২৫শে এপ্রিল ১৯৩২, ডিভোর্সের মামলা দায়ের করলেন বান্টিঙ। অপমানিত মারিয়ন ঠিক করলেন, বান্টিঙের বিরুদ্ধে কোনও মামলাই লড়বেন না। বান্টিঙের কোনও অভিযোগের জবাবও দেবেন না তিনি। এদিকে আবার ব্লোডওয়েন-বান্টিঙ সম্পর্কের কথা অজানা ছিল না মারিয়নের বাবা ডা. উইলিয়ম রবার্টসনের। বান্টিঙের আচরণে ক্ষিপ্ত হয়ে, বান্টিঙের সেই অবৈধ সম্পর্ক প্রমাণের জন্য পাল্টা দু’জন গোয়েন্দা নিয়োগ করেন ডা. রবার্টসন। মামলা চলাকালীন অবশ্য বান্টিঙের বিরুদ্ধে তেমন কোনও তথ্য সংগ্রহ করে উঠতে পারেন নি সেই দুই গোয়েন্দা। ফলে, কোর্টে সমস্ত সওয়াল জবাব হলো এক তরফা। বান্টিঙ নিয়োজিত দুই গোয়েন্দা কোর্টে দাঁড়িয়ে সাক্ষ্য দিলেন। কোর্টকে তাঁরা জানান, ‘ওইদিন লিবৌরদেস ও মারিয়ন ঘনিষ্ঠ ভাবে সোফায় বসেছিলেন। লিবৌরদেসের বেশভূষা অবিন্যস্ত ছিল, হাঁটুর উপর তোলা ছিল মারিয়নের কাপড়ও। তাঁদের দেখে লিবৌরদেস দ্রুত হাতে জামা প্যান্ট ঠিক করতে থাকেন’। মারিয়ন এই মামলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করায় দুই গোয়েন্দার বক্তব্যই শেষ পর্যন্ত ঠাঁই পায় সরকারি নথিতে। বন্ধু মহলে লিবৌরদেস অবশ্য বলেন, গোয়েন্দারা মিথ্যা গল্প ফেঁদেছেন।
বান্টিঙের বিবাহ বিচ্ছেদ মামলা তৎকালীন কানাডার সংবাদ শিরোনামে চলে আসে। ট্যাবলয়েডগুলোয় নিত্যনতুন কেচ্ছা ছাপে। কেউ বান্টিঙ-মারিয়নের মারামারির খবর ছাপেন, তো কেউ মারিয়ন-লিবৌরদেস ঘনিষ্ঠতার অজানা কাহিনী ছাপেন। নানান মুখরোচক আলোচনার মধ্য দিয়ে অবশেষে মারিয়নের অবৈধ সম্পর্ক প্রমাণিত হয় কোর্টে। ২রা ডিসেম্বর ১৯৩২, বান্টিঙ মারিয়নের বিবাহ বিচ্ছেদ সম্পন্ন হয়। বিবাহ বিচ্ছেদের কয়েক বছর পর, টরন্টো শহর ছেড়ে চলে যান মারিয়ন। টরন্টো থকে ৩০ কিমি দক্ষিণে ওকভিল শহরে চলে আসেন মারিয়ন। এখানে স্থানীয় একটা স্কুলে ভর্তি করান বিলকে। একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে ‘হেড কিপার’ পদে চাকরি পেয়ে যান মারিয়ন। সেখানেই কাজ করতেন তিনি। কোর্টের রায় মেনে বান্টিঙ অবশ্য নিয়মিত খোরপোষের টাকা পাঠাতেন মারিয়নকে। শুধু তাই নয়, সপ্তাহান্তে বান্টিঙের সাথে নিয়মিত দেখা করতে আসতেন তাঁর পুত্র বিল। ১৯৪৬ সালে ক্যান্সারাক্রান্ত হয়ে মারা যান মারিয়ন।
মারিয়ন পর্ব সমাপ্তির সাথে সাথে ব্লোডওয়েন পর্বও সমাপ্ত হয় বান্টিঙের জীবনে। ব্লোডওয়েন অবশ্য ভেবেছিলেন একটা সফল পরিণতির দিকে যাবে তাঁদের সম্পর্ক। কিন্তু সে পথ মাড়ান নি বান্টিঙ। বান্টিঙের প্রেমে ব্যর্থ হয়ে বিরহিণী ব্লোডওয়েন তাঁর এই পরিণতির জন্য বান্টিঙকে দোষারোপ করে এক চিঠি লেখেন। সেই চিঠি আজও সংরক্ষিত আছে সংগ্রহশালায়। বান্টিঙ অবশ্য এই বিষয় নিয়ে আর কথা বাড়ান নি। বান্টিঙ চুপ করে যাওয়ায় ব্যাপারটা বেশি দূর গড়ায় নি আর।
বান্টিঙ-মারিয়ন সম্পর্ক তখন তলানিতে। ব্লোডওয়েনের সাথেও আর বিশেষ দেখা যাচ্ছে না বান্টিঙকে। ঠিক এমন সময় বান্টিঙের জীবনে নীরবে ছায়া ফেলে ছিলেন আরেক রমণী। দীর্ঘদিন ধরে অবশ্য লোকচক্ষুর অন্তরালেই ছিলেন সেই মোহিনী। বেশ কিছুদিন পরে সামনে আসে বান্টিঙের এই গোপন অনুরাগের কাহিনী। বান্টিঙের আঁকা দুটো ছবির দৌলতেই সামনে আসেন সেই নারী। বান্টিঙের আঁকা দুটো ছবির পিছনে লেখা ছিল এক নারীর নাম। প্রথম ছবিটা অক্টোবর ১৯৩০ সালের আঁকা। ‘পেনেট্যাঙ্গ’ [পেনেট্যাঙ্গুইসিন শহর, পিটার মলোনির জন্মস্থান] শীর্ষক এই ছবির পিছনে লেখা ছিল, ‘ন্যান্সিকে’। দ্বিতীয় ছবিটা মে ১৯৩১ সালে আঁকা। ‘সেন্ট আইরনি’ [সেন্ট লরেন্সের মোহনায় ছোটো গ্রাম] শীর্ষক এই ছবির পিছনে লেখা ছিল, ‘আদরের সাথে মিস ন্যান্সি আর্চারকে’।
বান্টিঙ-গবেষকদের মতে, নিজের আঁকা ছবির পিছনে সাধারণত কারও নাম লিখতেন না বান্টিঙ। কিন্তু এই ছবি দু’টোর পিছনে, স্পষ্ট হরফে ন্যান্সির নাম লেখা আছে। কেন? তার থেকেও বড় প্রশ্ন, কে এই ন্যান্সি আর্চার, যাঁকে নিজের আঁকা দু’টো ছবি উৎসর্গ করেছেন বান্টিঙ? সমসময়ের টরন্টো শহরে ন্যান্সি আর্চার কোনও চর্চিত নাম ছিল না। ফলে ন্যান্সি আর্চারকে খুঁজে পাওয়া বেশ সমস্যা হয়ে দাঁড়াল। তবে গবেষক-গোয়েন্দারা ন্যান্সি খুঁজতে কার্পণ্য করেন নি কোনও। বিস্তর খোঁজাখুঁজির পর অবশেষে সামনে আসে ন্যান্সির পরিচয়। সময়টা ১৯৩০-৩১ সাল, বান্টিঙের বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করতেন মিস ন্যান্সি আর্চার নামের জনৈক মহিলা। এই মহিলাকেই নিজের আঁকা দু’টো ছবি উৎসর্গ করেছিলেন বান্টিঙ। কিন্তু কেন? কেন ন্যান্সিকে নিজের আঁকা ছবি উৎসর্গ করেছিলেন বান্টিঙ? বিশেষত, সচরাচর যেখানে তিনি কাউকেই কোনও ছবি উৎসর্গ করতেন না। এই সমস্ত প্রশ্নেরই উত্তর মিলিত হচ্ছে, আপাতভাবে প্রমাণহীন একটাই সিদ্ধান্তে- এই মহিলাই গোপনে স্থান করে নিয়েছিলেন বান্টিঙের হৃদয়ে। কিন্তু বান্টিঙের হৃদয়ের কত গভীরে স্থান পেয়েছিলেন ন্যান্সি কিম্বা কতদিন তিনি ছিলেন বান্টিঙের হৃদয়ে সেই সম্পর্কে কোনও তথ্যর হদিশ পান নি গবেষক-গোয়েন্দারা।
বান্টিঙ ও হেনরিয়েটা বল |
১৯৩৬-৩৭ সালে টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে এম.এ. পড়তে আসেন হেনরিয়েটা বল[৫৪]। টরন্টো এসে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যাল বিভাগে একটা ‘পার্ট টাইম জব’ও পেয়ে যান তিনি। মেডিক্যাল ডিপার্টমেন্টে যাতায়াতের সুবাদে, ১৯৩৭ সালের শেষের দিকে, পরিচিত হন ডা. বান্টিঙের সাথে। হেনরিয়েটার রূপে মুগ্ধ হলেন বান্টিঙ। পড়ে গেলেন হেনরিয়েটার প্রেমে। দ্রুত বান্টিঙ ও হেনরিয়েটার মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠতে থাকে। বান্টিঙ এবার অনেক বেশি সতর্ক। ব্লোডওয়েনের মতো হেনরিয়েটার সাথে আর যত্রতত্র ঘুরতে দেখা যায় না বান্টিঙকে। তাঁদের সম্পর্ক গড়ে ওঠে গোপনেই। যদিও হেনরিয়েটা বান্টিঙকে নিয়ে খুব গভীরে কিছু ভাবেন নি তখনও। তিনি সুন্দরী, তাঁর বন্ধুর সংখ্যাও অনেক। তবে বন্ধুত্বের সীমা নিয়ে সদা সতর্ক থাকতেন হেনরিয়েটা। বন্ধুত্বের সীমার বাইরে কাউকেই প্রশ্রয় দিতেন না তিনি। এমনকি বান্টিঙকেও না। বান্টিঙ তো ভেবেই আকুল, এই মেয়ে আদৌ তাঁকে ভালোবাসে নাকি আর পাঁচজনের মতো নিছকই বন্ধু হিসেবেই দেখেন তাঁকে।
১৯৩৮ সালের শেষের দিকে, উচ্চতর পাঠের জন্য ইংলন্ড যাত্রা করেন হেনরিয়েটা। তা এখন বছর খানের জন্য যাওয়া। বান্টিঙ কিছুটা অস্থির হয়ে উঠলেন। বেশ কয়েক মাস হয়ে গেল আলাপ হয়েছে হেনরিয়েটার সাথে, অথচ বান্টিঙকে নিয়ে কিছুতেই নিজের অবস্থান স্পষ্ট করছেন না হেনরিয়েটা। এমতাবস্থায় হেনরিয়েটাকে চোখের আড়ালে যেতে দেওয়া কি ঠিক হবে? বয়সে নবীনা হেনরিয়েটার উপর পুরোপুরি ভরসা করতে পারছেন না বান্টিঙ। কি জানি, চোখের আড়ালে চলে গেলে, হেনরিয়েটার মনের আড়ালেও যদি চলে যান বান্টিঙ! আর সেই সুযোগে যদি অন্য কেউ স্থান করে নেন হেনরিয়েটার হৃদয়ে! হেনরিয়েটা যদি অন্য কাউকে ভালোবেসে ফেলেন! না, না, কোনও ঝুঁকি নিতে রাজি নন বান্টিঙ। প্রায় উদ্দেশ্যহীন ভাবে হেনরিয়েটার পিছু পিছু ইংলন্ডে এলেন বান্টিঙও। ইংলন্ড যাত্রা পথে জাহাজে বসে হেনরিয়েটা প্রসঙ্গে নিজের ডায়েরিতে বান্টিঙ লেখেন, “আমি খুবই অসুখী এবং ভীষণ একাকী আর এখন আমি পঞ্চাশের কাছাকাছি আর [এখনও] কোনও ঘর পাই নি [আমি]। … আমি ভালোবাসি তাঁকে কারণ আমি একজন স্বাস্থ্যবতী মহিলা হিসেবে বিবেচনা করি তাঁকে, যিনি সুস্থ বাচ্চার জন্ম দিতে পারেন। সামাজিক জীবন ও পদ নিয়ে উৎসাহী নই আমি। আমি কেবলমাত্র আমার গবেষণা আর আমার ঘর নিয়েই আগ্রহী- আর আমি একটা পরিবার চাই- আমি একটা কন্যা সন্তান চাই”।
বিবাহ বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি বান্টিঙের এক করুণ মানসিক অবসাদের চিত্র খুঁজে পাই আমরা এই ডায়েরির পাতায়। এই ছত্র ক’টার মধ্য নিহিত আছে, কেন উদ্বিগ্ন হয়ে হেনরিয়েটার পিছু পিছু ইংলন্ডে এসেছিলেন বান্টিঙ। আর ইংলন্ডে আসাটা যে মোটেও কোনও ভুল সিদ্ধান্ত ছিল না, কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই তা প্রমাণ হয়ে গেলো। ইংলন্ডে একাধিক বার হেনরিয়েটার সাথে দেখা করেন বান্টিঙ। বারংবার এই দেখা সাক্ষাতের মধ্যে দিয়ে হেনরিয়েটার মন জয় করতে সমর্থ হয়েছিলেন তিনি। ইংলন্ডেই বিবাহে সহমত হন দুজনে। ইংলন্ডে অবস্থানের বাকি দিনগুলোতে স্বামী-স্ত্রী পরিচয় দিয়েই থাকতেন তাঁরা।
পরের বছর কানাডা ফেরেন হেনরিয়েটা। দ্বিতীয় বিবাহে আর দেরি করেন নি বান্টিঙ। ২রা জুন ১৯৩৯ সালে বান্টিঙ-হেনরিয়েটার বিবাহ সম্পন্ন হয়। বিবাহের পৌরহিত্য করেন অ্যালিস্টনের রেভারেন্ড পিটার এডিসন। ইনি বান্টিঙের সেই শুভাকাঙ্ক্ষী যিনি ১৯১২ সালে, ডাক্তারি পড়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে বান্টিঙকে এগিয়ে যেতে সাহস জুগিয়ে ছিলেন। আজ বান্টিঙের নতুন দাম্পত্য জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে ফের তাঁকে সঙ্গ দিলেন পাদ্রি এডিসন। হেনরিয়েটা ও বান্টিঙের দাম্পত্য জীবন সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। সম্ভবত প্রথম বিবাহের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকেই জীবনের দ্বিতীয় দাম্পত্য নিয়ে সংযত ছিলেন বান্টিঙ। তাই তাঁর দ্বিতীয় বিবাহের জীবন সম্পর্কে বিশেষ কোনও তথ্য জানা যায় না। তবে বান্টিঙের মনস্কামনা পূর্ণ করে, এক কন্যা সন্তানের জন্ম দিয়ে ছিলেন হেনরিয়েটা। তাঁদের মেয়ের নাম ছিল এলিজাবেথ বান্টিঙ [৫৫]।
(চলবে)
[৫৪] কানাডার কুইবেক প্রদেশের ইউএসএ-কানাডা সীমান্তে ছোটো শহর স্ট্যানস্টিডে জন্মগ্রহণ করেন হেনরিয়েটা এলিজাবেথ বল (১৯১২-১৯৭৬)। মাউন্ট এলিসন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এ. পাশ করে টরন্টোয় এম.এ. পড়তে আসেন। এখানেই বান্টিঙের সাথে আলাপ হয় তাঁর। বান্টিঙের মৃত্যুর পর টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডাক্তারি পাশ করেন হেনরিয়েটা। আজীবন ‘মিসেস বান্টিঙ’ পরিচয় বহন করেই এসেছেন তিনি, কখনও দ্বিতীয় বিবাহে সম্মত হন নি হেনরিয়েটা বল।
[৫৫] এলিজাবেথ বান্টিঙের জীবন বৃত্তান্ত কিছু জানা যায় না। জানা যায় না, তাঁর জন্মের সঠিক দিনক্ষণও। শুধু জানা যায়, যৌবনে জনৈক জেমস ওয়ালিসকে বিবাহ করেন এলিজাবেথ বান্টিঙ। এলিজাবেথ ও জেমসের পুত্রের নাম হার্বার্ট ওয়ালিস।