আরও কয়েকদিন পরে থ্রেট সিন্ডিকেটের পাঁচালি লেখার ইচ্ছা ছিলো। সাম্প্রতিক কয়েকটা ঘটনা এমনভাবে ঘটে গেলো যে, আরেকটি কিস্তি আজকে লিখতেই হচ্ছে। থ্রেট সিন্ডিকেটের একজন কেষ্টবিষ্টু ছিলো সন্দীপ ঘোষ। সন্দীপ শুধুমাত্র একজন প্রিন্সিপাল নয়, ওনার প্রশাসনিক আর রাজনৈতিক ক্ষমতা ভালোই ছিলো। যাদের এই বিশেষ ক্ষমতা থাকে না তাদের থ্রেট কোনো কাজে আসে না। যার প্রশাসনিক ক্ষমতা আছে তার থ্রেট কার্যকরী কিন্তু তার একটা সীমা আছে। আইনের মধ্যে থেকেই তাদের বাঁদরামি করতে পারে। যাদের থ্রেট দেয়া হয় তারা আইনের পথে সুবিচার পেতে পারে।
যাদের প্রশাসনিক ক্ষমতার সঙ্গে রাজনৈতিক ক্ষমতা যোগ হয় তাদের থ্রেট বিশেষ ক্ষতিকর। এতে আইনের পথে সুরাহা হবার সম্ভাবনা কম।
আইনের পথে বিচার পেতে হলে প্রশাসনকে নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে হয়। প্রশাসন তখনই নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারে যখন রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থাকে না।
রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের বিষয়ে সরাসরি বোঝা যায়না। কোনো ঘটনায় প্রশাসন কেমন কাজ করছে সেটা দেখে বুঝে নিতে হয়। আরজি কর কেসে প্রমাণ লোপাট থেকে শুরু করে যা যা অপকর্ম হয়েছে তাতে এখনো পর্যন্ত গ্রেফতার হয়েছে সন্দীপ ঘোষ আর টালা থানার ওসি। দুজনেই প্রশাসনের লোক। আমি এখনো মনে করি প্রশাসনের বেশিরভাগ মানুষ এখনো নিরপেক্ষভাবেই কাজ করতে চায়।
এখন একটা প্রশ্ন নিজেকেই করুন। এখনো পর্যন্ত টালা থানার ওসি গ্রেফতার হয়ে যা খুইয়েছে সেটা মারাত্মক। চাকরিতে সাসপেন্ড হয়েছে। জেল খাটছে। দোষ প্রমাণ হলে যাবতজীবন কারাদণ্ড আর চাকরির দফা রফা।
একটা ছাপোষা পুলিশ এতো রিস্ক কেনো নিলো প্রমাণ লোপাট করতে?
আর যায় হোক উনি উন্মাদ তো নয়। ওদিকে এখনো পর্যন্ত মূল অভিযুক্ত বলে যাকে ধরেছে সেই সঞ্জয় রাই, কোনো ধনকুবের বলে তো শোনা যায়নি। সেটা হলে তবু ভাবার বিষয় থাকতো যে ও এতো টাকা টালার ওসিকে অফার করেছে যে, এই চূড়ান্ত রিস্ক সে নিয়েছে।
এটা হবার সম্ভাবনা যখন খুব ক্ষীণ তখন অন্য কোনো গল্প এর পিছনে থাকতেই হবে। যে গল্প এখনো আমরা হয়তো আন্দাজ করতে পারছি কিন্তু তার প্রমাণ এখনো আমাদের হাতে আসেনি। প্রশাসন যে এখানে বিশেষভাবে কাজ করছে সেটা সুপ্রিম কোর্টে সরকারের তরফে যে আইনজীবীদের দাঁড় করিয়েছে তাদের প্রোফাইল আর সংখ্যা দেখেই বোঝা যায়।
সময় অনেক কিছু সামনে এনে দেয়। এখানে দেখা যাক পরে কি সামনে আসে। এর আগে আমি উল্লেখ করেছি যে, থ্রেট সিন্ডিকেট অপারেট করে প্রশাসনকে অকেজো করে দিয়ে অথবা নিজেদের পক্ষে বেআইনিভাবে ব্যবহার করে। আমরা যারা সরকারি চাকরি করি তারা প্রশাসনের পক্ষপাতিত্ব আগেও দেখেছি এখনো দেখছি। কম আর বেশি।
বিগত তিরিশ বছর ধরে জানি কলেজে একটি কলেজ কাউন্সিল থাকে। তারা নিয়ম মেনে কলেজের মধ্যে ঘটা ঘটনার তদন্ত করে। তদন্তের রেজাল্টের ওপর শাস্তি কি দেয়া যেতে পারে তার সুপারিশ করে।এই সুপারিশ স্বাস্থ্য ভবনে ডিএমই এবং স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়কে জানানোই রীতি। এবার সেখানে হয় এই তদন্তে সিলমোহর লাগায় বা উচ্চপর্যায়ের আরেকটি কমিটি তৈরি করে পুনরায় তদন্ত করে। কলেজ কাউন্সিল এনএমসি এবং স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মের অধীন। কারুর ব্যক্তিগত ইচ্ছে অনিচ্ছের কোনো জায়গা এখানে নেই।
আর জি করে থ্রেট সিন্ডিকেট নিয়ে সম্প্রতি একটি কলেজ লেভেলে তদন্ত হয়। তার ওপর ভিত্তি করে কলেজ কাউন্সিল ডিসিসন নেয়। যতদূর খবরে প্রকাশ অফিসিয়ালি যতদূর জানাবার কথা ওখানের প্রিন্সিপাল সেটি জানিয়েছেন।
আগের দিন জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে মাননীয়া স্বাস্থ্যমন্ত্রীর একটি মিটিং লাইভ স্ট্রিমিং এ দেখলাম। সেখানে দেখলাম আর জি করের প্রিন্সিপাল স্যারকে রীতিমত ভৎসনা করা হলো ওনাকে না জানানোর জন্য। একটু অবাক হলাম এই দেখে যে সরকারি নিয়ম মেনে এখানে কোনো কাজ করা করতে বারণ করা হলো। শুনলাম যা ডিসিসন সেটা গার্মেন্ট নেবে।
আমার এতদিনের জানা বোঝা ভুল হয়ে গেলো। গভর্নমেন্ট বলতে আমরা বুঝতাম মন্ত্রিসভা এবং সমস্ত সরকারি দপ্তর এবং তার আধিকারিকেরা।স্বাস্থ্যভবনের অফিসাররা যদি ডিসিসন নেয়ার ক্ষেত্রে কেউ না হয় তাহলে হেলথ সেক্রেটারি এবং চিফ সেক্রেটারিও ডিসিসন নিতে না পারার কথা। ভারতীয় সার্ভিস রুল অনুযায়ী সকল সরকারি ডাক্তার ডিএমই ডিএইচএস এবং সকল আমলা সবাই গ্রুপ এ অফিসার। এখন ধরে নিলাম নিয়ম কানুন মেনে যে কাজের পদ্ধতি আমরা জানি সেটা এখানে কার্যকরী করা যাবে না। গর্মেন্ট যা বলবে সেটাই করতে হবে। সেটা হলে এনএমসি, সার্ভিস রুল এবং ইউনিভার্সিটি রুল যা বলে সেটা লাগু করা যাবে না। ধরে নিন সব অফিসার এভাবেই কাজ করতে শুরু করলো। মন্ত্রীরা পদ্মপাতার জল। আজকে আছে কালকে পাল্টে যাবে। সরকারি অফিসারের এই স্বাধীনতা নেই। তাদের সার্ভিস বুক আছে। প্রতিটা অর্ডারের জন্য দেশে আইন কানুন আছে। ভবিষ্যতে আদালতে ফেঁসে গেলে কোনো গরমেন্ট বাঁচাতে আসবে না।
এই যে গরমেন্টের মৌখিক নির্দেশে অফিসারদের কাজ করা এর ঘোর বিপদ আছে। এটা সরকারি চাকরির স্ট্রাকচারাল থ্রেট। সরকারি দপ্তর আজ পর্যন্ত দেখিনি মুখের কথায় চলে। এখানে কাজ কর্ম রীতিমতো কাগজে কলমে করতে হয়। তাই আমার অনুরোধ যতদিন পর্যন্ত না গরমেন্ট বা তার কোনো মন্ত্রী লিখিত কোনো অর্ডার পাঠায় ততদিন সরকারি অফিসাররা যেনো রুলবুকে যা লেখা আছে সেটাই ফলো করে। চাকরি জীবনের শেষে মৌখিক অর্ডারে করা কাজের জন্য যদি আপনি ফেঁসে যান তাহলে যে গর্মেন্টের মৌখিক কথায় আপনি করেছেন তাকে আর খুঁজে পাবেন না। আর খুঁজে পেলেও আপনাকে দেয়া মৌখিক অর্ডার তিনি হয়তো আর মনেই করতে পারবেন না। মন্ত্রীদের যে মন খুব ভুলো সেটা আমরা সবাই জানি। সারা দেশে প্রায় সব মন্ত্রী ইলেকসনের আগে দেয়া প্রতিশ্রুতি ইলেকশানের পরে আর মনেই করতে পারে না।
আমরা এখনো জানিনা টালা থানার ওসি এরকম কারুর মৌখিক অর্ডারে, রুল ভেঙে কাজ করতে গিয়ে ফেঁসেছে কিনা। ভারতীয় ন্যায় সংহিতা অনুযায়ী সঞ্জয় রাই এর যা শাস্তি হবে তার সমান শাস্তি টালা থানার ওসির ও হতে পারে, দোষ প্রমাণ হলে।
তাই সাধু সাবধান। অফিসার যারা আছেন তারা রুলবুক মেনে কাজ করুন। কারুর মৌখিক কথায় কাজ করে যদি টালা থানার ওসির মতো অবস্থা আপনার হয় তখন যেন কাঁদতে আসবেন না। স্থানীয় ভাবে যার ক্ষমতা যতো বেশি মনে হোক সর্বোচ্চ ক্ষমতা কিন্তু ভারতীয় সংবিধান আর সুপ্রিম কোর্টের। ভেবে কাজ করুন। লালু থেকে কেজরিওয়াল, অনেক গর্মেন্ট কিন্তু জেলে ঘানি ঘুরিয়েছে।
(চলবে)