একটা কঠিন গেম জিতে গেলাম।
একটা অল্পবয়েসী মেয়ে, ফার্স্ট ইয়ারে পড়তে পড়তেই বিয়ে হয়ে যায়।
বিয়ের অল্পদিন পরেই pregnant হয়ে গেছিল। পজিটিভ জানার পর তার মুখ শুকিয়ে আমসি, প্রথম ভিজিটেই।
তাকে বললাম, বিয়ের দিনই তো তোর উপলব্ধি হয়ে যাওয়ার কথা যে, একদিন এরকম দিন আসবে। সেটা কি না জেনেই বিয়েতে সম্মতি দিয়ে ‘কবুল করলাম’ বলেছিলি কলেজ পড়ুয়া মেয়ে? তুই বরং ভালো কাজ করেছিস। আজকাল যে হারে PCOD হচ্ছে, তাতে প্রচুর মেয়ের ফার্টিলিটি সমস্যা হচ্ছে।
পরের ভিজিটেই তাকে বলতে বাধ্য হলাম যে, কেসটা twin. সে বেচারী আরো ভয় পেয়ে গেল। নতুন শ্বশুরবাড়ি, এখনো সেখানে তেমন রিলেশনশিপ গড়ে ওঠেনি সবার সাথে। তার মধ্যে এই চাপ! তবুও ওকে যথাসাধ্য পাশে থাকার আশ্বাস দিয়ে সাহস যোগালাম।
ভালোর মধ্যে, মেয়েটার শাশুড়িও এসেছিল এইবারে। শাশুড়িটাকে তেমন কাউন্সেলিং করতে হয়নি। সহমর্মী দেখলাম।
সেই মেয়ে দেখতে দেখতে ৩৬ সপ্তাহে পৌঁছে গেল। বিনা কমপ্লিকেশনে।
গত মঙ্গলবার আমার সারাদিন ধরে প্রচুর ওটি শিডিউল ছিল।
সকালেই মেয়েটি লেবার পেইন নিয়ে হাজির হল। আগেই বলে রেখেছিলাম, আজকাল Multifetal pregnancy-তে সিজারিয়ান সেকশন ফার্স্ট চয়েস। More safe.
কিন্তু, ওকে দেখে বাড়ির লোকেদের বললাম, সারাদিন এই ফ্লোরেই থাকবো, মাঝখানে একবার বাড়িতে খেতে যাবো, তার মধ্যে ওর নর্মাল ডেলিভারি হয়ে যাবে।
বাড়ির লোক নিমরাজি হলেও শেষ পর্যন্ত আমাকে স্বাধীনতা দিয়েছে।
সন্ধ্যার পরে নর্মাল ডেলিভারি হয়ে যায়। কিন্তু মেয়েটা বারবার বলছিল খুব হেডেক।
তাই প্রয়োজনীয় ওষুধপত্তর দিয়েও একটু দুশ্চিন্তা নিয়ে রাতে বাড়ি যাই।
পরদিন, আমি যখন চেম্বারে রুগী নিয়ে ব্যস্ত, হঠাৎই উঠে বসার পরেই মেয়েটির এক্লাম্পটিক কনভালশন শুরু হয়ে যায়, নর্মাল ব্লাড প্রেসার সত্ত্বেও। ডেলিভারির কুড়ি ঘন্টা পরে।
পরিস্থিতি যাকে বলে, আমাদের ভাষায় পুরো গাধার #&₹@.
তবুও সিচুয়েশন কন্ট্রোলে আনা হল।
বাড়ির লোক তখন ছেঁকে ধরেছে। যথারীতি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বও আছে সেই দলে।
তাদের বললাম, দ্যাখো, রুগীকে তোমরা বেটার জায়গায় নিয়ে যেতেই পারো, আমারো সেটাই অ্যাডভাইস করা উচিত। কিন্তু কতগুলো ফ্যাক্টর ভেবে দ্যাখো।
প্রথমতঃ তোমরা ফিনান্সিয়ালি স্ট্রং নও।
এই রুগীকে প্রাইভেটে কোথাও ভর্তি করলে ভালো বিলের ধাক্কা খাবে। কারণ, রুগী এসেছে অতীব এমার্জেন্সি নিয়ে। বাণিজ্য করবার মস্ত সুবিধে সেটা।
আর আরো বড় কথা, বাচ্চাগুলো মা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। শুরুতেই ওদের বাইরের ফুডে অন্যের হাতে কেয়ারিং তুলে দিতে হবে। তার সুদূরপ্রসারী ফল ভালো নাও হতে পারে। বাচ্চাগুলোকে সিক নিওনেটাল ইউনিটে রাখার খরচ তোমরা পেরে উঠবেনা। একমাত্র ভরসা সরকারী হাসপাতাল। মা ও বাচ্চা, দুজনেরই জন্য। তারা প্রাথমিকভাবে প্রাইভেটে চিকিৎসা শুরু করানোর কারণে বকাঝকা করলেও শেষে হয়তো ট্রিটমেন্ট দেবে।
তার চাইতে, আমি বলি কি, আমাকে চব্বিশ ছত্রিশ ঘন্টা সময় দাও, সামলাবার চেষ্টা করি। তার মধ্যে আমি বুঝে নেবো, এদের সত্যিই কোথাও পাঠাতেই হবে কিনা। যদি না যেতে হয় কোথাও, তাহলে সমুদ্র পরিমাণ খরচের হাত থেকেও বেঁচে যাবে তোমরা। বাচ্চাগুলোও উপকৃত হবে। সেটা খুব দরকার। আমাকে খানিক সময় দাও, আর আস্থা রাখো।
…
মেয়েটা আজ তার দুই বাচ্চাকে নিয়ে সুস্থ শরীরে বাড়ি গেছে।
…
ঘটনাটা কেন লিখলাম?
অনেক পয়েন্ট।
প্রথম কথা, ওরা জানতো সিজার হবে। নর্মাল করানোর সিদ্ধান্ত আমার। কিছু খারাপ হলে, এই অভিযোগটা উঠে আসতো।
দ্বিতীয়তঃ, এক্লাম্পটিক কনভালশন হওয়ার পরে, ওদের আর্থিক সমস্যা থাকা সত্ত্বেও ওরা শুনতে চাইছিল, আমি যেন কোথাও রেফার করে দিই। উল্টে আমি ওদের কাছে সহযোগিতা আশা করেছি, চিকিৎসা দেওয়ার সামর্থ্য আছে কি নেই, সেটা পরের কথা।
তৃতীয়তঃ ওদের আর্থিক অবস্থা নিয়ে আমার মাথাব্যথা করা কতটা যুক্তিযুক্ত?
যুক্তিযুক্ত হলেও, পরিণতি খারাপ হলে, সেই ভাবনা কতটা কল্কে পেতো?
চতুর্থতঃ এবং শেষ হল, পেসেন্ট পার্টি যদি অ্যাগ্রেসিভ হয়ে পড়তো, ননকোঅপারেটিভ হতো, বা আগে থেকে এতবার মীট হওয়ার দরুণ ডাক্তার রুগী রিলেশনশিপটা Built up না থাকতো, তাহলে কী হতো?
…
আমি জানি, আমার ডাক্তার কলীগরা বলবে, প্রাইভেটে এত রিস্ক নেওয়া ঠিক নয় ছোট জায়গায়, মফস্বঃলে।
…
নতুন যারা উঠে আসছে, তারা আমার এই লেখাটা পড়ুক।
তাদের মধ্যে কাউকে না কাউকে তো মাঠে নামতেই হবে।
….
আমার এই লড়াকু মা আর তার দুই বাচ্চার জন্য শুভেচ্ছা বর্ষিত হোক।
….
শুভরাত্রি।
জুনিয়র প্র্যাকটিশনাররা এই আর্টিকল পড়লে উপকৃত হবে।