পুরো ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে একটাও করোনার কেস পাইনি। মার্চের মাঝামাঝি থেকে আবার পেতে আরম্ভ করেছি। তারপর যত দিন যাচ্ছে, করোনার কেস বাড়ছে। শুধু গতকালই আমার ৯জন রোগীর করোনা ধরা পড়েছে। কেউ ফোনে জানাচ্ছেন, কারও বাড়ির লোক রিপোর্ট নিয়ে আসছেন, কেউ আবার রিপোর্ট হাতে নিয়ে নিজেই চলে আসছেন।
যারা এভাবে চেম্বারে চলে আসছেন তাঁরা কিন্তু আদৌ অশিক্ষিত নন। কিন্তু শিক্ষা ও সচেতনতার মধ্যে পার্থক্য আছে। করোনা পজিটিভ রোগী দিব্যি বাজার করে দুই ব্যাগ ভর্তি মালপত্র নিয়ে দেখাতে আসছেন। গালি দিচ্ছি, ‘এই অবস্থায় ঘুরে ঘুরে বাজার করলেন?’
অনুশোচনাহীন ভাবেই উত্তর দিচ্ছেন, ‘কী করব? বাড়ি শুদ্ধু সবাই পজিটিভ। জানাজানি হওয়ার পরে প্রতিবেশীরা যদি বাড়ি থেকে বেরোতে না দেয়।’
চৈত্রের গরমেও জ্বরের রোগীও অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে গেছে। জ্বরের সাথে গলা ব্যথা, জ্বরের সাথে পেট খারাপ, জ্বরের সাথে খুশ খুশে কাশি- পরীক্ষা করলেই পজিটিভ আসছে। দ্বিতীয় ঢেউ যে বাংলায় ঢুকে পড়েছে এই নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। এখন দেখার এটা কতদিনে প্রথম ঢেউয়ের ক্ষয় ক্ষতিকে পেরিয়ে যায়।
সংবাদ মাধ্যম, রাজনৈতিক দল, সাধারণ মানুষ কারোরই তাপ উত্তাপ নেই। সকলেই ভোট নিয়ে ব্যতিব্যস্ত। ১৯১৮ সালের স্প্যানিশ ফ্লুর সময়েও একই ঘটনা ঘটেছিল। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছিল। মিত্রপক্ষের দেশগুলিতে যেমন আমেরিকা, ইংল্যান্ডে ফ্লু’র দ্বিতীয় ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছিল সুনামির মতো। মানুষ মারা যাচ্ছিল হাজারে হাজারে। অথচ সে সব দেশের সংবাদ মাধ্যম রোগের ভয়াবহতা প্রকাশ করেনি। সংবাদ মাধ্যমের কণ্ঠরোধ করা হয়েছিল- কারণ রোগের ভয়াবহতা প্রকাশ পেলে সৈনিক ও দেশের মানুষদের মানসিক জোর, দেশপ্রেম কমে যেতে পারে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যতজন মানুষ মারা গেছিলেন, শেষ পর্যন্ত স্প্যানিশ ফ্লুতে তার থেকে বেশি মানুষ মারা গেছিলেন। প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ স্প্যানিশ ফ্লুতে মারা যান।
স্প্যানিশ ফ্লুর উৎপত্তি কিন্তু স্পেনে নয়। স্পেনে স্পানিশ ফ্লু খুব বেশি তাণ্ডবলীলা চালাতেও পারেনি। তবু এই অতিমারির নাম স্প্যানিশ ফ্লু হল কেন? স্পেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় নিরপেক্ষ রাষ্ট্র ছিল। অন্যান্য দেশের সংবাদ মাধ্যম এই মহামারীকে গুরুত্ব না দিলেও স্পেনের সংবাদ মাধ্যম প্রথম থেকেই মুক্তভাবে যথাযত গুরুত্ব দিয়ে এই মহামারীর খবর প্রকাশ করেছিল।
ভারতবর্ষে প্রায় দুকোটি মানুষ স্প্যানিশ ফ্লুতে মারা গেছিলেন। কিন্তু বৃটিশ সরকারের বদান্যতায় সে সব খবর খুব বেশি প্রচার পায়নি।
যদিও পশ্চিমবঙ্গের ভোট আর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মধ্যে কোনো তুলনা করা যায় না, তবু ভোটের কল্যাণে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ে আপাতত কারও মাথাব্যথা নেই। লোকজন দিব্যি মাস্ক ছাড়াই জ্বর গায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। মিছিলে, জনসভায় মারমার- কাটকাট ভিড় হচ্ছে। শারীরিক দূরত্ব, স্বাস্থ্য বিধি মানার কোনো বালাই নেই। করোনা আবার নিশ্চিতভাবে গুরুত্ব পাবে। তবে মে মাসের ২ তারিখের পর থেকে।
অনেক রোগীই জিজ্ঞাসা করছেন, ‘ডাক্তারবাবু, ৩ মে থেকে কি লকডাউন হবে? আরেকবার লকডাউন হলে মারা পড়ব। তার চেয়ে করোনা হওয়া অনেক ভালো।’
সকলেই জানেন ভোট শেষ হওয়ার আগে আর কিছু হবে না। যেমন চলছে চলবে। যা হওয়ার ভোটের পরে হবে।
“…১৯১৮ সালের স্প্যানিশ ফ্লুর সময়েও একই ঘটনা ঘটেছিল। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছিল..”
there is a minor typo. Should be First World War.