ভদ্রমহিলা আমার চেম্বারে ঢুকেই প্রশ্ন করেছিলেন যে তাঁকে চিনতে পারছি কিনা। মুখের সঙ্গে নাম গুলিয়ে ফেলার একটা অদ্ভুত ক্ষমতা আছে আমার। অবশ্য শেকসপিয়ার সাহেব তো বলেই গেছেন “নামে কি এসে যায়।” কিন্তু এই ভদ্রমহিলার নাম বা মুখ আগে কোথাও দেখেছি বলে মোটে মনে পড়ছে না। এতোদিন মুখ মনে আসলেও নাম মনে আসতো না। এখন তো দেখছি নাম, মুখ কিছুই মনে করতে পারছিনা। আমার পূর্বপরিচিত হলে তবু রক্ষে, যদি অর্ধাঙ্গিনীর বান্ধবী হয় তাহলে মহা সর্বনাশ। “তুমি ইচ্ছে করে চিনতে পারোনি আমাকে অপদস্ত করবে বলে”। এরপরে অসহযোগ এবং অনশন। আমার স্ত্রী গান্ধীজির মর্ডানাইজড ফিমেল ভার্সন।
এক্ষেত্রে যা করা উচিত তাই করলাম। মুখে একটা বিজ্ঞ মার্কা হাসি ঝুলিয়ে দিলাম। যেন সর্বজ্ঞ ধর্মগুরু। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে সবার পরিচয় আমার নখদর্পণে। আমি সব জানি, কিন্তু আমাকে বলতে হবে কেন? বৎস, তুমি নিজের সম্বন্ধে যাহা জানো প্রকাশ করো।
পাশে দাঁড়ানো ভদ্রমহিলার স্বামী বোধহয় বুঝতে পেরেছিলেন যে ব্যাপারটা ঠিক দিকে গড়াচ্ছে না। “আপনি খুব ছোটবেলায় দক্ষিণপাড়া বালিকা বিদ্যালয়ে পড়েছিলেন তো?” ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করেন।
সে তো কয়েক কোটি বছর আগে। রোগী দেখাতে এসে ডাক্তারবাবুর শিক্ষাগত যোগ্যতা মানুষ জানতেই পারে। তবে এতো গোড়া থেকে শুরু করা বেশ বাড়াবাড়ি।
“হ্যাঁ, আমি পুরুষমানুষ হলেও গেঁড়িগুগলি বয়সে বালিকা বিদ্যালয়ে পড়েছিলাম।” আমার সাবধানী জবাব।
“সেখানে ডিমে তা দেওয়া নিয়ে একটা ঘটনা ঘটেছিল বোধহয়।”
একটা পর্দা সরে যায়। আমার ছোটবেলায় ঘটে যাওয়া সেই মজার ঘটনা নিয়ে একটা গল্প লিখেছিলাম। ছোটদের নামকরা এক পত্রিকায় সেটি ছাপা হয়েছিল। মজাদার সেই গল্পটা পড়ে অনেকে আমাকে ফোন করেছিল। এমনকি বিদেশ থেকে এক প্রবাসী বাঙালি জানতে চেয়েছিলেন যে মেয়েটির সঙ্গে আমার যোগাযোগ আছে কিনা।
ছোটবেলায় আমার ঠাকুমা আমাদের কাছে থাকতে এলে বাড়িতে থাকা সমস্ত আমিষ খাদ্য বাজেয়াপ্ত করা হতো। একবার এরকম ভাবে বাজেয়াপ্ত হওয়া একটা ডিম আমার দখলে এসেছিল। ডিম থেকে মুরগিছানা বেরোয় এ তথ্য আমার জানা ছিল। তখন গুগল না থাকলেও আমার থেকে চারবছরের বড়ো বিজ্ঞ দাদা ছিল। দাদার কাছ থেকে জানতে পারলাম ঠিকঠাক ‘তা’ দিতে পারলেই মুরগিছানা পাওয়া যাবে। বেশ কয়েকদিন জিতোড় কৌশিস-এর পরেও ছানা না বেরোতে আবার দাদার শরণাপন্ন হলাম। দাদার সহাস্য জবাব “দূর বোকা। ছেলেরা ‘তা’ দিলে বাচ্চা হয় নাকি? তুই কোনও ছেলেকে এখনো পর্যন্ত মা হতে দেখেছিস?” অকাট্য যুক্তি। কাকিমা, পিসি, মাসিকে হাসপাতালে গিয়ে বাচ্চা আনতে হয়। কাকা, পিসেমশাই বা মেসোমশাইকে কখনও তো হাসপাতালে ভর্তি হয়ে বাচ্চা আনতে দেখিনি।
এরপরে আমার গল্পের দ্বিতীয় অংশের শুরু। আমার রোল নম্বর ছিল এক আর সোনালীর তিন। সোনালী আমার পাশে বসতো। বেশ একটু স্বাস্থ্যবতী, ধীরস্থির সোনালী রোলকলের সময় ‘প্রেজেন্ট প্লিজ’ বলে আস্তে আস্তে বেঞ্চে বসতো। সেই ফ্র্যাকশন অব সেকেন্ডকে কাজে লাগিয়ে ডিমটি আমি বেঞ্চের ঠিকঠাক জায়গায় রেখে দিলাম।
তারপর ফট করে একটা আওয়াজ। সোনালীর কান্না এবং বিশ্রী একটা গন্ধ। ডিমটা এতোদিনের অত্যাচারে পচে গেছে। টিচার প্রথমে ভেবেছিলেন সোনালী বোধহয় বড়বাইরে করে ফেলেছে। আসল তথ্য সামনে আসার পর আমার সম্বর্ধনার ব্যবস্থা হলো। খারাপ খবর আগুনের মতো ছড়ায়। আমি বাড়ি ফেরার সাথেসাথে মা আমার ওপর পুলিশি নির্যাতন শুরু করলো। মারতে মারতে ক্লান্ত হয়ে একসময় ঘোষণা করলো যে বাবা অফিস থেকে ফিরলে বাকি ব্যবস্থা হবে। শূলে চড়ানো হবে না ফাঁসি দেওয়া হবে সেই ডিসিশন বাবা নেবে।
রাতে বাবা সমস্ত ঘটনা শুনে মুচকি হেসে বললো “তোমার এখনো সেই বয়স হয়নি।”
আমার বোকাবুদ্ধিতে পাজল্-টার একটা সমাধানও বেরোলো – ‘তা’ দিয়ে মুরগিছানা বার করতে হলে একটু বড়ো হতে হয়। সেই সরল বিশ্বাস নিষিদ্ধ ফল খাওয়ার বয়স আসতে শেষ পর্যন্ত ভেঙেছিল।
সেই সোনালী আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সোনালীর স্বামী গল্পের বই পড়তে ভালোবাসেন। গল্পটা পড়ে ভালো লাগায় তাঁর স্ত্রীকে বলেছিলেন। স্ত্রী নাকি গল্পটা শুনেই বলেছিলেন “এটা নির্ঘাত সেই দুষ্টু ছেলেটার লেখা।” দুষ্টু ছেলেটাকে ওরা ফেসবুকে ধরেও ফেলেছিল। মেসেঞ্জারে পরিচয় দিয়েছিল। আমি মেসেঞ্জার ডিঅ্যাক্টিভেট করে রেখেছি। ফলে আমি পর্যন্ত ওদের পাঠানো খবরটা পৌঁছয়নি।
আমার চেম্বারে এসেও একপ্রস্ত অপদস্ত হতে হয়েছে তাঁদের। আমার চেম্বার অ্যাসিস্ট্যান্ট খুব কড়া মানুষ। শুধুশুধু গল্প করে ডাক্তারবাবুর সময় নষ্ট করা যাবেনা। কলকাতা থেকে কৃষ্ণনগর এসে দেখা না করে চলে যাবেন? তাই শেষপর্যন্ত রোগী দেখানোর তালিকায় নাম লিখিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করা। ওঁদের অবশ্য এই রাস্তায় অন্য একটা কাজও ছিল।
সোনালী এবং ওর স্বামী ইদানীং খুঁজে খুঁজে আমার লেখা পড়েন। এমনকি এই ধারাবাহিকটাও নিয়মিত পড়ছেন।
সোনালী বললো “তুই বড্ড দুঃখের গল্প লিখছিস। একটু হালকা লেখা লেখ না।”
আমি বললাম যে এই সিরিজটা তো আমার সংস্পর্শে আসা মানুষ নিয়ে। তাহলে তোর কথা আবার লিখি।
সোনালী রাজি হলো। “তবে আমার আসল নাম একদম লিখবি না।”
দারুণ লিখেছ, খুব ভালো লাগছে
Thank you Dada 🙏🙏🙏
মজার গল্প
ধন্যবাদ 🙏🙏🙏