জবা পাগলি ছিল আমাদের পাড়ার পাগলি৷ আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তাটা যেখানে নারকেলবাগানে গিয়ে শেষ হয়েছে, সেখানে; খাল পেরোনোর বাঁশের সাঁকোটায় না-উঠে বাঁ দিকে ঘুরলে যেখানে লোকচলাচল কমে যায়, সেখানে নারকেলবাগানের উলটোদিকের ফুটপাথের ওপরে একটা পাতার ঝুপড়িতে থাকত৷ সারাদিন বসে থাকত আমাদের রাস্তায় কোনও বাড়ির গেটের সামনে৷ কোনও দিন আমাদের, কোনও দিন অন্য কারও৷ কারও সঙ্গে কথা বলত না, কেউ কিছু বললে উত্তর দিত না৷ চুপ করে নিঃশব্দ মৌনী জীবন কাটাত৷ বাড়ির মেয়েরা (আমাদের ছোটোবেলায় তাদের বলত বৌ-ঝি, আজ বললে আমার কয়েকজন বন্ধু রে-রে করে তেড়ে আসবে) ওকে রোজ কিছু না কিছু খেতে দিত৷ রান্না শেষ হলে কেউ একটা কাগজে, কেউ একটা এনামেল করা বাটিতে বা সানকিতে খানিকটা রান্না করা তরকারি, সঙ্গে ভাত বা রুটি বা পাউরুটি এনে গেটের কাছে জবা থাকলে ওকে দিয়ে দিত, দূরে থাকলে মুখ তুলে ডাকত, “জবা, এসো…” (অনেকে ‘আয়’ বলত। ‘আসুন’ তো কাউকেই বলতে শুনিনি৷ পাগলিকে অত সম্মান কেউ করত না)। জবা-ও উঠে আসত৷ কেউ ওর হাতে কাগজ বা বাটিটা দিত, বেশিরভাগই নামিয়ে রাখত রাস্তায়৷ জবা নিঃশব্দে তুলে নিয়ে চলে যেত কোথায়৷ হয়ত ওর পাতার ঝুপড়িতেই৷ যারা বাসনে খাবার দিত, তারা পরে দেখত ধোয়ামোছা সাফ বাসন কখন ফেরত দিয়ে গেছে জবা৷ কোথায় দিত, তা-ও নির্দিষ্ট ছিল৷ কারও গেটের বাইরে ফুটপাথের ওপরে, কারও বা গেটের নিচ দিয়ে ভেতরেই। আবার কারোর গেটের পাশের পাঁচিলের ওপর৷ মাকে শুনেছি সে নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে হাসাহাসি করে গল্প করতে — এদিক নেই, ওদিক আছে! থালাবাসন ধুয়ে ফেরত দেয়া! ছোটোবেলায় অবাক হয়ে ভেবেছি এতে হাসির বা আশ্চর্য হওয়ার কী আছে? তখন বুঝতে পারিনি, পরে বুঝেছি পাগল যতক্ষণ অন্যের অসুবিধা সৃষ্টি না করছে ততক্ষণ তার পাগলামি সমাজ মেনে নিতে আপত্তি করে না, কিন্তু সে স্বাভাবিক কাজ করলেই সবার চোখ কপালে ওঠে৷
তখন আমার বয়েস বোধহয় বছর দশেক৷ ক্লাস ফাইভ৷ আমাদের পাড়ার সব দশ-বারো বছর বয়সীদের হিরো অমিতদার স্কুলে আমরা তিনজন — সুবোধ, অতীন আর আমি — ক্লাস ফাইভে ভর্তি হয়েছি, ফলে পাড়ার সেরা স্পোর্টসম্যান অমিতদা যেখানেই খেলতে যায়, সেখানেই আমরা পেছনে পেছনে যাই৷ ক্রিকেটের মাঠে, ফুটবল ফিল্ডে, এমনকি একবার অমিতদার কল্যাণে নন্দননগর টেনিস কোর্টও দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল৷ ওই সেদিনই, সেমিফাইনালে অমিতদা হেরে যাবার পর আমরা দূরের সাঁকো দিয়ে খাল পেরিয়ে বাড়ি আসছিলাম, অমিতদার কিনে দেওয়া ছোলা-মাখার শালপাতা চাটতে চাটতে। তখন সন্ধের অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে৷ জবা পাগলির ঝুপড়ির কাছাকাছি এসে অতীন বলল, “বাবা, কীরকম অন্ধকার! তার ওপর ধারেকাছে জনমানুষ নেই! কী করে কেউ থাকে এমন জায়গায়? আমি হলে তো ভয়েই আধমরা হয়ে যেতাম৷”
সুবোধ হাত থেকে শালপাতাটা ফেলে দিয়ে জিনসে হাত মুছতে মুছতে বলল, “পাগলরা ভয় পায়? কী যে বলিস!”
আমরা সবাই হাসতে যাব, এমন সময় অমিতদা হঠাৎ বলল, “ও আবার কী কথা? পাগল বলে ভয় পাবে না?”
সুবোধ আবার বলল, “পাগলরা ভয় পায়? ওদের কি আমাদের মতো অনুভূতি আছে?”
অমিতদাও শালপাতাটা ফেলে দিয়ে আমার হাতে টেনিস র্যাকেটটা দিয়ে হাতে হাত ঘষে শুকিয়ে নিতে নিতে বলল, “সব আছে৷ পাগল মানে মনের অসুখ হয়েছে৷ মনুষ্যত্ব তো চলে যায়নি।”
এই প্রথম আমাকে কেউ বলল জবা পাগলি আমাদেরই মতো কেউ। জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলাম, তুমি কী করে জানলে? এমন সময় অমিতদা আবার একটা অবাক করা কথা বলল।
বলল, “ও কিন্তু পাগল নয়৷”
“পাগল নয়?”
“ওর কোনও অসুখ নেই৷”
সে আবার কী কথা৷ বললাম, “নেই তো ও ওরকমভাবে থাকে কেন?”
অমিতদা বলল, “ওরকমটা কী রকম?”
বললাম, “নোংরা, কালিঝুলি মাখা, চান করে না, ভিক্ষে করে খায়, বাড়িঘর নেই…”
অমিতদা বলল, “সারা পৃথিবীতে কত লোক আছে জানিস, যাদের বাড়িঘর নেই, যারা দুবেলা খেতে পায় না, চান করার জন্য জল দূরের কথা, খাবার জল পর্যন্ত নেই… জানিস? থাকিস বড়োলোক বাবার ছাদের নিচে, অভাব কাকে বলে জানিস না৷ হত ওরকম দশা, বুঝতি কত ধানে কত চাল৷ আর তাছাড়া, মনে রাখিস, ও ভিক্ষে করে না৷ আজ অবধি কোনও দিন করেনি, কোনও দিন করবেও না৷ পাড়ার কাকিমা-বৌদিরা দিলে খায় — কোনও দিন দেখেছিস, কারও গেটে দাঁড়িয়ে বলেছে খেতে দাও?”
অমিতদা আরও বলেছিল, জবা একসময় গ্রামে থাকত, বিয়ে হয়েছিল শহরে৷ কিন্তু পর পর তিন বছর তিনটে মরা ছেলে জন্মেছিল বলে শ্বশুরবাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল৷ ঘুরতে ঘুরতে এখানে এসে পড়েছে৷ এখন যেখানে ওর বাসা, সে জায়গাটা লোকের চলাচলের পথে পড়ে না বলে ওকে কেউ জ্বালায় না৷ তার ওপর ফুটপাথের যে পাঁচিলের গায়ে ওর ঝুপড়ি, তার ওধারে সরকারি আবাসনেও আজকাল কেউ থাকে না বলে ওদিক থেকেও কেউ আপত্তি করে না৷
সুবোধ বলল, “কিন্তু পাগলি নাম হল কী করে? পাগলামি না করলে?”
অমিতদা বলল, “নাম দিলেই হল একটা৷ নোংরা থাকে, চুল আঁচড়ায় না, আমাদের মতো নয় — ব্যাস… বলে দাও, পাগল৷ আর ও-ও হয়ত দেখল পাগলি নাম হলে লোকে জ্বালাতন করবে কম…”
অতীন বলল, “পাগল বলে কম জ্বালাতন করবে? লোকে তো পাগলদের পেছনে লাগে৷”
অমিতদা বলল, “এখন বুঝবি না। বড়ো হ, দেখবি মেয়েদের অনেক রকম জ্বালাতন সহ্য করতে হয়৷”
অমিতদার এহেন বিশ্বাসঘাতকতায় খুব আহত হলাম৷ না হয় আমাদের চেয়ে পাঁচ বছরের বড়ো, তাই বলে কি আমরা এতই অবুঝ? অভিমান লুকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি জানলে কী করে এত কথা?”
ও নাকি এক সময়ে অমিতদাদের বাড়ির নিচে থাকত৷ এক ঝড়ের রাতে রাস্তার আলোর পোস্ট ভেঙে পড়ে চোট পায়, তখন অমিতদার বাবা-মা ওকে হাসপাতাল নিয়ে যায়। ফিরে আসার পরে অমিতদাদের বাড়িতে ছিল ক-দিন৷ অমিতদা তখন ক্লাস থ্রি-তে পড়ে৷ আমরা তো আরও কত ছোটো৷ অমিতদার বাবা-মা ওর জন্য একটা হোম-এর বন্দোবস্ত করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু জবা রাজি হয়নি৷ অমিতদাদের বাড়ির নিচে একটা কল ছিল, অমিতদার বাবা চেষ্টা করেছিল ব্যবস্থা করতে যাতে জবা সেখান থেকে জল নিতে পারে, কিন্তু ফ্ল্যাটবাড়ির দারোয়ান আর অন্যান্য কর্মচারীরা আপত্তি করায় অন্য ফ্ল্যাট-মালিকরা রাজি হয়নি৷ তারপর অমিতদার মা জবাকে বলে ওদের ফ্ল্যাট থেকেই জল নিতে৷ সেটাও পাড়ার ভদ্রলোকেদের সহ্য হয়নি৷ কিছুদিন পরে একদিন থানা থেকে পুলিশ আসে ফুটপাথে জবার আস্তানায়৷ তখন অবশ্য জবা ধারেকাছে ছিল না৷ ওর বাড়িও এখন যেমন পাতার ছাউনি দেওয়া ঝুপড়ি, তেমনও ছিল না৷ খোলা আকাশের নিচেই শুত৷ তা-ও, যতটুকু ছিল, ছেঁড়া কাপড়, গায়ে দেবার কাঁথা, দু-একটা কার্ডবোর্ডের বাক্সে ওর অকিঞ্চিকর কিছু সম্পত্তি — লাঠি দিয়ে এবং লাথি মেরে ছড়িয়ে দিয়েছিল রাস্তার ওপরে৷
“আমাদের বাড়িতে, তিন তলার চার নম্বর ফ্ল্যাটে তখন থাকত একজন, ভট্টাচার্য৷ তোদের টুবলুর দাদু, রে৷ মহা…” বলে পরের কথাটা গিলে নিয়ে অমিতদা বলেছিল, “ইয়ে ছিল… ও-ই ছিল পাণ্ডা৷ আর তার সঙ্গে ছিল তোদের পাশের বাড়ির কোকোনদ সরকার৷ ও-ও আর এক৷ তার ওপর ওর পুলিশ বন্ধু আছে৷ তার পর থেকেই জবামাসি থাকত নারকেল বাগানে৷ পরে এখনকার জায়গাটা বেছে নিয়েছে৷ এখন ওকে কেউ জ্বালায় না৷”
এক বিকেলে অনেক সমাজশিক্ষা নিয়ে ফিরেছিলাম বাড়ি৷ শুধু পাগল কাকে বলা যায়, সেটুকু নয়, সবচেয়ে বেশি নাড়া দিয়েছিল অমিতদার বড়োলোকের সংজ্ঞা৷ সত্যি তো, আমরাও তো বড়লোক৷ নিজেদের বাড়িতে থাকি, দুবেলা খেতে পাই৷ সবচেয়ে বড়ো কথা, এটা উপলব্ধি করে সব থেকে বেশি তাজ্জব লেগেছিল — আমি বাথরুমে স্নান করি! নিজের ইচ্ছেমতো, দরজা বন্ধ করে৷ রাস্তায় চলতে কত দেখেছি, ফুটপাথের ‘টাইমের কলে’ জল নিতে লাইন, জল নিয়ে মারামারি ধাক্কাধাক্কি৷ গলা থেকে পা অবধি পোশাক পরা মহিলাদের সেই অবস্থায় সাবান মাখা… ততদিন নিজেকে কখনও সেভাবে প্রিভিলেজড ভাবিনি, যেমনটা ভাবিয়েছিল অমিতদা৷ কাজের মাসি মালতিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “তোমাদের বাড়িতে আলো আছে? বাথরুম?” আছে, আমাদের বাড়ির মতো না হলেও আছে, জেনে মনে হয়েছিল, মালতিও জবার চেয়ে বড়োলোক। জবামাসির চেয়ে৷
*
অমিতদার স্কুল শেষ হয়ে যাবার পর দেখাসাক্ষাৎ কমে গেল৷ আমাদেরও পড়ার চাপ বাড়ল, ক্লাস এইট এখন, নিঃশ্বাস ফেলতে গেলেও ফুরসত খুঁজি৷ একদিন সকাল থেকে বুঝতে পারি পাড়ায় চাপা উত্তেজনার আবহাওয়া৷ মালতি আর মার চাপা-গলার ফিশফিশ শুনতে পাই, “এক্কেবারে সদ্য, গো, জলে ভাসতেছে…”
দোতলার বারান্দায় গিয়ে দেখি খালের ধারে উত্তেজিত জনতার ভিড়, এখান থেকে অনেক দূর, তাই বোঝা যাচ্ছে না কিছু৷ রান্নাঘরে গিয়ে মা-কে জিজ্ঞেস করলাম, “কী হয়েছে, মা, খালধারে?”
মা রুটি সেঁকতে সেঁকতে গলাটা শক্ত করে বলল, “কিচ্ছু হয়নি। যাও পড়তে বসো৷ চতুর্দিকে মন দিতে হবে না৷”
একটু পরেই বাইরের দরজায় ঘণ্টা দিল কে, আমি সাবধানে দোতলার সিঁড়ির বাঁকে এসে দাঁড়িয়ে শুনলাম পাশের বাড়ির কোকোনদ সরকার বাবাকে কী বলছে৷ সরকারকাকুর কথা শুনে বুঝলাম খালধারে যা হয়েছে তার দায় সরকারকাকু জবা পাগলির ওপর চাপানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু বাবা মানতে চাইছে না৷ বাবা বলছে, “না, না, মিঃ সরকার, হতে পারে না৷ আপনি ভেবে দেখুন, রোজ রাস্তায় ঘুরছে মেয়েটা, আমাদের বাড়ির মহিলারা রোজ দেখছে, খেতে দিচ্ছে… কেউ খেয়াল করল না? জানেন, মেয়েদের চোখে ধুলো দেওয়া অত সহজ নয়?”
তা-ও সরকারকাকু ছাড়বে না৷ কী একটা বলে বলল, “আরে, পাগলা গারদে নিয়ে গিয়ে ফেলে আসলেই হয়… শি ইজ নট ফিট্ টু লিভ্ ইন সিভিলাইজড্ সোসাইটি৷”
এবার বাবার গলায় যে ইস্পাতটা শুনলাম, সেটা খুব কমই শুনি, আর যতবার শুনি, ততবারই রক্ত ঠাণ্ডা হয়ে যায়৷ বাবা বলল, “আই অ্যাম স্যরি টু সে দিস, মিঃ সরকার, কিন্তু কেউ যদি সমাজে অন্য কারও বেঁচে থাকার অধিকার নিয়ে মতপ্রকাশ করে, তাহলে তাঁর সঙ্গে কিছু আলোচনা করারই কারণ দেখি না৷”
অবাক গলায় সরকারকাকু বলল, “কী বলছেন আপনি? ওদের মতো মিনিংলেস এক্সিস্টেনস আর হয়?”
বাবা বলল, “আপনি আসুন, আমার অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে৷”
সরকারকাকু ছাড়ার পাত্র নন, বেরোবার আগেও চেঁচিয়ে গেলেন, “আপনার আমার ছেলে-মেয়েরা এখানে বড়ো হচ্ছে৷ শি ইজ আ ব্যাড ইনফ্লুয়েনস৷ পরে বলতে আসবেন না, যে আমি ওয়ার্ন করিনি৷” বাগানের গেটটা বন্ধ না করেই বেরিয়ে গেলেন।
গেট বন্ধ করে বাবা বাগান পেরিয়ে ঘরে ঢোকার আগেই আমি পড়ার টেবিলে৷
ভেবেছিলাম স্কুলে যাবার আগে খালধারটা ঘুরে দেখে যাব, কিন্তু একে তো আমার সঙ্গে সঙ্গে মা বেরিয়ে এসেছে গেট অবধি, আর খালধারের দিকে চেয়ে আমার চক্ষু চড়কগাছ! পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ, ভিড়ও সকালের চতুর্গুণ। বাস স্টপে পৌঁছে অবশ্য কপাল ফিরল। অমিতদা যাচ্ছে কলেজ৷ বলল, “কী রে, অনেক দিন দেখা নেই?”
শিষ্টালাপ করার সময় আমার নেই, বললাম, “খালধারে কী হয়েছে, অমিতদা? ভিড়ে ভিড়, পুলিশ…”
অমিতদা বলল, “ও মা, এখনও জানিস না?”
অমিতদার মুখে শুনলাম, খালের জলে ভোরবেলা একটা একেবারে সদ্যোজাত বাচ্চার মৃতদেহ কোত্থেকে ভেসে এসে কাঠের সাঁকোর মাঝামাঝি বাঁশের খুঁটির গায়ে ঠেকে রয়েছে৷ পুলিশে খবর দেওয়া হয়েছে, কিন্তু পুলিশ বলেছে জলে থাকলে ওটা জলপুলিশের আওতায়৷ জলপুলিশ নৌকো নিয়ে এসেছে, নৌকোর ঢেউয়ে দুলতে দুলতে সে দেহ এসে এদিকের পাড়ের কাছে পৌঁছেছে৷ তা-ও জলে, তাই আমাদের থানা বলেছে ওদের কিছু করার নেই৷ জলপুলিশ কিছু না করে চুপ করে বসে রয়েছে, কিছুক্ষণ পরে ডাঙায় অপেক্ষমাণ স্থলপুলিশ বুঝেছে জলপুলিশ অপেক্ষা করছে কতক্ষণে ভাঁটা হবে, জল কমে বাচ্চাটার দেহ ডাঙায় ঠেকবে৷ বুঝতে পেরে আমাদের থানার ওসি নাকি পাড় বেয়ে নেমে পা দিয়ে মৃতদেহটা আবার জলে পাঠানোর তোড়জোড় করছিলেন, কিন্তু সমবেত জনতা প্রায় ক্ষেপে উঠছে দেখে সে প্রচেষ্টায় বিরত হয়ে চেষ্টা করেছিলেন হাতের রুল দিয়েই কাজটা করতে। কিন্তু একে অনেকটা দূর, তায় ডাঙার কাছের লতাপাতায় বাচ্চাটা জড়িয়ে গেছে বলে পারেননি, রুলটাও পড়ে গেছে জলে৷ এদিকে কে আবার পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার কথা জানিয়ে দিয়েছে স্থানীয় এমএলএ-কে৷ তিনি আবার পূর্তমন্ত্রীও বটে৷ হাজির হয়েছেন তখনই৷ পুলিশের কারবার দেখে রেগে প্রায় বাপ-মা তুলে দুই ওসির শ্রাদ্ধ করেছেন জনসমক্ষেই৷ এখন তাই ডেডবডি তোলার ব্যবস্থা হচ্ছে৷
আমি বললাম, “কোকোনদ সরকার এসেছিল আমাদের বাড়িতে৷ বলছে ওটা নাকি জবামাসির…”
“মানে?” অমিতদা প্রায় চেঁচিয়ে উঠল৷ “ইয়ার্কি নাকি?”
আমি বললাম, “বাবা বলেছে, হতে পারে না৷ এতদিন ধরে পাড়ার মেয়েরা কেউ বুঝতে পারল না?”
অমিতদার বাস এসে গেছে৷ বলল, “মেসোমশাই লজিক্যাল মানুষ, কিন্তু আর সবাই তো নয়৷”
অমিতদা বাসে উঠে পড়েছে, আমি চেঁচিয়ে বললাম, “বলেছে সমাজে বাস করার যোগ্য নয়, ব্যাড ইনফ্লুয়েনস৷”
বাস ছেড়ে দিয়েছে৷ অমিতদাও চেঁচিয়ে বলল, “বাবাকে ফোন করে বলছি, বাবা কিছু একটা ব্যবস্থা করবে… তুই স্কুলে যা…” আরও কী বলল শুনতে পেলাম না৷
আজকাল আমাকে সপ্তাহে তিনদিন যেখানে ফিজিক্স টিউশনিতে যেতে হয়, সেখানে যাওয়া আসার সবচেয়ে সহজ রাস্তাটা খালধার দিয়ে৷ জবামাসির ঝুপড়ির পাশ দিয়েই যাতায়াত৷ আমি অবশ্য বিকেলে যখন যাই, আর সন্ধেবেলা যখন ফিরি, তখন জবামাসিকে দেখি না৷ অমিতদার বাড়ি গেছিলাম একদিন, শুনলাম ওই ঘটনার পরে জবামাসি আর রাতে ওখানে থাকছে না৷ তবে দিনের বেলা, পুরুষরা সবাই বেরিয়ে গেলে আবার আগের মতোই বসে থাকে আমাদের রাস্তায় — পাড়ার মহিলারাও আগের মতোই খাবার দেন৷ কিছুদিন পরে ব্যাপারটা নিয়ে আর কেউ কথা বলে না, সবাই ভুলেই গেছে বোধহয়।
হপ্তাকয়েক পরে, বাড়ি ফিরছি, তখন রাত প্রায় সাড়ে আটটা৷ আকাশটা মেঘলা হয়ে ছিলই দুপুর থেকে, হঠাৎ হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি এল৷ খালধারের রাস্তায় একদিকে নারকেলবাগান, অন্যদিকে সরকারি হাউসিং-এর দেওয়াল৷ বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচার কোনও উপায় নেই৷ অন্যদিন হলে বেশি ভাবতাম না, প্লাস্টিকে মোড়া বই-খাতা হয়ত একটু ভিজত, কিন্তু তার মধ্যেই হেঁটে চলে যেতাম। কিন্তু আজ যে সঙ্গে রয়েছে সুদেষ্ণার নোট-খাতা। অন্যের খাতা ভেজানো উচিত হবে না বলে হাতের কাছে যে আশ্রয়টা ছিল সেখানেই ছুটে ঢুকলাম। জবামাসির ঝুপড়ি।
ভেতরে ঢুকেই যেটা খেয়াল করলাম তা হল খুব অন্ধকার নয়। অতীন যে বলেছিল অন্ধকারে ভয় করবে, তেমন সম্ভাবনা নেই। ঝকঝক না করলেও রাস্তার সোডিয়াম ভেপার ল্যাম্পগুলোর লালচে হলুদ আলো ভেতরটাকে খানিকটা হলেও আলোকিত করে রেখেছে। একেবারে ভেতরের কোণগুলো অন্ধকারে মোড়া, কিন্তু অত ভেতরে তো আমার যাবার দরকার নেই। নজর দিলাম বাইরে। ওরে বাবা! কী বৃষ্টি! চারিদিক সাদা হয়ে গেছে। এই বৃষ্টিতে পথ হাঁটতে গেলে বই-খাতা শুধু ভিজত না, হয়ত গলেও যেত!
মনটা রাস্তার আর বৃষ্টির দিকে ছিল বলে, আর আমার ফেরার সময় জবা মাসি সাধারণত থাকে না বলে ভেতরের অন্ধকার থেকে যখন গলাটা এল তখন ভয়ানক চমকে উঠেছিলাম।
“ওটা আমার বাচ্চা না…”
চমকে উঠে বলেছিলাম, “কে?”
গলাটা ভেসে এসেছিল আবার। “আমার বাচ্চা না।”
বলেছিলাম, “কে? জবামাসি?”
উত্তর আসেনি। বলেছিলাম, “আমি একটুখানি বৃষ্টির জন্য দাঁড়িয়েছি। চলে যাব। আমি এই পাশের রাস্তায় থাকি।”
কিছুক্ষণ নৈঃশব্দের পরে শুনেছিলাম, “আমার না।”
নিশ্চিন্ত করার জন্য বলেছিলাম, “সেজন্য আসিনি। শুধু বৃষ্টির জন্য দাঁড়িয়েছি। চলে যাব এক্ষুনি।”
ভেতরে একটা উশখুশ শব্দ হয়েছিল। উঠে বসেছে না শুধু নড়েছে বুঝতে পারিনি। জিজ্ঞেস করেছিলাম, “তোমার আলো নেই? তুমি সারারাত অন্ধকারেই থাকো?”
উত্তর পাইনি।
বৃষ্টি থেমে গেছিল মিনিট দশেকের মধ্যেই। অত জোর বৃষ্টি বেশিক্ষণ চলে না। বলেছিলাম, “আমি আসছি।” তারপর কী মনে হয়েছিল, পকেটে হাত দিয়ে যা টাকাপয়সা ছিল মুঠো করে বের করে নিয়েছিলাম। ততক্ষণে ঝুপড়ির ভেতরের অন্ধকারে চোখটা আর একটু সয়ে গেছে। দেখতে পাচ্ছি কোথায় শুয়ে আছে জবামাসি। এক-পা এগিয়েছিলাম, কিন্তু মনে হয়েছিল তাতে ও যদি ভয় পায় — তাই আর না গিয়ে মাটির ওপরেই মুঠো করে টাকাপয়সাগুলো রেখে দিয়ে বলেছিলাম, “এটা তোমার।” তারপরে বেরিয়ে গেছিলাম, আর পেছনে ফিরে তাকাইনি।
বাড়ি যেতে মা বলেছিল, “ছাতা নিয়ে যাসনি? অবশ্য নিয়ে গেলেই বা এই বৃষ্টিতে কী হত? বাবা কী নামালো! আমি ভেবে মরছি…”
অল্প ভেজা মাথাটা তোয়ালে দিয়ে মুছতে মুছতে বলেছিলাম, “একটা মোবাইল ফোন যদি দিতে তাহলে ফোন করে বলে দিতাম কোথায় আটকে আছি…”
মা বলেছিল, “তাই তো, বেশি ভিজিসনি তো… কোথায় দাঁড়িয়েছিলি? স্যারের বাড়ির কাছেই কোথাও অপেক্ষা করছিলি? আমি স্যারকে ফোন করেছিলাম, বললেন, দশ মিনিট হল বেরিয়ে গেছে।”
কথা ঘুরিয়ে বলেছিলাম, “খিদে পেয়েছে।”
পরদিন সকালে একটা পুরোনো ফোন বাবা এনে দিয়েছিল আমার হাতে।
এর পর বার কয়েক গিয়েছিলাম জবামাসির ‘বাড়ি’। হাতে এক্সট্রা কিছু পয়সা এলেই ফিজিক্স টিউশনি থেকে ফেরার পথে জবামাসিকে দিয়ে বাড়ি ফিরতাম৷ একবার মার কাছ থেকে চেয়ে একটা পুরোনো শাড়ি দিয়েছিলাম৷ একটা দুটো কথাও বলতাম — কেমন আছ? সব ঠিক আছে তো? গোছের৷ কখনও উত্তর পাইনি৷ সত্যি বলতে কী, ওই একদিন, বারকয়েক উপযাচক হয়ে নিজের নির্দোষিতার কথা যে বলেছিল জবামাসি, সেদিন ছাড়া আমি জীবনে ওর গলা শুনিনি৷ একদিন বাড়িতে পড়ে থাকা একটা অব্যবহৃত সোলার ল্যাম্প দিয়েছিলাম৷ কী করে জ্বালাতে হয়, কী করে চার্জ দিতে হয়, বার বার বলে এসেছিলাম৷ তার পরে সপ্তাহ তিনেক যেদিনই ওই রাস্তায় ফিরেছি, দেখেছি ঝুপড়িতে আলো জ্বলছে৷ মনে মনে খুশি হতাম৷ কিন্তু তারপর একদিন আবার দেখি অন্ধকার৷ ভেতরে গিয়ে দেখি জবামাসি অন্ধকারেই শুয়ে রয়েছে৷ আলোটা নেই৷ অনেক জিজ্ঞেস করেও জানতে পারিনি কী পরিণতি হয়েছিল ওটার৷
*
মেডিক্যাল কলেজে পড়া শুরু করার পর থেকে আর ওদিকে যাওয়ার দরকার হত না৷ মাঝে মাঝে যেতাম, জবামাসিকে টাকা দিয়ে আসতাম৷ টাকা নিয়ে কী করত জানি না, তাও দিতাম৷ ততদিনে অমিতদাও চলে গেছে ইউএসএ৷ পুরোনো বন্ধুরাও হারিয়ে গেছে অনেকেই৷ থার্ড ইয়ার থেকে আমি হস্টেলবাসী; বাড়ি আসি সপ্তাহে একদিন, কখনও বা তা-ও না৷ একদিন সন্ধের পর গেলাম৷ তাজ্জব! বাঁশের সাঁকোটা আর নেই৷ নারকেলবাগানের জংলা ভাবটাও নেই আর৷ সুসজ্জিত বাগান, বসার বেঞ্চ, পায়ে-চলা পথ — আর রাস্তার দু-ধারে ঝকঝকে আলো৷ জবামাসির ঝুপড়িটাও নেই৷
বাড়ি ফিরে জানতে চাইলাম, “নারকেল বাগানের এমন উন্নতি কেন?”
মা বলল, “ওদিকে নতুন গাড়ির ব্রিজ হবে৷ গাড়িঘোড়া সব ওই রাস্তা দিয়েই যাবে৷ সব সাঁকো ভেঙে দিয়েছে৷ জায়গায় জায়গায় নতুন পায়ে চলা ব্রিজও হয়েছে৷ আমাদের সাঁকোটা আর নেই৷ কাজের লোকেরা এখন অনেকটা ঘুরে খাল পেরিয়ে আসে — আসতে দেরি হয়৷”
বললাম, “আর জবা… পাগলি? ওর ঝুপড়িটাও তো আর নেই?”
মা বলল, “হ্যাঁ৷ ওটাও ভেঙে দিয়েছে৷ ও-ও কোথায় চলে গেছে৷ আর আসে না এদিকে৷ অনেকদিন দেখিনি।”
*
বছর দুয়েক বাদে একদিন সন্ধেবেলা পেশেন্ট দেখে মেডিসিন ওয়ার্ড থেকে বেরোতে রাত হয়েছে, কল্যাণ আর আমি বেরোতে গিয়ে দেখি ওয়ার্ডের মেন গেটে তালা৷ এমন হলে পাশের সিঁড়ি দিয়ে নেমে নিচের দরজা দিয়ে বেরোতে হয়৷ জায়গাটা নোংরা৷ বহু বছর আগে কোন বিদেশি সংস্থা মেডিক্যাল কলেজকে বিরাট বিরাট চারটে অ্যাম্বুলেনস দিয়েছিল শহর থেকে দূরে, যেখানে ডাক্তার নেই সেখানে, হাসপাতালের এক্সটেনশন ক্লিনিক চালাতে৷ কোনও দিনই বোধহয় ব্যবহার হয়নি, পড়ে আছে হাসপাতাল-চত্বর জুড়ে — গায়ে বড়ো বড়ো করে ‘মেডিক্যাল কলেজ ভ্রাম্যমাণ ক্লিনিক’ লেখা নিয়ে৷ পড়ে থেকে থেকে টায়ারগুলো বসে গেছে, এখন আর চলবেও না৷ কল্যাণ ওগুলোর পাশ দিয়ে আবার সামনের দিকে যাচ্ছিল, আমি বললাম, “আবার অতটা হাঁটবি কেন? এগুলোর পেছন দিয়েই বেরিয়ে যাই, পুলিশ আউটপোস্টের সামনে দিয়ে…”
কল্যাণ বলতে গেছিল, ওদিকে নোংরা, কিন্তু ততক্ষণে আমি হাঁটা দিয়েছি, তাই বাধ্য হয়ে এল পেছন পেছন৷
দুটো অ্যাম্বুলেনসের মাঝখানে আধশোয়া চেহারাটা দেখে আমি থমকে দাঁড়িয়েছিলাম৷ পেছনে কল্যাণ পা-চালিয়ে আসছিল, ধাক্কা খেয়ে বিরক্তস্বরে বলল, “কী হল?”
উত্তর না দিয়ে আমি পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম৷ কাছে গিয়ে মোবাইলের টর্চ জ্বেলে বললাম, “কে?”
পেছনে কল্যাণের গলা পেলাম, “আরে এরকম কত আছে ক্যাম্পাসে এধার ওধার…”
আমি জবামাসির পাশে বসে পড়ে বললাম, “জবামাসি, তুমি এখানে কী করে এলে?”
উত্তর নেই৷ পেছনে কল্যাণের গলা, “তুই চিনিস? তোর কেউ হয়?”
জবামাসি নিরুত্তর দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে রয়েছে৷ আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, “ক্যান্টিন খোলা রয়েছে?”
কল্যাণ ঘড়ি দেখল৷ বলল, “না, চান্স নেই৷ খাবার কিনতে গেলে এখন অর্ক’স টিফিনে যেতে হবে৷”
আমি বললাম, “তুই হস্টেল যা৷ মেসে বলিস আমি আসছি৷ খাবারটা রাখে যেন৷ আমি চট করে অর্ক’স টিফিন হয়ে আসছি৷”
আমার হাবভাব দেখেই বোধহয় কল্যাণ আর কিছু বলল না৷ আমি একছুটে রাস্তা পেরিয়ে চারটে আটার রুটি আর তরকারি নিয়ে এসে জবামাসিকে দিয়ে হস্টেল ফিরলাম৷
*
তারপর আরও দুবছর কেটেছে৷ আমি, আর আমি না থাকলে কল্যাণ রোজ জবামাসিকে খাবার এনে দিয়েছি — কখনও অর্ক’স থেকে, কখনও কলেজ ক্যান্টিন থেকে৷ মাঝে মাঝে একটা শাড়িও দিয়েছি, মা-র পুরোনো শাড়ির ভাণ্ডার থেকে।
আমাদের হাউস-স্টাফশিপের আট মাস চলছে এখন৷ কিছুদিন পরে কলেজের সঙ্গে প্রায় সাত বছরের সম্পর্ক ঘুচে যাবে৷ কল্যাণ আর আমি আলোচনা করি, আর সাড়ে তিন মাস… তারপর যে যার করে খেতে হবে৷
বলি, “হুঁ৷ তোর তো চিন্তা নেই, বাড়ি গিয়ে বাবার নার্সিং হোমে জাঁকিয়ে বসবি।”
কল্যাণ বলে, “সে গুড়ে বালি৷ পোস্ট গ্র্যাজুয়েট না হলে নার্সিং হোমে ঢুকতে দেবে না বাবা৷ তুই কী করবি?”
“সবাই যা করে — চাকরির পরীক্ষা — ইউপিএসসি, স্টেট গভর্নমেন্ট, রেলওয়ে… যেখানে পাই…”
“জবামাসির কী করবি?”
ভেবে কূল পাইনি৷ জবামাসির বয়েস হয়নি বেশি৷ কিন্তু শরীরটা ভালো নয়, বুঝতে পারি৷ কত বছর কেবল রোদে জলে বাস, পথে পথে ঘোরা, আধপেটা খাওয়া, কতদিন কেবল উপোস, কে জানে৷ অনেকবার বলেছি, আউটডোরে চলো, ভালো করে চেকআপ করে ওষুধ দিই৷ যাওয়া দূরের কথা, উত্তরও দেয়নি কোনও দিন৷ আজকাল মাঝে মাঝে ভাবি, হয়ত কথা বলতেই ভুলে গেছে৷
বলি, “একটা কাজ করা যেতে পারে৷ অর্ক’স-এ বলে যেতে পারি, দুবেলা খাবার পাঠিয়ে দিতে…”
“দেবে?”
“দেবে না? অনলাইন পেমেন্ট করব তো?”
“অর্ক দেবে৷ কিন্তু যাকে দিয়ে পাঠাবে, সে আনবে, না মাঝপথেই ঝেড়ে দেবে?”
সেদিন অ্যাডমিশন ডে ছিল৷ সকালে দুজনে যাচ্ছিলাম এমারজেন্সির দিকে৷ অ্যাম্বুলেনসগুলো পেরোনোর সময় নিজে থেকেই দৃষ্টি গেল তিন আর চার নম্বরের অ্যাম্বুলেনসের ফাঁকে বসে থাকা মানুষটার দিকে৷
পরমুহূর্তেই, “শিট্,” বলে কল্যাণ দৌড়ে গেল, পেছনে আমি৷ জবামাসির পাশে উবু হয়ে বসে হাতটা ধরল নাড়ি দেখার জন্য, আমাকে বলল, “শিগগির এমারজেন্সি থেকে একটা গার্নি নিয়ে আয়৷ নিজেই আনবি, ওয়ার্ড বয়ের জন্য অপেক্ষা করিস না।”
চাকা লাগানো উঁচু পায়ার ওপর এই ধাতব স্ট্রেচারগুলো অ্যাম্বুলেনস থেকে রোগী হাসপাতালের ভেতরে নিয়ে যাবার জন্য তৈরি৷ মাটিতে শোয়া একটা মানুষকে তাতে তোলা কঠিন৷ আমি গার্নি নিয়ে ফিরে দেখি কল্যাণের চারপাশে ভিড় জমে গেছে৷ ফাঁড়ির পুলিশরাও ঘিরে দাঁড়িয়ে৷ আমাকে আসতে দেখে কল্যাণ সবার উদ্দেশ্যেই বলল, “একটু হেল্প করবেন?”
নিমেষে মজা দেখতে আসা ভিড়টা পাতলা হয়ে গেল৷ দুজন পুলিশ এগিয়ে এল৷ ওদের সাহায্যে জবামাসির অচৈতন্য দেহটা গার্নিতে শুইয়ে কল্যাণ বলল, “সিস্টারকে গিয়ে বল, বেড রেডি করতে৷ বেড খালি না থাকলে ফ্লোরেই…”
সিস্টারকে বলে ওয়ার্ড থেকে বেরিয়ে দেখি কল্যাণ এমারজেন্সি মেডিক্যাল অফিসারকে বলছে, “নাম লিখুন আন্নোন্৷ আমি এনাকে নিয়ে ভেতরে যাচ্ছি, টিকিটটা পাঠিয়ে দেবেন প্লিজ৷”
মেডিক্যাল অফিসার আমাদের চেয়ে অনেক সিনিয়র৷ চেয়ার ছেড়ে উঠে জবামাসিকে দেখে বললেন, “এ কী! এ তো বাইরে বসে থাকে ওই বেগার-টা৷ ওকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস? ও তো একঘণ্টার মধ্যেই যাবে মনে হচ্ছে৷”
এমারজেন্সি ওয়ার্ডের কল্যাপসিব্ল গেটের ভেতর দিয়ে ফিমেল ওয়ার্ডের দিকে গার্নিটা ঘোরাতে ঘোরাতে কল্যাণ বলল, “যাবে, কিন্তু হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে যাবে৷ এভরিবডি হ্যাজ দ্য রাইট টু ডাই অন আ ক্লিন বেড৷ বেসিক হিউম্যান রাইট, জানেন না?”
ড্রিপ চালিয়ে, পরীক্ষার জন্য রক্ত নিয়ে এসে ডক্টরস’ রুমে বসে বললাম, “নাম আন্নোন্ লেখালি?”
কল্যাণ বলল, “আন্নোন্-ই ভালো৷ নাম বললেই পদবি, অ্যাড্রেস, নেক্সট অফ কিন — এসব বলতে হত৷ তারপর সৎকার করত কে? তুই?”
উত্তর দিতে পারলাম না৷
সারা সকাল কল্যাণ আমাকে কোনও কাজ করতে দিল না৷ কাজের চাপও তেমন ছিল না যদিও৷ এমারজেন্সি মেডিক্যাল অফিসারের ভবিষ্যৎবাণী মিলল না৷ এক ঘণ্টা নয়, প্রায় তিন ঘণ্টা পরে নার্স ঘরে ঢুকে কল্যাণের দিকে তাকিয়ে খুব আস্তে মাথা নাড়লেন৷ এই মাথা নাড়া-টা আমরা চিনি৷ আমি চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে সবে বলতে শুরু করেছি, “কত নম্বর বেড, সিস্টার?” কল্যাণ আমাকে হাত নেড়ে বসতে বলল৷
“আমি যাচ্ছি৷ তোকে কোত্থাও যেতে হবে না৷ চুপ করে বসে থাক৷”
কল্যাণ জবামাসিকে মৃত ঘোষণা করে ফিরে আসার পরে আমি আস্তে আস্তে ফিমেল ওয়ার্ডের দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম৷ পর্দাঘেরা বেডের আশেপাশে নার্সদের ব্যস্ত আনাগোনা৷ ড্রিপ খোলা, অক্সিজেনের সিলিন্ডার বন্ধ করে নল খোলা। জবামাসি কথা বলত না৷ আর বলবেও না৷ আস্তে আস্তে ফিরলাম ডিউটি ডক্টরস’ রুমের দিকে৷ ডাক্তারের জীবনে মৃত্যুর অভাব নেই, কিন্তু সারাক্ষণ আমাদের নজর ফেরাতে হয় জীবনের দিকে৷
এমারজেন্সির গেটের কাছে ফাঁড়ির একজন পুলিশ দাঁড়িয়ে৷ আমাকে দেখে এগিয়ে এল৷ হাতে একটা ব্যাগ৷
“স্যার, ওই মেয়েলোকটাকে নিয়ে এলেন, এটা ওর৷ ওখানে পড়ে ছিল৷”
ব্যাগটা আমার হাতে দিয়ে লোকটা চলে গেল৷ আমি যন্ত্রচালিতের মতো ‘থ্যাঙ্ক ইউ’ বলে ঘরে ঢুকলাম৷ কল্যাণ নেই৷ এমারজেন্সি — ডাক্তাররা বসে থাকার সুযোগ কম পায়৷ টেবিলে ব্যাগটা রেখে খুললাম৷ কিছু প্লাস্টিকের ব্যাগ, তাতে কিছু খুচরো পয়সা, কয়েকটা টাকা, আর এই কিছুদিন আগে আমার দেওয়া শেষ শাড়িটা৷
কল্যাণ ঘরে ঢুকল৷ শাড়িটা দেখে বলল, “জবামাসির? ওহ, গুড৷ মর্গে যাবার আগে এটাই পরিয়ে দেওয়া হোক৷ পরণে যেটা আছে সেটার দিকে তো তাকানো যায় না৷ সিস্টার… সিস্টার… আয়াকে বলবেন, ওই আননোন পেশেন্টকে এই শাড়িটা পরিয়ে দিতে? আমরা আয়াকে টাকা দেব…”
আমি জবামাসির ব্যাগ থেকে টাকাপয়সাগুলো বের করে বললাম, “এগুলো দে৷ জবামাসির নিজের টাকাতেই জবামাসির শেষ দায় শোধ হোক৷”
এখন লিখতে বসে মনে হচ্ছে, মেডিক্যাল অফিসারকে বলা হয়নি — জবামাসি ভিখারি ছিল না। জীবনে কোনও দিন একমুঠো খাবারও কারও কাছে চায়নি।
অসাধারন…….আমি আপনার নিয়মিত পাঠক
আপনার ফোন নম্বর টা যদি একটু দিতে পারেন, তাহলে খুব উপকৃত হই।