২৪শে মার্চ, ২০২০
কোভিড ১৯ এর অতিমারী-সময়কালীন বিশেষ রোস্টারের আজ প্রথম দিনে আমার ডিউটি রয়েছে ব্লাড ব্যাংকে।
বাড়ি থেকে বেরোনো মাত্র আমার সারথি অভীক বলল—দিদি, পাম্পের অবস্থা কেমন কি থাকবে জানা নেই, আগে গাড়ির ট্যাংক ফুল করে নিই।
আমার বাড়ি থেকে বেহালা চৌরাস্তা যেতে গোটা তিনেক পেট্রল পাম্প পড়ে পথে। তার দুটো দেখলাম বন্ধ। আর তৃতীয়টির সামনে বাইকের লাইন দেখে, আশির দশকের হিন্দি অ্যাকশন ফিল্মের কথা মনে পড়ে যেতে বাধ্য।
চৌরাস্তা ছাড়িয়ে প্রথম যে পাম্পে একটু ভদ্রস্থ গোছের ভিড় দেখা গেল, অভীক গাড়ি ভিড়িয়ে দিল সেখানেই।
তেল ভরে ছুটলাম গন্তব্যের দিকে। ডায়মন্ড হারবার রোডের প্রায় প্রতিটি মোড় জিগ-স পাজ্লের ধাঁচে লোহার গার্ড রেল দিয়ে ঘেরা, তার গায়ে টিনের বোর্ড ঝোলানো— নাকা পয়েন্ট। আচ্ছা, এই নাকা কথাটা কি বাংলা? হিন্দিতে নাকাবন্দি বলে একটা কথা আছে শুনেছি, কিন্তু বাংলায়? মনে করতে পারলাম না।
খিদিরপুর অবধি নিরুপদ্রবে এসে, হেস্টিংস এর কাছে পথ আটকালো কলকাতা পুলিশ।
তারপর গাড়ির স্টিকারের দিকে চোখ রেখে এগিয়ে এলো আমার জানলার দিকে। “ডাক্তার?”
আমি জানলা দিয়ে মুণ্ডু বাড়িয়ে বললাম—“হ্যাঁ, মেডিক্যাল কলেজ।”
সার্জেন্ট ভদ্রলোক আঁতকে উঠে একলাফে তিন হাত পিছিয়ে গিয়ে হাঁক পাড়লেন—“যান, যান, বেরিয়ে যান!”
বুঝলাম, ‘রাজ্যের একমাত্র করোনা হাসপাতালে’র ট্যাগটা তোলা কষ্টকর হবে মেডিক্যাল কলেজের গা থেকে।
হাসপাতাল পৌঁছলাম।
ব্লাডব্যাংকে ঢুকে, যে শব্দটা প্রথম মস্তিষ্কে ঠাঁই করে ঠোক্কর মারল, সেটা হলো ‘প্যান্ডেমোনিয়াম’।
কয়েকটি ছেলেমেয়ে, তারা আমারই সহকর্মী, চিৎকার চেঁচামেচি করে কিছু বলতে চাইছে, তাদের কথার পিঠে কিছু নিরুপায় অসহায় মুখ, আর্তস্বরে কিছু বলার চেষ্টা করছে— এরা সেই মুমূর্ষু রোগীদের দুর্ভাগা বাড়ির লোক, যাদের ইচ্ছে থাকলেও কর্তৃপক্ষ ছুটি দিয়ে দিতে পারেননি, অবস্থা এতটাই সংকটজনক তাদের। সব মিলিয়ে যা আমার কানে ঢুকছে তা এক অর্থহীন শব্দব্রহ্ম!
উলের গোলার জট ছাড়াবার মতো শব্দজালের জট ছাড়িয়ে উদ্ধার হলো এক অসীম অব্যবস্থার ছবি।
এই বিশাল মেডিক্যাল কলেজের অসংখ্য কর্মচারীদের (তার মধ্যে চিকিৎসক, নার্সিং স্টাফ, ফার্মাসিস্ট, টেকনিশিয়ান, চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী, সাফাইকর্মী, ড্রাইভার, পি ডব্লু ডি-র ইলেকট্রিক এবং সিভিল বিভাগের কর্মী, কিচেন-কর্মী, লন্ড্রি কর্মী সকলেই রয়েছেন) বাড়ি থেকে আনা নেওয়ার জন্য সর্বসাকুল্যে পাঁচটি রুটে মাত্র পাঁচখানি বাস বরাদ্দ হয়েছে।
বাসগুলি মূল সড়ক থেকে গলি বা শাখা সড়কে তো ঢুকবেই না, উপরন্তু রুটও এত হ্রস্ব হয়েছে, যে অধিকাংশ কর্মীকে তিন-চার মাইল পায়ে হেঁটে এসে বাস ধরতে হচ্ছে। যেমন দক্ষিণের বাস যাবে গড়িয়া পর্যন্ত— চম্পাহাটির কর্মীটিকে এই লকডাউনের বাজারে নিজ দায়িত্বে গড়িয়া পৌঁছতে হবে। আবার উত্তরে বাস যাবে ব্যারাকপুর পর্যন্ত। এবার নৈহাটি কিংবা চাকদার কর্মচারী কিভাবে গণপরিবহণ ছাড়াই ব্যারাকপুর পৌঁছবে, তা ভূতে জানে!
জরুরি রোগীর বাড়ির লোকের অবস্থা আরও শোচনীয়। ব্লাড ব্যাংকের তো ভাঁড়ে মা ভবানী— গত আট দিনে একটি রক্তদান শিবিরও হয়নি। আর মানুষ যখন অতর্কিত রোগের প্রাদুর্ভাবে সরকারি নির্দেশে গৃহবন্দী, যথেষ্ট পরিমাণে ভীতও, সেই অবস্থায় স্রেফ পরোপকারের ইচ্ছে সম্বল করে একজন দুজন করে স্বেচ্ছা-রক্তদান করতে আসবে ব্লাড ব্যাংকে,এই ভয় আর অনিশ্চয়তার বাতাবরণে এমনটা ভাবাও এক ধরণের পাগলামি বৈকি! তো, এই গুরুতর অসুস্থ মানুষগুলো রক্ত পাবে কোথা থেকে?
জানেন, তবু এই স্বার্থপর, দেখনদারিসর্বস্ব সেয়ানা দুনিয়াটায় কিছু পাগল এখনো বসত করে—
পড়ে পাওয়া অবকাশে, মাংসের দোকানে লাইন না দিয়ে যারা লরির মাথায় চেপে হাসপাতালে ছুটে আসে স্বল্পপরিচিত মানুষের বিপন্ন ফোন পেয়ে, রক্ত দেবে বলে।
এঁদেরই ভরসায় টুকটুক করে চলছিল রক্তদান। হ্যাঁ, সোশ্যাল ডিসটানসিংয়ের ফরমান মেনেই।
ডোনার হিস্ট্রি নেওয়ার সময় অত্যুৎসাহী কোনো সম্ভাব্য রক্তদাতা সামাজিক দূরত্বের বিধি লঙ্ঘন করে আমার মুখের কাছাকাছি চলে এলেই আমার কোনো টেকনিশিয়ান ভাইয়ের ধমক শোনা যাচ্ছিল—পিছোন, পিছোন, অন্তত এক মিটার পিছিয়ে যান! অত মুখের কাছে এসে কথা বলার কি দরকার?
অফিস রুমে তখন ফার্মাসিস্ট রমেশ বাবু গলদঘর্ম— স্যানিটাইজার ক’ বোতল পাওয়া গেল রমেশদা? মাস্ক? এন নাইনটিফাইভ জুটবে না জানতাম, সার্জিক্যাল মাস্কও এত অল্প দিয়েছে স্টোর থেকে? আর কিছু আনুন না আনুন, হাইপোক্লোরাইট সলুশন যথেষ্ট ইনডেন্ট করুন আপনি— জানেন তো, ভাইরাস মারার অব্যর্থ ওষুধ ওটাই! হ্যাঁঃ, লিকুইড সোপ তো বেশি করে দেবেই, ওটাই সবচেয়ে সস্তার কিনা!
সত্যি বলছি জানেন, নিরন্ন মানুষের ভাতের থালা নিয়ে কাড়াকাড়ির ছবি মনে পড়ে যাচ্ছিল, এই স্যানিটাইজার-বুভুক্ষু বিপন্ন স্বাস্থ্যকর্মীদের হুড়োহুড়ি দেখে।
কেউ কেউ আবার হুমড়ি খেয়ে পড়েছে স্যারের টেবিলের উপর রাখা হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনের পাতার উপর। দুশো মিলিগ্রাম, না চারশো-র সাপ্লাই এটা? ডোজ কি রকম হবে? চোরা আতংকে পায়ের তলার মাটি আলগা হয়ে যাওয়া অসহায়, অপ্রস্তুত সরকারি স্বাস্থ্যকর্মীদের তখন কে বোঝাবে, যে এই ওষুধ করোনার চিকিৎসায় এখনো পরীক্ষামূলক স্তরেই রয়েছে— এর উপযোগিতা এখনো প্রশ্নাতীত নয়। তা ছাড়া এই ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও অনেক— সবাইকে নির্বিচারে খাওয়ানো চলে না এই ওষুধ— কে বোঝাবে? আর বুঝছেই বা কে?
ফেরার সময় হলো। হাসপাতালের কোয়ার্টারে থাকা দু-একজন কর্মচারী ‘রিলিভ’ করতে এলেন আমাদের। রাত্রের বাসে নাইট ডিউটির স্টাফ না ঢোকা পর্যন্ত ওঁরাই থাকবেন বুঁদির কেল্লা আগলাতে।
ছ ‘নম্বর গেটের কাছ থেকে ছাড়ছিল ফেরার বাস। নিজের গাড়ির স্বস্তিদায়ক সিটে পিঠ ঠেকিয়ে ঐ ভিড়ে ঠাসা বাসগুলো দেখে ভীষণই লজ্জা করছিল। কি করি! আমি যেদিকে ফিরব, সেদিকে তো প্রায় কেউই থাকে না। ভবানীপুরের বাসিন্দা, ব্লাড ব্যাংকের এক সহকর্মিণীকে তুলেছি গাড়িতে—নামিয়ে দিয়ে যাবো ওর বাড়ির কাছে।
বাকি পথ আমি একা।
বাড়ি পৌঁছে বেশ বিধ্বস্ত লাগছিল। আবার সেই অঙ্গ পরিমার্জন ও পরিচ্ছন্নতার বিধিনিয়ম পালনের পুনরাবৃত্তি!
দোতলায় ওঠার সিঁড়িতে পা রাখা মাত্র, আমার সদ্য অ্যালকোহলস্নাত মুঠোফোন বেজে উঠল নির্ভুল ছন্দে।
ধরলাম।
ওপাশে ভিতু, ইতস্তত গলা। আমার এক টেকনিশিয়ান ভাই, সুশান্ত।
“ম্যাডাম?”
“হ্যাঁ সুশান্ত, বল, কি হয়েছে?”
একটুখানি দ্বিধা আর অনেক খানি ভয় মেশানো কাঁপা কাঁপা গলায় বলল সে—“ম্যাডাম, আমি যেখানে থাকি, সেখানে বাড়ির মালিক বলে দিয়েছে—হয় বাড়িতে একুশ দিন টানা থাকো, নয়ত হাসপাতালে গিয়ে থাকো এই ক’দিন। এই রকম যাওয়া আসা করে এখানে থাকা যাবে না। আমি এখন কি করব ম্যাডাম?”
(চলবে)