“বাবা,আমি ক্যানিং থিকে বলসি। নন্দরানী।”
এই গলাটা আমার খুব চেনা। আর এরপর কি কি বলবে তাও অজানা নয়।
“আমার বুকের বেদনাটা খুব বেড়েসে বাবা। তুমি আর বার সেই ওষুধ পালা বদলে দিসিলে, দিন কতক ভালো সিলাম। আবার শুরু হয়েসে। কলকেতায় যেয়ে উঠতে পারবো নি, কি এক নাকি করোনা হয়েসে? তুমি একটা ওষুধ বলে দাও দেকি! আর যে পারি না।”
নন্দরানী আমার অনেক দিনের পুরনো রোগী। আমার পাড়ার ওষুধের দোকানের পিছনলাগোয়া একচিলতে ঘরে প্র্যাক্টিস শুরুর দিনকার। তাও হয়ে গেল বছর পনেরো। ‘বাবা’ বলে আমায়।
এক হাইকোর্টের জজ সাহেবের পরিবারকে আমার বাবা চিকিৎসা করতেন। আমি প্র্যাকটিস শুরু করলে জজ সাহেবের বয়স্ক মায়ের দেখাশোনা করার দায়িত্ব পড়ল আমার উপর। নব্বই এর ঘরে বয়স, অস্থিচর্মসার এক মহিলা। ওই বয়সে নিজের কর্মক্ষমতা চলে গেলেও মেজাজ সবসময়ই সপ্তমে। জজের মা বলে কথা! আলাদা থাকেন তখনও, ওই সর্বক্ষণের দেখাশোনা করার লোক নন্দরানীকে নিয়ে।
নন্দরানী তখন মাঝবয়েসী পৃথুলা এক মহিলা। তার স্বামী ওই ফ্ল্যাটেরই কেয়ারটেকারের কাজ করতেন। বয়স্ক মহিলার নামটি এখনো আমার মনে আছে। নীলিমারেখা। খুব স্পষ্ট উচ্চারণে বলতেন সে কথা। প্রথম দিনই মেজাজ দেখে বুঝতে পারলাম, বাবা কেন আমাকে দায়িত্বটা দিয়েছেন!
মাসে এক দুবার যেতে হত উনাকে বাড়িতে দেখার জন্য। এতটাই রোগা ছিলেন যে হাতে ব্লাড প্রেসার মাপার যন্ত্রের কাফটাও ঠিক মত লাগানো যেত না। আর উনাকে দেখে যখনই আমি বেরিয়ে আসতাম তখন একটাই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতেন,”বাবা আমি আর কতদিন এভাবে বাঁচবো বলতো?”
শুরুর দিকের জজের মায়ের রাশভারী ভাব কেটে গিয়ে পরে একদম আটপৌরে ঠাকুমা হয়ে গিয়েছিলেন আমার কাছে। প্রায় পাঁচ বছর বেঁচে ছিলেন তারপরেও। মনে আছে ডিসেম্বরের শীতের এক রাতে চলে গেলেন চিরতরে। শেষ মুহূর্তেও আমি থাকতে পেরেছিলাম উনার শয্যার পাশে।
মানুষ মরণশীল। প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই বার্ধক্য আসে। মৃত্যু পরপারে নিয়ে যায়। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসা করলে সেই মানুষটির একটা প্রভাব রয়ে যায় সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের মনে। কোন অবচেতনে তা হয়তো কখনো বেরিয়ে আসে।
মাফ করবেন পাঠক বন্ধু, নন্দরানীর গল্প শোনাতে গিয়ে কবে কোন নীলিমারেখায় পৌঁছে গেলাম তা নিজেই বুঝতে পারিনি। মাঝবয়স এলে বোধহয় এ ভাবেই কত কথা ভেসে আসে।
যাই হোক,সেই নন্দরানী আর তার স্বামী প্রফুল্ল দেখাশোনা করতো জজ সাহেবের মায়ের। মায়ের মৃত্যুর পর, প্রফুল্ল এখানে রয়ে গেলেও সেই গোলগাল নন্দরানীর থাকার জায়গা হলো না। সে ফিরে গেল ক্যানিং পেরিয়ে কোন এক গ্রামে, তার শ্বশুরবাড়িতে। তখনই তার পাঁচ গন্ডা অসুখ। প্রেশার, সুগার, হাঁপানি, গাঁটের বেদনা। তবুও প্রায় বছর পনের ধরে সে আমার কাছে নিয়মিত আসে তার চিকিৎসার জন্য। মাসে একবার বা খুব দরকারে দুবার। তাকে দুটো নদী পেরিয়ে ভ্যান রিকশা করে এসে ট্রেন ধরতে হয়। সকালে ফোন করে জানিয়ে দেয় যে আজ আসছে।
আমার একটা ছোট চেম্বার আছে। সান্ধ্যকালীন। হাসপাতালের সার্জিক্যাল কাজ করার অনেক আগে থেকেই। এলাকার বা পরিচিত অনেক মানুষ আসেন সেখানে। অনেক সময় এমনও হয় হাসপাতালের ইমার্জেন্সির চাপে চেম্বার করা হয়ে ওঠে না। তাই সময়ের সাথে সাথে অনেকটাই অবহেলিত হয়ে গেছে সেই ক্লিনিক। তবে নন্দরানীর মতো পুরনো পেসেন্টরা ওইসব পাত্তা দেয় না। অনেকবার অনুরোধ করেছি ওর এলাকায় কাউকে দেখিয়ে নেওয়ার জন্য। কিন্তু দু দিন পরেই আমায় ফোন,”ও বাবা,তোমার কাসে কবে যাবো?”
চিকিৎসা যে সত্যিই অনেকটা রোগীর বিশ্বাসের উপরে দাঁড়িয়ে থাকে তার প্রমাণ কিন্তু চিকিৎসক জীবনে বারবার পেয়েছি। আর সেটা তৈরী হয় চিকিৎসক-রোগীর সম্পর্কের জন্যই।
আর এই সম্পর্ক নিয়ে আমাদের সমাজ এক সত্যিকারের সংকটের মধ্যে দিয়ে চলেছে এখন। ক্রেতা সুরক্ষা আইন বলবৎ হওয়ার পর থেকেই এইসবের শুরু বলে আমার ধারণা। দুপক্ষের মধ্যেই বিশ্বাস এসে তলানিতে ঠেকেছে। সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার বেহাল অবস্থা, তাই এখন সব রোষ ঘুরিয়ে দিয়েছে ডাক্তারের প্রতি। হাতের নাগালে নিরস্ত্র চিকিৎসক এখন রণক্ষেত্রে একা।
নন্দরানী এইসব জানে না। সে জানে কলকাতায় তার এক ডাক্তার থাকে। সেই সব রোগের চিকিৎসা করে। কোন স্পেশালিষ্ট-এর কাছেও সে যাবে না কোনমতেই।
একদিন সকালে বারান্দায় দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিলাম। একটা রিকশা এসে দাঁড়ালো বাড়ির সামনে। প্রফুল্ল আর নন্দরানী। এত সকালে? ফোন না করে এসে উপস্থিত হয়েছে! কলিং বেল বাজলে দরজা খুলে দিলাম। একতলায় বাড়ির চেম্বারে না ঢুকে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে এলো দুজন। প্রফুল্লর হাতে একটা বাজারের থলে, কিছু একটা বেরিয়ে আসতে চাইছে তার ভিতর থেকে।
“ডাক্তারবাবু আপনের জন্যে দ্যাখেন গেরাম থেকে কি এনেসি?” থলের গেরো খুলতেই এক জলজ্যান্ত কালো রঙের মোরগ লাফিয়ে বেরিয়ে পড়লো বাড়ির লালরঙা মেঝের উপরে। পায়ে দড়ি বাঁধা। “কাল হাটবার সিলো। মোরগটা পেয়েসি। আপনাকে তো কিসু দিতে পারি না। তাই ভাবলাম….!”
আমাদের বাড়িতে তখন ধুন্ধুমার কান্ড জ্যান্ত মোরগ দেখে। বৌ, মেয়ে, কাজের লোক ছোটাছুটি শুরু করে দিয়েছে।
আমি ছোটবেলায় শুনেছি আর কিছুটা দেখেছি বাবাকে এইসব ‘উপহার’ পেতে। মুরগির ডিম, আস্ত পাঁঠা, ফলের ঝুড়ি। তাও তিনি জীবনের পনেরটা বছর মফস্বলে ডাক্তারি করেছেন। যেটা স্বাভাবিক সেখানে। আর সময়টাও অনেক পুরনো। পুরুলিয়ায় একবার শুনেছিলাম এক হার্নিয়া অপারেশনের ফিস্ মিলেছিল একজোড়া হাঁসের ডিম।
কিন্তু এটা যে কলকাতা শহর। এখানে সব কিছুকেই যে টাকা-পয়সার নিক্তিতে মাপা হয়। কার লাইফ স্টাইল ঠিক কতটা উন্নত তাই দিয়ে বিচার করা হয় সেই মানুষটির সামাজিক অবস্থান। মায়া মমতা, দায়িত্ববোধ, পারস্পরিক সম্পর্ক এই অনুভূতিগুলো যে ক্রমাগত ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে এইসবের চাপে।
মোরগটির এই আচমকা আগমনে বাড়ির মধ্যে শুরু হয়ে যাওয়া হুলুস্থুলের মধ্যেও একটা ভালোলাগার অনুভূতি বয়ে যাচ্ছিলো আমার মনের ভিতর। তাই ওদেরকে আর বকাবকি না করে, গৃহিণীর অনিচ্ছাসত্ত্বেও মোরগটা রেখে দিলাম। ওরাও খুশি হয়ে বাড়ি ফিরে গেল।
কিছুদিন পরে শুনলাম গ্রামে আচমকাই হার্ট অ্যাটাক হয়ে প্রফুল্লর মৃত্যু হয়েছে। ভারী অবাক হলাম কারণ প্রফুল্লর কোন রোগ ছিল না। রোগা, বোকাসোকা গ্রামগঞ্জের হাটুরে লোকের মত চেহারা ছিল। সামান্য জ্বর ছাড়া কোনকালেই আমার কাছে আসতে হয়নি তার।
নন্দরানীর আর কলকাতা ফিরে আসা হলো না। সে এখন ক্যানিং ছাড়িয়ে দুটো নদী পেরিয়ে কোন এক গন্ডগ্রামে থাকে তার ছেলের সাথে। হরেক রকম ওষুধ খায় আর মাঝেমধ্যে আমায় ফোন করে। আমি বকা দিলেও, ফোনের মাধ্যমেই ওর প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র দোকানদারকে বলে দি।
করোনার অত্যাচারে এই মানুষগুলোর এই মুহূর্তে কলকাতা আসা প্রায় অসম্ভব। তাই বুকের ব্যথা বাড়লে এখন হয় তাকে গ্রামের চিকিৎসকের দ্বারস্থ হতে হবে অথবা যেতে হবে কাছাকাছি গ্রামীণ হাসপাতালে। সেখানে এই মহামারীর বাজারে কোন চিকিৎসক রয়েছেন কিনা, তা এই মুহূর্তে বলা অসম্ভব।
কলকাতা শহরে বসে সেখানকার পরিস্থিতি সম্বন্ধে কোনো ধারণা করাই আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই অজান্তেই মনের মধ্যে চিন্তা এসে পড়ে।
আসলে এভাবেই তো চলে ডাক্তারদের দৈনিক জীবন যাপন।
রোগীর সম্বন্ধে দুশ্চিন্তায় অথবা মার খাবার ভয়ে।
Excellent.
অসাধারণ লেখা। ?
The bonding of a doctor and a patient has been excellently shown in this write up…for this immense trust ..faith ..love …the doctor is treated as Messenger of God….whose touch works like a miracle in curing patient.
অসাধারণ সুন্দর এই লেখা টা। ডাক্তার রোগী সম্পর্ক কিন্তু সত্যি ই পুরো টা বিশ্বাসের ওপরেই নির্ভর করে।
লেখা পড়ে মন ভরে গেল
কিছু মনের মানুষের টান কোনদিনও উপেক্ষা করা যায় না।খুব ভাল লিখেছেন।
লেখাটা আগেও পড়েছি , আবারও আরো একবার পড়লাম । খুবই ভালো লেখা ।
মানবিকতাই আমাদের প্রথম ও শেষ পরিচয়…. এটা হারিয়ে আমরা আর যাই হই মানুষ নই…. রোগীর প্রতি একজন চিকিৎসকের এই দায়িত্ব ও ভালোবাসাই তাঁকে আপন করে তোলে… তাই তো নীলিমারেখায় হারিয়ে গেলেও নন্দরানীর প্রফুল্ল চিত্তে আজও আপনি বিরাজমান… ?
Very nicely potrayed the simplicity of ‘ Nandarani’.. It also shows how much faith and trust these people have on doctors… which enables to make a place in the heart of a doctor and flows into a sensitive and emotional write up!
Thanks for sharing
Practical yet emotional
অসাধারণ লেখা। ডাক্তারের মানবিকতার এক সুন্দর নিদর্শন। ডাক্তার আর রোগীর সম্পর্ক নির্ভরশীল বিশ্বাসের উপর যা তোমার গল্পের (সত্য ঘটনা) উপসংহার।
অসম্ভব ভাল লিখেছো, তোমার আরো মনোগ্রাহী লেখা পড়ার অপেক্ষায় রইলাম৷
অসম্ভব ভালো লেখাটা….পড়তে পড়তে ওই চরিত্র গুলোর মধ্যে …ওই সম্পর্ক গুলোর মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছিলাম …. বেঁচে থাক এমন সম্পর্ক…. জীবন তবেই মধুর হয়।