওয়া গ্রামকে নিয়ে। গ্রামের নাম কুরদি। গোয়া রাজ্যের দক্ষিণ পূর্ব প্রান্তে পশ্চিমঘাট পর্বতমালার পাদদেশে অবস্থিত ছবির মতো এক গ্রাম ছিল এই কুদরি। অনুপম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পটভূমিকে পিছনে রেখে কুদরি গ্রামে বাসা বেঁধেছিল কমবেশি পাঁচশো পরিবারের ৩০০০ জন মানুষ। অনেকটা এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছোট ছোট গ্রামীণ বসতিগুলোকে পরম মমতায় আগলে রেখেছিল মূল্যবান কাজুবাদাম, নারকেল, ফলবান কাঁঠাল আর আম গাছের বাগান। কৃষিজীবী কুদরি গ্রামের মানুষদের সারাদিন কেটে যেত উর্বর মাটিতে নানান ফসল ফলিয়ে, নিজেদের প্রয়োজন মিটিয়ে অতিরিক্ত অংশটা বিকিয়ে যেত। দুটো বাড়তি আয়ের দৌলতে গ্রামে আসতো খুশির জোয়ার। মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ ছিলোনা।আর থাকবেই বা কেন? সবাই মিলেমিশে থাকাটাই যে ভারতের ঐতিহ্য, পরম্পরা। সেই পরম্পরাগত মূল্যবোধের প্রতি কুদরি গাঁয়ের সকলেই ছিল পরম শ্রদ্ধাশীল। আর তাই এই গ্রামে এলেই নজরে পড়তো মন্দির, মসজিদ আর একটি ছোট্ট চ্যাপেল। সবাইকে নিয়ে মিলেমিশে কুদরি গ্রামের সবাই ছিল এক ঠাঁয়ে। কিন্তু সুখ তো সবার কপালে সয় না। দুখের আগমনে সুখ সব কিছু ছেড়ে বিবাগী হয়ে যায় উদাসী বাউলের মতো। ১৯৭৫ সাল। উন্নয়ন এসে কড়া নাড়লো কুদরির সুখের দরজায়। এই গ্রামেই গোয়া রাজ্যের প্রথম নদী বাঁধ তৈরির পরিকল্পনা গ্রহণ করা হলো। আশেপাশের সব রাজ্য তাদের নদীগুলোকে বাঁধের নিগড়ে বেঁধে ফেলেছে, তাহলে গোয়া বাদ থাকবে কেন? সত্যিই তো,বাদ থাকবে কেন? বাদ থাকেনি। ১৯৭৫ সালে গোয়ার জুয়ারি নদীর উপনদী গুলেলি নদীর ওপর সালাউলিম বাঁধ তৈরির পরিকল্পনা গ্রহণ করা হলো। অন্যান্য নদী বাঁধ তৈরির সময় যেমন বলা হয়, এখানে তেমনি বলা হলো – ভাইসব, এই নদী বাঁধ প্রকল্পের বাস্তবায়ন আপনাদের জীবনে নতুন খুশি আর সমৃদ্ধির সওগাত নিয়ে আসবে। আপনাদের কৃষির প্রয়োজনে জলের জন্য আর আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে না। সালাউলিম বাঁধের পেছনে ধরে রাখা জল আপনারা সেচের কাজে লাগাতে পারবেন, এতে আপনাদের জমির গ্রীষ্মকালীন তৃষ্ণা মিটবে। এই জল পরিশোধনের পর নলবাহিত হয়ে পৌঁছে যাবে আপনাদের ঘরে ঘরে। এই এক বাঁধের জলে ২৪ বর্গ কিলোমিটার এলাকার উন্নতি হবে। তবে!
তবে কী ? তবে আপনাদের, মানে এই কুরদি গ্রামের মানুষদের এই গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে হবে। বাঁধের পেছনে জল ধরে রাখতে হলে।
তেমনই ঘটলো। ১৯৭৫ সালে তৈরির কাজ শুরু হয়ে ২০০০ সালে শেষ হলো কাজ। কুরদি গ্রামের মানুষদের চোখের সামনে একটু একটু করে ডুবে গেল মানুষের ছেড়ে যাওয়া বাড়ি ঘর, চাষের জমি, আম আর কাঁঠালের ছায়াঘন বাগান, এঁকেবেঁকে ছড়িয়ে থাকা পায়ে চলার পথ, দেব স্থান, ছোট্ট পাঠশালা সব কিছু। চাপা পড়ে গেল দীর্ঘ দিনযাপনের অজস্র টক ঝাল নোনতা মিষ্টি সব স্মৃতি। সব হারানোর যন্ত্রণাকে বুকে আগলে রেখে গ্রাম ছাড়লো কুরদির হাজার তিনেক বাস্তহারা মানুষ। এমনটাই বোধহয় নিয়তি নদী বাঁধ প্রকল্পের আওতায় থাকা অঞ্চলের মানুষের। এক শিকড় ছেঁড়া জীবন।
কিন্তু মানুষ কি তাঁর শিকড়ের টানকে অস্বীকার করতে পারে?
হয়তো পারে না। আর তাই প্রতি বছর মে মাসে কুরদি গ্রামের বাস্তুচ্যুত মানুষেরা দল বেঁধে ফিরে আসে তাঁদের হারানো ভিটের টানে। মে মাসেই কেন? আসলে এই গরমের সময় বাঁধের জল কমে যাওয়ায় মরিচীকার মতো মাথা উঁচু করে জেগে ওঠে কুরদির মানুষের হারিয়ে যাওয়া খেলাঘর – ভাঙাচোরা ধর্মস্থান, বাড়িঘর, চাষের জমি, মরা গাছের গুঁড়ি আরও কতো কি ! জল সরিয়ে জেগে ওঠা ধু ধু ধুসর নদী চরের ওপর বিস্মৃত স্মৃতি রেখার এলোমেলো আলপনা।
নতুন কিছু পাবেনা জেনেও মানুষেরা আসেন কেবল তাঁদের ফেলে যাওয়া বাপ পিতামহের ভিটের টানে,যার কিছুই আজ আর অবশিষ্ট নেই। অতীতের আড়ালে চলে যাওয়া সময়ের স্মৃতি আবার মূর্ত হয়ে ওঠে কুরদি গ্রামের একদা আবাসিকদের বিনম্র পদচারণায়। একসঙ্গে খাওয়া দাওয়া, ফেলে যাওয়া দেবস্থানে পিদিম জ্বালা, সমবেত মানুষের কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে ওঠে নদীর বিবাগী চর। কুরদির মানুষ আবার নতুন করে ফিরে পায় নিজেদের। সারাদিন এভাবে কাটিয়ে সন্ধ্যায় তাঁরা ফিরে আসে নিজেদের নতুন আবাসে। আসলে শিকড়ের প্রতি মানুষের অমোঘ আকর্ষণ যাবার নয় , তাই তৃষাতুর চিত্তে বারবার ফিরে ফিরে আসা। হৃদয়ের সব আনন্দই যে সেখানে গচ্ছিত আছে।
উইকিপিডিয়া সহ অন্যান্য সূত্র থেকে প্রয়োজনীয় ছবিগুলো নেওয়া হয়েছে। এদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
গ্রিসে এরকম একটা ঘটনা পড়েছিলাম
https://www.smithsonianmag.com/smart-news/drought-reveals-a-sunken-village-in-greece-as-a-reservoir-dries-up-180985031/#:~:text=In%20the%20late%201970s%2C%20the,supplement%20the%20capital's%20water%20supplies.
ধন্যবাদ সপ্তর্ষি। অন্য দেশ থেকে চয়ন করে প্রাসঙ্গিক বিষয় আমাদের আলোচনার ভিত মজবুত করে।
উন্নয়নের ধাঁধা। চাইতে গেলেই বিনিময়।ভারসাম্য জরুরি।
Unnoyon proyojon to botei. Kintu kokhono dukkhero. Shob shomoy ta manusher kachey shukhoprodo nao hotey parey! Darun lekha!
উন্নয়ন। এক ভয়ঙ্কর সুন্দর ধারনা। এক সোনার পাথর বাটি। আমরা ভাবলাম আমাদের জীবন সুখ- স্বচ্ছন্দে ভরে যাবে। শেষমেশ জীবন ই আর থাকলো না। সুবিধার অন্বেষণে মরুভূমিতে পৌঁছে গেলাম। অনেক হয়েছে। আর উন্নয়ন চাই না। লোভ কে বিসর্জন দিয়ে অরণ্য জীবনে ফিরে যেতে চাই।
বাঁধের জলে বানভাসি হয়ে ভিটেমাটি ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার সমস্যা এক বিশ্বজনীন সমস্যা। মুশকিল হলো এর ফলে সমাজের একেবারে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষদের সবথেকে সমস্যায় পড়তে হয়। আর এই সমস্যার সূত্রেই বাঁধা পড়ে ভারত ও গ্রীস। প্রতিবেদন দুটো ঘটনাকে এক জায়গায় পৌঁছে দেয়।
কি আর বলবো? মনে পরে গেল সেই কবিতার লাইনগুলো,
“দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর,
লও যত লৌহ লোষ্ট্র কাষ্ঠ ও প্রস্তর
হে নবসভ্যতা! হে নিষ্ঠুর সর্বগ্রাসী,
দাও সেই তপোবন পুণ্যচ্ছায়ারাশি”।
প্রকৃতিকে ধ্বংস করে উন্নয়ন আর চাইনা। তবে এমন প্রতিবাদী লেখা চলুক, যদি বোধদয় হয়।
সব প্রতিবাদ খুব উচ্চগ্রামে বাঁধতে হবে এমন হয়তো নয়। এই লেখা যদি প্রতিবাদ বলে মনে হয় , তাহলে জানবো রাস্তা তো ঠিক হ্যায়, ভাইসাব।
প্রতিটা বাঁধ কত অজস্র এমন গ্রামের গল্পকে উন্নয়নের মোড়কে ঢেকে দিয়েছে, তা হয়তো সম্পুর্ন ভাবে খোঁজ করে পাওয়াটাও মুশকিল।
David Harvey এর একটি উক্তি মনে পড়লো“The freedom to make and remake our cities and ourselves is, I want to argue, one of the most precious yet most neglected of our human rights”