“পুরুষ দিবস” নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে এত পোস্ট আগে কখনো দেখিনি, তাই “পুরুষ দিবস” কথাটা আগে শুনে থাকলেও গুরুত্ব দিইনি, ঠিক যেমন ইউনেস্কো বা অন্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ সংস্থাও গুরুত্ব দেয়নি। ১৯ নভেম্বর সেই দিন, সেটাও জানতাম না। শুধুমাত্র নারী দিবসের বিরোধিতা করার জন্যই এরকম একটা কষ্টকল্পনা, এটাই শুনেছি এবং বিশ্বাস করেছি। তার বাইরে তেমন কোনো তাৎপর্য খুঁজেও পাইনি।
আজ ফেবু খুলতেই দেখি অগুনতি পোস্ট। প্রধানত বিদ্রূপ এবং বিরোধিতার পোস্ট স্বাভাবিকভাবেই। এবার তাহলে “ধ র্ষ ক দিবস”, ” অত্যাচারী দিবস”, “সাম্রাজ্যবাদী দিবস”, “লুটেরা দিবস”, “গাছ কাটো দিবস” ইত্যাদিও হবে, এই ধরনের বক্তব্য মূলত, যার যাথার্থ্য নিয়ে সংশয় নেই। কিন্তু একই দিনে একটা বিষয় নিয়ে এত কথার অবধারিত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হল বিষয়টির গুরুত্ব বৃদ্ধি পাওয়া। এভাবেই ক্রমশ এই ‘কষ্টকল্পিত’ দিবসটি অনেক মানুষের কাছে বাস্তব অস্তিত্বসম্পন্ন হয়ে উঠবে, এমনকি পালনীয় মনে হতে পারে ভবিষ্যতে এবং তার ফলে নিন্দিত MRA-দের উদ্দেশ্য সাধিত হবে। নেগেটিভ পাবলিসিটি যেভাবে কিছু সিনেমার ব্যবসা বাড়ায়, সেরকম।
পুরুষদের মধ্যে যাঁরা এই দিবসটির প্রতি কিছুটা নরম মনোভাব দেখিয়ে পোস্ট করেছেন, তাঁদের মধ্যে একটা বিরাট মিল খুঁজে পেলাম। তাঁরা মূলত পুরুষের কাঁদার অধিকার নিয়ে কথা বলেছেন। হয়ত তাঁরা কবি-সাহিত্যিক বলেই তাঁদের ভেতরে কান্নার বীজ আর নরম মাটি আছে। এটা বেশ পেলব ব্যাপার, যা উগ্র পুরুষতান্ত্রিক জেহাদের তত্ত্বের সঙ্গে মিলছে না, যেমন মেলে না পূর্ণেন্দু পত্রীর কবিতার সেই পংক্তিদ্বয়, “সরোদ বাজাতে জানলে বড় ভালো হত। পুরুষ কীভাবে কাঁদে সেই শুধু জানে।”
কান্নার সামনে আমি চিরকালই দুর্বল (নারী-পুরুষ নির্বিশেষে)। চিকিৎসক হিসেবে পুরুষের (পুলিশ, গুণ্ডা সহ) কান্না দেখতেও অভ্যস্ত। সেই কান্নারও বিবিধ উৎস… প্রেম, বিরহ, মিলন, বিচ্ছেদ, মনোকষ্ট, এমনকি ভয়৷ পুরুষের কান্না তাই আমার কাছে স্বাভাবিক এবং তা পাকানো গোঁফের ঘনত্বের সঙ্গে ব্যস্তানুপাতিক নয়।
হ্যাঁ, ব্যস্তানুপাতিক ব্যাপার একটা আছে। সেটা হল পরিসর। পুরুষ্টু গোঁফ ফাঁকা ঘরে ডাক্তারের সামনে কাঁদতে পারে কিন্তু ঘরের বাইরে বেরোনোর আগে চোখ মুছে নিতে হয়। ওই ছোট্ট চেম্বারটুকুই তার পরিসর। তার শোক, কষ্ট, দ্বিধা, সংকোচ, ভয়, পরাজয়, গ্লানির কথা জানার প্রয়োজন হয় না বাইরের পৃথিবীর, এমনকি তার পরিবারেরও। মৃত্যুর পর তার গোঁফ আর পাগড়ির ছবি ঝুলে থাকে অবিচ্ছেদ্য সুখ, সম্ভোগ, দাপট আর সুবিধাপ্রাপ্তির মসৃণ কাহিনী হয়ে। পুরুষের অবহেলিত শবের ওপর হাসতে থাকে পুরুষতন্ত্রের ফ্রেমবন্দী ছবি।
ফ্রেমবন্দীই৷ ফ্রেমের বাইরে ডালপালা মেলার পরিসর নেই। তাত্ত্বিকভাবে সেই পরিসরের কথা আলোচনা করে থিসিস লিখে পিএইচডি করা বা বেস্ট সেলার বই বিক্রি করার পরেও থাকে না। পুরুষের কাঁদার অধিকার নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, এটুকু আশাপ্রদ, কিন্তু বাস্তবে সেই অধিকার ছিল না এবং আজও নেই। পিতৃতন্ত্রই সেই অধিকার দেয় না, এটা হল এর পলিটিক্যালি কারেক্ট ব্যাখ্যা। পাশাপাশি পলিটিক্যালি ইনকারেক্ট সত্য হল, মঞ্চ আলো করে তাত্ত্বিক আলোচনার প্রহরটুকু পেরিয়ে গেলে পড়ে থাকে যে বাস্তব রাত আর দিন, সেখানে নারীরাও সেই অধিকার দেন না, এমনকি অধিকাংশ শিক্ষিত প্রগতিশীল নারীরাও। পুরুষের অভিমানকে তাই ক্রোধ মনে হয়, তার ভেঙে পড়াকে নাটক বা ‘ভিক্টিম প্লেয়িং’ মনে হয়, তার যাবতীয় আবেগকে সন্দেহজনক মনে হয়। তত্ত্ব আর বাস্তবের এই অদ্ভুত বৈপরীত্য কীভাবে বাস্তবে পৌরুষকে বিবর্তিত হতে সাহায্য করবে, তা আমি জানি না। হয়ত আমার অন্তহীন মূর্খামিই তার জন্য দায়ী।
পুরুষের আবেগ-অনুভূতিকে কি তবে বিশ্বাসযোগ্য বলতে পারি প্রচলিত ধারণার বিরুদ্ধে গিয়ে? নিজেকে এই প্রশ্ন করি মাঝেমাঝেই। পুরুষ হিসেবে নিজের অস্তিত্ব নিয়ে সাধারণত লজ্জিত থাকি, সেটাই শিখেছি কলেজবেলা থেকে। সুন্দর মানবিক পৃথিবীতে কি আমাদের স্থান আছে? লিঙ্গসাম্যের লড়াইতে আমরা (cis het male) কি সত্যিই অংশীদার হয়ে উঠতে পারি, এমনকি চেষ্টা করলেও? নাকি আমরা ‘অ্যালাই’? নাকি স্রেফ ‘loyal interlopers’, যেমনটি কয়েক বছর আগের এক কনফারেন্সের শিরোনামে বড় বড় অক্ষরে লেখা ছিল? নাকি তাও না, স্রেফ শত্রু বা অনাসৃষ্টি বা ফালতু ঝামেলা? এর উত্তর আমি আজও জানি না।
“সব পুরুষই খারাপ”, এই তত্ত্বের সারবত্তা সম্বন্ধে আমার কোনো বক্তব্য নেই, কিন্তু সব পুরুষ ঠিক একইভাবে খারাপ হয় না, এটা অভিজ্ঞতায় দেখেছি। ফলে ‘মন্দ’ চিহ্নিত করার প্রক্রিয়াটি সরল নয়। আমরা যারা হিংস্রতা প্রদর্শন করি না বা স্বীকৃত লিঙ্গভিত্তিক অপরাধগুলো এখনো করিনি, তারাও কি বুক ফুলিয়ে নিজেদের ‘ভালো’ বলে দাবি করতে পারি? হয়ত নিজেদের প্রাত্যহিক চর্যায় খারাপকে পুষ্ট করে চলেছি। পরিবারে বা কর্মক্ষেত্রে আমরা অভ্যাসবশত এমন অনেক সুবিধা নিয়ে থাকি, যার ফলে মেয়েদের (প্রান্তিক লিঙ্গের মানুষদের তো বটেই) অনেক অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়। নিদেনপক্ষে তাঁদের কাজের চাপ বাড়ে। গৃহকর্মই ধরা যাক। বলে দেওয়া কাজটুকু হয়ত করলাম কিন্তু বলে দিতে হবে কেন? দায়িত্ব নিয়ে সবটুকু কি করি? এই যে প্রায় দশ মিনিট সময় ব্যয় করে একটা ফালতু ফেবু পোস্ট লিখছি, যে সময়টা বাড়ির কাজে ব্যয় করতে পারতাম বা নিদেনপক্ষে মেয়েকে পড়ায় সাহায্য ক’রে (কালকেও তার পরীক্ষা আছে)। এটাও তো একরকম চুরি বা ফাঁকিবাজি। অথচ এই লাইন লেখার আগে পর্যন্ত এই কথাটা মাথাতেই আসেনি, যেটা বাবার বদলে মা হলে খুব স্বাভাবিকভাবে প্রথমেই ভাবনায় আসত। এসবের পরে আমাদের ভালোবাসার প্রকাশ বা মিষ্টি কথা স্রেফ রেটরিক ছাড়া আর কী? আমাদের আবেগ হয়ত পরিবারে বা ঘনিষ্ঠ মহলে ইমোশনাল সমস্যা সৃষ্টি করে, যা আমরা খেয়ালই করি না। অনেক পুরুষ আদৌ ভালোবাসা প্রকাশই করেন না, বিশেষত বিবাহিত জীবনে, এই অভিযোগ বহু মহিলার কাছে শুনি। কিন্তু যারা প্রকাশ করি, তাদের প্রকাশ কি সন্দেহের ঊর্ধ্বে? এই প্রকাশ আসলে আমাদের সর্বাত্মক অপদার্থতাকে আড়াল করার চেষ্টা নয় তো? হয়ত এটা আমাদের আবেগের exhibition এবং এই ‘exhibitionism’ যেকোনো সম্পর্কে আমাদের একটা অনৈতিক হাতিয়ার, যা চরিত্রগতভাবে সৌন্দর্য বা আর্থিক প্রাচুর্যের এক্সিবিশনিজমের থেকেও বেশি খারাপ। অতএব বিহ্বলতা থেকে শুরু, বিহ্বলতাতেই লেখা এবং ভাবনার শেষ। ভালো হয়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখছি না কারণ পথটাই ঠিকমতো জানি না।