রাতের খুপরির একেবারে শেষে ন্যাকাইটিসের রোগী এলে পিত্তি জ্বলে যায়। ভদ্রমহিলাকে দেখে আমার তাই মনে হলো। সাজগোজ দেখে বোঝা মুশকিল, ডাক্তার দেখাতে এসেছেন, না বিয়ে বাড়িতে যাচ্ছেন।
মুখ খুলতেই বুঝলাম, আমার ধারণা অভ্রান্ত। ওনার সব উপসর্গই ন্যাকাইটিসের রোগীদের সাথে মিলে যাচ্ছে। ঘুম হয় না, নিশ্বাস কেমন আটকে আটকে যায়। মাঝে মাঝেই টেনে টেনে নিশ্বাস নিতে হয়। বুক ধড়ফড় করে।
মনটা খুশি খুশি হয়ে উঠলো। ক্রমাগত চশমার পাওয়ার বাড়লেও আমার “ক্লিনিক্যাল আই” টা বেশ জোরদার হয়ে উঠেছে। এক নজর দেখেই রোগ ধরছি৷
দ্রুত রুটিন কিছু শারীরিক পরীক্ষা সেরে ফেললাম। সবই স্বাভাবিক। ভদ্রমহিলা অতিরিক্ত মানসিক উত্তেজনা বা অশান্তিতে ভুগছেন। আত্মবিশ্বাসী হয়ে বললাম, ‘বরের সাথে কি ভয়ানক ঝগড়া হচ্ছে?’
ভদ্রমহিলা অবাক হয়ে বললেন, ‘কই না তো!’
‘তাহলে কার সাথে ঝগড়া। নিশ্চয়ই শাশুড়ির সাথে?’
ভদ্রমহিলা মুক্তোর মতো দাঁত বের করে হাসলেন। বললেন, ‘শাশুড়ির সাথে ঝগড়া করতে হলে আমাকে স্বর্গে যেতে হবে। এতো তাড়াতাড়ি স্বর্গে যাওয়ার ইচ্ছা নেই।’
‘তাহলে বর নিশ্চয়ই নেশা করে… রোজ মদ খায়।’
‘সে একটু আধটু খায়। তবে সমস্যার সেসব নিয়ে নয়। আসলে আমিই একটা প্রেমে পড়েছি।’
ডাক্তাররা চমকে গেলেও সেটা প্রকাশ করে না। তাতে রোগীদের আত্মবিশ্বাস কমে যেতে পারে। যেন এই ত্রিশ পেরোনো ভদ্রমহিলার পরকীয়া খুবই স্বাভাবিক এমন ভাব করে বললাম, ‘তাতে সমস্যা কী? এরকম কতো প্রেম আকচার হয়। আবার কেটেও যায়।’
ভদ্রমহিলা লাজুক মুখ করে বললেন, ‘মুশকিল হলো এটা আমার প্রথম প্রেম। আর প্রথম প্রেম মেয়েরা অন্তত ভোলেনা।’
কাঁচুমাচু মুখ করে বললাম, ‘আপনি বিবাহিতা, আর বলছেন এটা আপনার প্রথম প্রেম।’
ভদ্রমহিলা বললেন, ‘কেন? বিয়ে করলেই কী বরের সাথে প্রেম হবেই? কিছু কিছু মানুষকে হাজার চেষ্টা করেও ভালোবাসা যায়না। আমার পতি দ্যাবতা ঠিক তেমন একজন মানুষ।’
মানুষ কোনো কালেই যুক্তি নয়, তার প্রবৃত্তি দ্বারাই পরিচালিত হয়। সেইটেই কাজে লাগাবার চেষ্টা করলাম। বললাম, ‘দ্যাখেন, এই সময়টা আমার বড্ড খিদে পেয়ে যায়। যদি একটু সারসংক্ষেপ করেন, তাহলে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে খেতে পারি। আসলে খিদে পেলে বুঝতেই পারছেন তো… প্রেমের গল্পও ঠিক…’
ভদ্রমহিলা বললেন, ‘ছি… ছি…, না না, আমি তাড়াতাড়ি বলছি। আমার দেখাশোনা করে বিয়ে হয়েছে। বর ডব্লিউবিসিএস অফিসার। সবাই ভাবে অমায়িক ভদ্রলোক। উঁচু গলায় কথা বলে না, কখনো কারো উপর রাগ করে না। কিন্তু আমি জানি সে একটি জানোয়ার। টাকার জন্য করতে পারে না এমন কোনো অনৈতিক কাজ নেই। আর তার জীবনে একমাত্র বিনোদন নারী দেহ।’
‘দেখেন, আপনার হয়তো ভুল হচ্ছে…’
‘ভুল হওয়ার কিছু নেই। আগে সে আমার কাছে লুকাতো। হাতে নাতে ধরে ফেলার পরে আর লুকায়ও না। বস্তুত আমার প্রতি তাঁর কোনো ফিলিংসই নেই। আমার প্রতি কেন, পৃথিবীর কারো প্রতিই নেই। লোকটা আসলে অনুভূতি শূন্য, ভালোবাসাহীন এক ব্যক্তি।’
এতো বড়ো ফ্যাসাদে পড়লাম। কোথায় চারশো বাইশ সুগার নিয়ে আসবে, চটপট সুগারের ওষুধ লিখে, খাওয়া দাওয়া বুঝিয়ে ছেড়ে দেব- এখন তো মহাভারত শুনতে হবে মনে হচ্ছে। ‘বললাম, তাহলে ডিভোর্স করছেন না কেন? এরকম মানুষের সাথে একসাথে আছেন কেন?’
ভদ্রমহিলা বললেন, ‘আপনি তনুশ্রী সরকারের নাম শুনেছেন? ভালো দাবা খেলে?’
বললাম, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, মধ্যমগ্রামের এই বাচ্চা মেয়েটি এবার মেয়েদের মধ্যে স্টেট… নাকি ন্যাশনালে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে।’
‘অনূর্ধ্ব দশ ন্যাশনালে… তনুশ্রী আমারই মেয়ে। ওর জন্যই দাঁতে দাঁত চেপে লোকটার সাথে রয়েছি। মেয়েটার ভবিষ্যতটা যাতে নষ্ট না হয়।’
‘আপনি কিছু করেন না?’
‘হ্যাঁ, বসিরহাটে একটা প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষিকা। বিয়ের পর আমার বর অনেকবার চাকরি ছেড়ে দিতে বলেছে। ভাগ্যিস ছাড়িনি। হয়তো ও জানোয়ার না হয়ে মানুষ হলে ছেড়ে দিতাম। পুরোটা সময়ই আমার মেয়েকে দিতাম।’
‘এভাবে জোর করে একসাথে থাকলে আপনি তো মানসিক ভাবে আরো অসুস্থ হয়ে পড়বেন। আপনার যা সিম্পটম হচ্ছে, সবই এংজাইটির লক্ষণ।’
‘না, সেটার জন্য হচ্ছে না। ঐ লোকটাও যেমন আমায় কোনোদিন ভালোবাসেনি, আমিও তেমনি ওকে কোনোদিন ভালোবাসতে পারিনি। ভালোবাসলে তবে তো মানসিক আঘাত পাওয়ার প্রশ্ন। তাছাড়া আমি ঠিকই করে রেখেছি, মেয়ে একটু বুঝতে শিখলেই মেয়েকে নিয়ে আলাদা হয়ে যাব। ওর সাথে থাকলে মেয়েটাও কোনো দিন মানুষ হবে না। সমস্যা শুরু হয়েছে আমি প্রেমে পড়ার পর। যদিও প্রথমে আমি ভেবেছিলাম, এটা নিছকই বন্ধুত্বের সম্পর্ক। উনি বেড়াচাপায় একটি হাই স্কুলের বাংলার শিক্ষক। বিবাহিত- দুটি ছেলেও আছে। ট্রেনে একসাথে যেতে যেতে আলাপ। দারুণ ছোটোগল্প লিখতে পারেন। একজন শিক্ষিত সংবেদনশীল মানুষ। আমরা দুজন পুরো রাস্তা গল্প করতাম। আমিই বেশি বলতাম। সারাদিন কারো সাথে মন খুলে গল্প করতে পারিনা। বিয়ের আগে কবিতা লিখতাম। মাঝখানে কবিতা বিদায় নিয়েছিল। সেই কবিতাও আবার ফিরে এলো।’
বললাম, ‘সে তো ভালো ব্যাপার। এটা নিয়ে এতো টেনশনের কী আছে। দুটি বিপরীত লিঙ্গের মানুষের মধ্যে বন্ধুত্ব হতেই পারে।’
‘ব্যাপারটা শুধু বন্ধুত্বের পর্যায়ে রইল না। আমরা দুজন স্কুলের ছুটির পর একসাথে এদিক ওদিক যেতে শুরু করলাম। এবং কিছুদিনের মধ্যেই তিনি আমার সাথে ঘনিষ্ঠ হতে চাইলেন- মানে আকারে ইঙ্গিতে বোঝাতে শুরু করলেন। আর তার পর থেকেই আমার ভয়ানক একটা অপরাধ বোধ হচ্ছে। মনে হচ্ছে আমি অন্যায় করছি। ঐ মানুষটির স্ত্রীর সাথে, তাঁর ছেলে দুটির সাথে। রাতের পর রাত ঘুমাই না। হাত পা কাঁপে। আমি যে কী করব?’
ওষুধ পত্র দিয়ে ওনাকে বিদায় করলাম। বললাম, ‘ওনার যে সমস্যা সেই সমস্যা আমাকে না দেখিয়ে সাইকিয়াট্রির কাউকে দেখালে ভালো হয়। ব্যক্তিগত ভাবে আমার মনে হয় যে সম্পর্ক এতোটা মানসিক অশান্তি বয়ে আনছে, সেই সম্পর্ককে বয়ে না বেড়ানোই ভালো।
ভদ্রমহিলা বেশ কিছুদিন পর গতকাল আবার এসে হাজির। যথারীতি এবারও বেশ সাজগোজ করে এসেছেন। এসেই এক প্যাকেট মিষ্টি ধরিয়ে বললেন, ‘আজও খিদে পেয়েছে নাকি ডাক্তারবাবু? তাহলে এখনই খেয়ে নিন। আর যদি খিদে না পেয়ে থাকে তাহলে বাড়ি গিয়ে খাবেন।’
আমি বললাম, ‘আবার মিষ্টি এনেছেন কেন?’
ভদ্রমহিলা হেসে বললেন, ‘লোকে আনন্দে মিষ্টি খাওয়ায়। আমার ডিভোর্স হয়ে গেছে। বিয়ের চেয়েও ডিভোর্সেই বেশি আনন্দ পেয়েছি। সেই আনন্দেই মিষ্টি খাওয়ালাম।’
‘আর আরেকজনের খবর?’
‘তারও আর খবর নেই। শেষবার এখান থেকে যাওয়ার পর আর যোগাযোগ রাখিনি। উনি কথা বলতে এলে পরিষ্কার জানিয়েছি, আমি আর কোনো যোগাযোগ রাখতে ইচ্ছুক নই। তারপরও কয়েকবার ফোনে ম্যাসেজ পাঠিয়েছেন, হোয়াটসঅ্যাপে পূর্ণেন্দু পত্রীর কথোপকথন থেকে কবিতা পাঠিয়েছেন- কোনো জবাব দিই নি। মা আর মেয়ে বসিরহাটে ভাড়া বাড়িতে থাকি। দিব্যি আছি। ছুটি ছাটায় মধ্যমগ্রামে বাপের বাড়ি চলে আসি। শনি রবি মেয়ের চেস ক্লাসও থাকে।’
‘এবারে কী সমস্যা। এখন ঘুম হচ্ছে তো?’
‘দিব্যি ঘুম হচ্ছে। এবারের ঝামেলা অন্য। ভয়ানক পাঁজরে ব্যথা। ভালো করে নড়তে চড়তে পারছি না।’
‘লাগলো কী করে? পড়ে গেছিলেন নাকি?’
‘পড়িনি। পুলিশের লাঠির বাড়ি খেয়েছি।’
অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘পুলিশের লাঠির বাড়ি? সেকি! পুলিশ আপনাকে মারলো কেন?’
‘কাল সন্দেশখালি গেছিলাম। সেখানে একটা বিক্ষোভ মিছিলে হাঁটছিলাম। হঠাৎ পুলিশ আটকানোর চেষ্টা করল। আর হাতাহাতি লেগে গেল। লাঠির বাড়ি লাগার সাথে সাথে তখন কিছু বুঝতে পারিনি। আজ সকাল থেকে একেবারে নড়তেই পারছি না।’
আমি আরো অবাক হয়ে বললাম, ‘আপনি হঠাৎ সন্দেশখালি গেলেন কেন? আপনি কী রাজনৈতিক দলে যোগ দিয়েছেন নাকি?’
ভদ্রমহিলা হাসলেন। বললেন, ‘এটা আপনি কী বললেন ডাক্তারবাবু! রাজনৈতিক দলে না থাকলে সন্দেশখালি যাওয়া বারণ? একজন মেয়ে যদি আরেকজন অসহায় নির্যাতিতার পাশে দাঁড়ায় তাহলে কি তাকে পার্টি সদস্য হতেই হবে। আগামী কাল রবিবার, ছুটির দিন। আবার একাই সন্দেশখালি যাব।’
***************
★ভদ্রমহিলার মেয়ের নামটি পরিবর্তিত। খেলাটিও দাবা নয়। তবু যদি কেউ ভদ্রমহিলাকে চিনতে পেরে যান, দয়া করে পরিচয় গোপন রাখবেন।