এমসিডিএসএ-র জন্মলগ্নের কথা – ভারত ও বাংলার
সেসময়ের ভারত এবং বাংলার কথাকে পাশে রেখে বা বাদ দিয়ে কেন এমসিডিএস-এর মতো সমস্ত মেডিক্যাল কলেজে ডিএসএস বা অন্যান্য কলেজে ডিএসএ-র মতো প্রায়-সমধর্মী সংগঠন কলকাতা এবং শহরতলির কলেজগুলোতে তৈরি হয়েছিল, সে কথা বোঝা যাবে না। আজ যখন কেন্দ্রীয় স্তরে সমস্ত ধরনের সিলেবাস ক্রমাগত পুনর্গঠিত হচ্ছে, ‘নয়া শিক্ষানীতি’ চালু হচ্ছে, মেডিক্যাল শিক্ষাক্রমে NExT পরীক্ষা আসন্ন, মেডিক্যাল শিক্ষার অভিমুখ এবং অন্তর্বস্তুর খোলনলচে বদলে যাচ্ছে, তখন সেসময়ের সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ইতিহাসের কথা এমসিডিএসএ-র নতুন প্রজন্মের জানা নিতান্ত জরুরী বলে মনে করি।
১৯৭৪ সালের ৮ থেকে ২৭ মে – ২০ দিনের ১৭ লক্ষ রেলকর্মীর স্ট্রাইক – পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বড়ো ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্ট্রাইক হিসেবে গণ্য করা হয়। আমেরিকার বহুলপঠিত এবং বিখ্যাত Time ম্যাগাজিনে “Strangulating Strike” শিরোনামে (২০ মে, ১৯৭৪) প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। প্রতিবেদনটি জানিয়েছিল – “As in few other countries, railways in India provide the vital arteries of commerce, superseding airplanes, pipelines and highways. Masses of passengers stuffed into third-class coaches are as much a part of the Indian scene today as they were in Kipling’s raj. But even more than carrying people, India’s trains are necessary to keep the country’s economy moving. Nearly 70% of India’s food, fuel and freight are transported in 420,580 railway cars over the system’s 39,000 miles of tracks. Indian Railways is the fourth largest in the world and India’s largest single employer, with 1.4 million workers.”
ইকোনমিক অ্যান্ড পলিটিকাল উইকলি-র (EPW) মতো পত্রিকায় স্টিফেন শার্লক লিখেছিলেন রেলওয়ে স্ট্রিয়াক নিয়ে “Railway Workers and Their Unions: Origins of 1974 Indian Railways Strike” শীর্ষক প্রবন্ধ। এতে বললেন, একদিকে রাষ্ট্রের হিংস্রতম দমন-পীড়ন অন্যদিকে ভারত সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের অংশগ্রহণ না করে, এ দুয়ের সম্মিলিত অভিঘাতে এই স্ট্রাইক সফল হতে পারেনি – “the organisational and political weaknesses of the labour movement as a whole meant that the strike was not joined by other sections of the working class and its full potential was not realised.” হোস্টেলের দাবীতে ছাত্রদের অনশনের সময়ও তো আমরা এ সত্যি প্রত্যক্ষ করেছি। আমাদের ছাত্ররাও কি গেছে অন্যদের আন্দোলনে সংহতি জানাতে?
রেলওয়ে ধর্মঘটের আগে ১৯৭৩ সালে উত্তরপ্রদেশে প্রভিন্সিয়াল আর্মড কন্সটাবুলারি (PAC)-র সশস্ত্র অভ্যুত্থান হয়েছিল। সেও এক ঐতিহাসিক ঘটনা। এর সাথে তীব্র অভিঘাত সৃষ্টি করেছিল গান্ধীবাদী নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণের (১৯৭৬ থেকে) সর্বস্তরের মানুষকে নিয়ে স্বৈরাচারী কেন্দ্রীয় সরকার-বিরোধী “সম্পূর্ণ ক্রান্তি” আন্দোলন। তারও আগে ১৯৬৭ সালে নকশালবাড়ির অভ্যুত্থান ঘটে গিয়েছে পশ্চিমবাংলায়।
বাংলার তরুণ যুবসমাজ সহ বিভিন্ন স্তরের মানুষকে সামাজিক, বৌদ্ধিক এবং বাস্তবের অস্তিত্বের জগতে গোড়া ধরে নাড়িয়ে দিয়েছে নকশালবাড়ি এবং অন্যান্য আন্দোলনের সম্মিলিত অভিঘাত। শঙ্খ ঘোষের মতো কবি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর প্রিয় ছাত্র তিমির পুলিসের অত্যাচারে বীভৎসভাবে নিহত হলে লেখেন –
“ময়দান ভারি হয়ে নামে কুয়াশায়
দিগন্তের দিকে মিলিয়ে যায় রুটমার্চ
তার মাঝখানে পথে পড়ে আছে ও কি কৃষ্ণচূড়া?
নিচু হয়ে বসে হাতে তুলে নিই
তোমার ছিন্ন শির, তিমির।”
লেখেন –
“শরীরের মধ্যে কিছু একটা ঘটেছে ডাক্তার,
ঠিক জানিনা,
কীভাবে বলতে হয় তার নাম
আয়নার সামনে বসলে ভারী হয়ে নামে চোখ
পেশির মধ্যে ব্যথা
ভিতর থেকে ফুটে বেরোয় হলুদ রঙের আলো
কিন্তু সে তো গোধূলির আভা। রক্তে কি
গোধূলি দেখা যায়?
রক্তে কি গোধূলি দেখা যায়? যাওয়া ভালো?
শরীরের মধ্যে কিছু একটা ঘটে যাচ্ছে ডাক্তার,
জানিনা তার নাম।”
এরপরে রাজনৈতিক-সামাজিক পরিস্থিতিকে সামাল দিতে রাষ্ট্রের তরফে জারী করা জরুরী অবস্থা (Emergency) – ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত ২১ মাসের জন্য। সমস্ত স্বাধীন স্বর, সিস্টেমের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলা নিষিদ্ধ করা হয়। এমনকি কিশোরকুমারের গাওয়া কয়েকটি রবীন্দ্রসঙ্গীতও (এখনও কি হচ্ছে না?)।
১৯৭৭ সালে আসমুদ্র হিমাচলব্যাপী অবিস্মরণীয় গণ আন্দোলনের ঢেউয়ের চুড়োয় আসীন হয়ে অদম্য শক্তিতে (আমি সাংগঠনিক শক্তিকেও সম গুরুত্ব দিচ্ছি) যেদিন বামফ্রন্ট সরকার বাংলার ক্ষমতায় এল, সেসময় বামফ্রন্টের তরফে দুটি নিতান্ত গুরুত্বপূর্ণ গণ-ঘোষনা করা হয়েছিল – (১) রাজনৈতিক বন্দীদের নিঃশর্ত মুক্তি, এবং (২) পঞ্চায়েতি ব্যবস্থার সংস্কার করে ভূমিহীন ও দরিদ্র কৃষকদের পাট্টা দেওয়া এবং ‘অপারেশন বর্গা’। এর পরিণতিতে নিত্যনতুন রাষ্ট্রিক হিংসা ও হিংস্রতার কাহিনী দর্পণ এবং ফ্রন্টিয়ার-এর মতো পত্রিকায় প্রকাশিত হতে শুরু করে। কাশিপুর-বরানগরে দুপুর বেলায় ২০০-র বেশি কিশোর এবং যুবককে ঘর থেকে বের করে পুলিশ এবং পার্টি গুণ্ডাদের যৌথ আক্রমণে ‘ঐতিহাসিক গণহত্যা’র কাহিনী সামনে আসা আমার মতো আরও হাজারো তরুণকে বিদ্ধ, ক্রুদ্ধ এবং শপথে বলিয়ান করেছে। এপিডিআর সহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের ফ্যাক্তো ফাইন্ডিং টিম জেলের ভেতরে কিভাবে মেধাবি, উজ্জ্বল ছাত্র, কবি সাংস্কৃতিক কর্মীদের বীভৎসতম অত্যাচার করে হত্যা করেছে – এ খবরগুলো আমাদের কাছে এসে পৌঁছুতে থাকে। আমাদের ভেতরেই, অন্তত সাময়িকভাবে, এক নতুন মানুষের জন্ম হয়। রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশ তখন এর অনুকূলে ছিল।
মেডিক্যাল কলেজের সাথে জেএনইউ-র কিছু মিল আছে। মেধার জোরে কলেজে স্থান পাওয়া – তার সামাজিক অবস্থান যাই হোক না কেন – এবং এক দীর্ঘকালীন বন্ধুত্ব বা কমরেডশিপ গড়ে ওঠা। দু জায়াগাতেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ও অঞ্চলের ছাত্রছাত্রীর পড়তে আসা। আমাদের ১৯৭৫ সালে ভর্তি হওয়া ব্যাচে মরিশাস এবং কেনিয়ার বন্ধু ছিল, নেপালের রাজ পরিবারের দুজন ছিল, ছিল রোমানিয়ার রাষ্ট্রদূতের কন্যা – আমাদের সহপাঠী হিসেবে।
এবং যেসব দাদারা তখন কলেজের ফিফথ ইয়ারের ছাত্র এবং কলকাতার স্কুলগুলো ঠেকে পাস করা তারা চোখের সামনে তিমিরের মতো লাশ হয়ে যাবার ঘটনা আকছার দেখেছে। দেখেছে রাষ্ট্রের তরফে পুলিশ এবং রাজনৈতিক গুণ্ডাবাহিনীর হিংস্রতম আক্রমণ ও উল্লাস। এমসিডিএসএ তৈরির নেপথ্যে এ সমস্ত কারণ কাজ করেছে – রাজনৈতিক পার্টির dictate-এর বাইরে একটি স্বাধীন মত প্রকাশের সংগঠনের জন্ম দিতে হবে।
আমার নিজের কথা
ঠিক সাড়ে চার দশক আগে আগে – সালটা ১৯৭৭। তখনো তুমি হোস্টেলে যাওনি, জয়ন্ত। বালি থেকে শেয়ালদা কিংবা হাওড়া হয়ে মেডিক্যাল কলেজে রোজকার যাতায়াত। তখনো জরুরী অবস্থা ইমার্জেন্সি জারি রয়েছে – আর কদিন পরে ধসে পড়বে। হাওড়ায় ট্রেন ঢোকার মুখে অনেকগুলো দেওয়াল জুড়ে উজ্জ্বল হয়ে থাকা লেখা দেখতে – “ইন্দিরা ইজ ইন্ডিয়া”। দেখতে “এশিয়ার মুক্তিসূর্য ইন্দিরা গান্ধী জিন্দাবাদ”। তখন প্রবল প্রতাপশালী এক “গুরু”-র বাণীও দেখেছিলে – “জরুরী অবস্থা মানে অনুশাসন”। কোন এক ত্রিকালজ্ঞ ঋষির কথা ছিল সেটা, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ঘনিষ্ঠ। কিন্তু কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ থেকে ৪১০ কিলোমিটার দূরে রায়গঞ্জের বাড়িতে থাকতে দেখেছিলে – রেলওয়ে ধর্মঘটে অংশ নেবার জন্য চাকরি খোয়ানো মানুষকে। আর কে করঞ্জাই সম্পাদিত পত্রিকা Blitz-এ সেসব দিনের রক্ত উছলে ওঠা ঘটনার বর্ণনা পড়েছিলে একের পরে এক। হাওড়া স্টেশনের দেয়াল লিখন আর চিত্রের সাথে তোমার সেসময়ের অপাপবিদ্ধ অস্তিত্ব, মেধা, চিন্তন দিয়ে মেলাতে পারছিলে না পরস্পর বিরোধী ঘটনাক্রমকে।
শেয়ালদা থেকে কলেজে যাবার পথে আমহার্স্ট স্ট্রিটের মোড়ে এক দেয়ালে দেখলে লাল কালি দিয়ে লেখা গোটা দেয়াল জুড়ে – “আমাদের ৬,৫০০ কমরেডের ঘাতক কংগ্রেসকে একটিও ভোট নয়”। আবার কলেজ থেকে একটু এগিয়ে যখন প্রেসিডেন্সি কলেজে কিংবা কফি হাউসে যেতে তখনও দেখতে পেয়েছিলে বিবর্ণ হয়ে আসা, কিন্তু স্পষ্ট, দেয়াল লিখন – “চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান / চীনের পথ আমাদের পথ”। দেখেছিলে সেই উদ্দীপ্ত লাইনটি – “হাত দিয়ে বলো সূর্যের আলো রুধিতে পারে কি কেউ”। দেখেছিলে – “পার্লামেন্ট শুয়োরের খোঁয়াড়”। তোমার ভেতরে এক অন্য জগতের আলোর রশ্মিকণা প্রবেশ করতে শুরু করেছিল।
এর মধ্যে একদিন সকালের স্টেটসম্যান পত্রিকা থেকে হঠাৎ জানলে জরুরী অবস্থা উঠে গেছে। কলেজে নতুন দাদাদের মুখ দেখতে শুরু করলে। আগে যে দাদাদের দেখেছিলে তাদের থেকে এরা পৃথক – চলনে-বলনে, মেলামেশায়, চিন্তার প্রাখর্যে এবং প্রাচুর্যে। কলেজের সিঁড়িতে বসে কাঁধে হাত দিয়ে অন্যরকমের ঘটনা শোনায়। এরাই আগের ইউনিয়নের দাদাদের হাতে মার খেয়েছে, রক্তাক্ত হয়েছে। এমনকি আমাদের সিনিয়র দিদিরাও রেহাই পায়নি। বুকের ভেতরে জ্বলুনি শুরু হল। এক অব্যক্ত যন্ত্রণা, হয়তো বা ক্রোধও, জন্ম নিচ্ছিল ধীরে ধীরে।
এরপরে কলেজের নির্বাচন হল। প্রথবারের জন্য বাবা-মা-র অনুমতি না নিয়ে কলেজের নতুন এবং ঘনিষ্ঠ পরিচয়ের বৃত্তে থাকা দাদাদের অনুরোধে কলেজ ইলেকশনে প্রার্থী হওয়া। এবং বিপুল ভোটে জয়লাভ – বোধহয় কলেজে রাজনীতিতে আমার প্রথম মেন্টর স্বরূপদার (স্বরূপ সরকার) সঙ্গে রেকর্ড ভোট পেয়ে। সে বছর (১৯৭৭) মেডিক্যাল-এর পরীক্ষা অনিয়মিত হবার দরুন ৭টি ব্যাচ ছিল। ফলে ৩৫টি আসনে ছাত্র পরিষদের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছিল। দুটি সংগঠনের ভোট ব্যবধানের কোন তুলনা চলে না। দুকূলপ্লাবী বন্যার মতো ভোটের ব্যবধান প্রায় ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল ডিএসএ-কে।
কিন্তু এ জয় সেদিন সেরকম কোন ব্যক্তিগত আনন্দানুভূতি তৈরি করেনি। বরঞ্চ সমষ্টিগত এক চৈতন্যের উন্মেষ হল। সে চৈতন্য তোমার বন্ধুদের সাথে তোমাকে নিয়ে গেল সাঁওতালডিহি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ধর্মঘটী শ্রমিকদের পাশে সশরীরে হাজির থাকার অনির্বচনীয় অনুভূতিতে। তাদের সমর্থনে মঞ্চে প্রাণখুলে উদাত্ত স্বরে একের পরে এক গণসংগীত গাওয়া। এর আগে ক্যান্টিনে, কলেজের মধ্যে একফালি মাঠে, এমসিএইচ বিল্ডিং-এর চওড়া সিঁড়িতে বসে, ইউনিয়ন রুমে – সর্বত্র গণসংগীতের লহর তৈরি হচ্ছিল। ছড়িয়ে যাচ্ছিল কলেজে, বন্ধুদের মাঝে, কলকাতার বিভিন্ন অংশের জনজীবনের মাঝে। জীবনের এক নতুন অধ্যায় শুরু হল। গণসংগীত নিয়ে হাজির স্কটিশ চার্চ কলেজের ছাত্র আন্দোলনের পাশে। হাজির যাদবপুরের টিবি হাসপাতালের (এখন যেটা কেপিসি মেডিক্যাল কলেজ) আন্দোলনে সামিল টিবি রোগীদের পাশে।
সেসব মার খাওয়া দাদারা, আমিও যার একজন সাথী ছিলাম, মিলে গড়ে তুললো মেডিক্যাল কলেজ ডেমোক্র্যাটিক স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন (MCDSA)। সেদিন প্রথম জেনেছিলে তুমি তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের কাজাখিস্তাহের আলমা-আটা শহরে প্রাথমিক স্বাস্থ্য নিয়ে বিশ্বসম্মেলনের কথা। জেনেছিলে স্বাস্থ্যের সংজ্ঞা নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত হয়েছে। সেদিন সবাই মিলে শ্লোগান তুলেছিলে – “স্বাস্থ্য কোন ভিক্ষা নয়, স্বাস্থ্য আমার অধিকার”। তোমরা রাজপথে নেমে জানিয়েছিলে স্বাস্থ্যকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে, ব্যয়বরাদ্দ বাড়াতে হবে।
হোস্টেল জীবন তখনো সরাসরি শুরু না হলেও কলেজের সময়ের একটা বড়ো অংশ কাটতে লাগলো হোস্টেলে। সেসময়েই দুটি বই হাতে এল। জীবনের বাঁক বদল হবার এক চিরস্থায়ী অভিজ্ঞান হিসেবে চিহ্নিত হয়ে রইল আমার জীবনে। প্রথম বইটি সুপ্রকাশ রায়ের অতি পরিশ্রমসাধ্য গবেষণার ফসল “ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম”। দ্বিতীয়টি টেড অ্যালান এবং সিডনি গর্ডনের লেখা The Sclapel, The Sword: The Story of Doctor Norman Bethune। এরপরে জীবনের এতগুলো দশক, বছর, মাস, দিন পেরিয়ে অগুনতি বই পড়ার পড়েও এ দুটো বই এখনও চোখের সামনে ভাসে। মনে হয়, এইতো সেদিনের কথা। হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায়। সুপ্রকাশ রায়ের বইয়ের অধ্যায়গুলো নিয়ে একটি গীতিনাট্যও জন্ম নিয়েছিল সেদিন। দর্শকেরা দেখেছিল, শ্রোতারা শুনেছিল।
এরপরে পাকাপাকিভাবে শুরু হল হোস্টেল জীবন। বাবার পূর্ণ সঙ্গতি ছিল না হোস্টেলের খরচ চালানোর। সম্বল স্কলারশিপের টাকা আর টিউশন। সেসময়ের একজন আদর্শবান স্কুল শিক্ষকের মাইনে ভাবলে শিউরে উঠতে হয়। ১৯৭৭-এ বামফ্রন্ট সরকার আসার পরে বেতনক্রম নির্দিষ্ট হয়। মাইনেও একধাপে অনেকটা বেড়ে যায় – মধ্যবিত্ত জীবন যাপনের উপযোগী।
হোস্টেল মানে পূর্ণ অর্থে একজন সাবালক, স্ব-নির্ভর, স্ব-চিন্তার যুবক হয়ে ওঠা। বন্ধুদের নিয়ে, বন্ধুদের সাথে বেঁচে থাকা। যেকোন প্রয়োজনে বন্ধুরা আছে। সবাই মিলে একসাথে বস্তিতে যায় স্বাস্থ্য শিবির করতে। রাতে ফিরে এসে সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউয়ের মুসলিম হোটেলে দুটাকার মধ্যে মাংসের সুস্বাদু ভুনিয়া এবং পরোটা দিয়ে পেট ভরায়। হোস্টেলেই প্রথম সিগারেট খেতে শেখা। সিগারেটের “কাউন্টার”-এর অর্থ খুঁজে পাওয়া। বিড়ির মাঝে যে এত স্বাদ লুকিয়ে আছে তা হোস্টেল ছাড়া আর কে জানাতো? মদ গাঁজা? না, তখন ওসবের একেবারেই চল ছিলনা এক বিশেষ ধরনের চিন্তায় বিশ্বাসী ছেলেমেয়েদের মাঝে। কেউ কেউ হয়তো খেত। তবে সেটা আড়ালে।
সিনেমায় যেমন কখনো বর্তমান, কখনো অতীতের স্বচ্ছন্দ সাবলীল যাতায়াত হয়। আমাদের জীবনও তো এর বাইরে নয়। ৪৫ বছর আগের স্মৃতি তুলে পরতে পরতে দেখতে গেলে এরকম যাত্রা হওয়াই স্বাভাবিক। একটু পেছনে ফিরে যাই আবার। ভিন্ন প্রেক্ষিত তখন রচনা হচ্ছে।
সেটা হাজরা পার্কের কোন এক দুপুরের কথা। বন্দীমুক্তির দাবীতে সুরেশ বিশ্বাস “শত শহীদের রক্তে রাঙ্গা পতাকা” গাইছেন উন্মুক্ত কণ্ঠে, ট্রাম লাইনের আওয়াজকে অতিক্রম করে। সাথে গলা মেলাচ্ছে কৈশোর-যৌবনের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে থাকা একটি ছেলে – জয়ন্ত। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সাথে পরিচিত হবার আগে জয়ন্ত পড়েছে তাঁর কলমে জন্ম নেওয়া গায়ে কাঁটা দেওয়া সেই কবিতার লাইনগুলো –
পিচ্ছিল নেপথ্যে আজও রয়েছে মানুষ –একা – নরক দর্শন করে
তবু অন্ধ নয়, খোঁড়া নয়;
রক্ত মাংস কর্দমের পাহাড় ডিঙ্গিয়ে, নদী সাঁতরিয়ে
নরক উত্তীর্ণ হতে ক্লান্তিহীন যাত্রা তার;
মাথা উঁচু রাখাই নিয়ম।
কলেজ স্কোয়ারে খাটো ঝুলের পাজামা আর কোঁচকানো ধূসর পাঞ্জাবী পরা লম্বাটে, রোগাটে কালোর দিকে ঘেঁষা গায়ের রঙের একজন মানুষ তুমি গান করে নেমে আসার পরে বললেন – “বেশ গেয়েছেন ভাই! খোলা উদাত্ত গলা।” ভেতরে কি এক অনুভূতি তখন! জেনে গেলাম এই প্রায়-তাচ্ছিল্য করার মতো ভদ্রলোকের নাম বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। সমস্ত শরীর জুড়ে যে অত্যাশ্চর্য, দ্রিদিম দ্রিদিম অনুভূতির নীল সাগরের মতো ঢেউ খেলে গিয়েছিলো সে মুহূর্তে তাকে কি আবেগ বলে? কোন শব্দে ধরার মতো অবস্থায় ছিলে না তুমি, জয়ন্ত। তোমার সামনে ঢেউয়ের চূড়ায় চূড়ায় আলোর মতো জেগে উঠছে তাঁরই কবিতাখণ্ড।
আমার সন্তান যাক প্রত্যহ নরকে
ছিঁড়ুক সর্বাঙ্গ তার ভাড়াটে জল্লাদ,
উপড়ে নিক চক্ষু, জিহ্বা দিবা-দ্বিপ্রহরে
নিশাচর শ্বাপদেরা; করুক আহ্লাদ
তার ছিন্ন ভিন্ন হাত-পা নিয়ে
শকুনেরা। কতটুকু আসে যায় তাতে
আমার; যে আমি করি প্রত্যহ প্রার্থনা,
“তোমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে।”
মণীভূষণ ভট্টাচার্য পাথরে পাথরে, শরীরের শোণিতে-শিরাতে দেশলাই কাঠি জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন। কি অত্যাশ্চর্য সব ছবি। জীবনের ছবি, কাদার ছবি, মৃত্যুর ছবি। আবার শেষ অব্দি resurrection-এর ছবি –
“অধ্যাপক বলেছিলো। ‘দ্যাট’স র-ঙ্, আইন কেন তুলে নেবে হাতে?’
মাস্টারের কাশি ওঠে, ‘কোথায় বিপ্লব, শুধু মরে গেল অসংখ্য হাভাতে!’
উকিল সতর্ক হয়, ‘বিস্কুট নিইনি, শুধু চায়ের দামটা রাখো লিখে।’
চটকলের ছকুমিঞা, ‘এবার প্যাঁদাবে শালা হারামি ও.সি-কে।’
উনুন জ্বলে নি আর, বেড়ার ধারেই সেই ডানপিটে তেজী রক্তধারা,
গোধূলি গগনে মেঘে ঢেকেছিলো তারা।”
জয়ন্ত, তোমাকে উথাল-পাথাল করে দিচ্ছিলো, ছিঁড়েখুঁড়ে টুকরো হয়ে যাচ্ছিলে যখন পড়েছিলে এই পঙক্তিটি –
“অন্ধকার বিছানা থেকে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে এসে আলোর বালতি
উল্টে দেবে স্বাধীন শিশু। প্রথমেই ঘুম ভাঙ্গবে মা’র, তারপর
গভীর নিরাপদে একে একে জেগে উঠবে পড়শীরা, বারান্দা থেকে
উঠোনে গড়িয়ে-পড়া সোনালী স্রোতের মধ্যে আদুল গায়ে
দুরন্তপনা করবে – সে-ও হয়তো এমনি এক রবিবার।”
শুধু কবিতা পাঠ বা গান করাতে আটকে রইলোনা জীবন। জীবনের ধারাপথ বদলে দিলো, জয়ন্ত তোমার। কলেজ-হোস্টেলের জীবনে চলে আসি আবার। এবার মন দিয়ে পড়লাম বেথুনের জীবনকাহিনী। অত্যাশ্চর্য অভিজ্ঞতা হল। চীনে কমরেডরা তাঁকে আদর করে পাই চু এন বলে ডাকতো। এমন আদর পেতে কে না চায়? আমারও মনের মাঝে আকুলি-বিকুলি শুরু হল। জানলাম এক স্ব-জাত উদ্ভাবনী প্রতিভা বাসা বেঁধেছিল বেথুনের মাঝে।
চিকিৎসাবিজ্ঞানের জগতে তখনো দুরারোগ্য টিবির চিকিৎসায় নতুন ধরণের সার্জারির উদ্ভাবন করলেন। যে সমস্ত পুস্তক-কেন্দ্রিক সার্জনরা বইয়ের বাইরে যায়না, নতুন পথে রোগীর চিকিৎসা করতে অপারগ তাদের জন্য বললেন – “The surgeon who can’t see the hints and answers the nature and the world thrust into his face should be digging ditches, not massacring the human body.” তাঁর তত্ত্বাবধানে ৭৩টি thoracoplasty (যে অপারেশনে রোগীর ফুসফুসের সার্জারি করা হত টিবি সারানোর জন্য) সহ ৩০০-র ওপরে বড়ো ও ছোট সার্জারি করা হয়েছিল এক বছরে। তাঁর গবেষণাপত্র Canadian Medical Association Journal এবং Journal of Thoracic Surgery-র মতো মান্য জার্নালে ছাপা হয়েছে। চীনে যাবার আগে স্পেনের রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। চীনে গিয়ে যুদ্ধের ফ্রন্ট লাইনে blood transfusion-এর ব্যবস্থা করলেন। তাঁর যাপ্য মন্ত্র ছিল – every leader starts by first leading himself. যুদ্ধক্ষেত্রে দিনে ২০টির বেশি অপারেশন করেছেন বেথুন। চীনের মুক্তিসংগ্রামে সবচেয়ে কার্যকরী অষ্টম রুট বাহিনীর তরফে তাঁর মাসোহারা যখন ১০০ ডলার দেবার প্রস্তাব দেওয়া হয় তখন তিনি সটান প্রত্যাখ্যান করেন সে প্রস্তাব। তখন একজন কমান্ডার পেতেন মাসে ৮ ডলার, একজন সৈনিক মাসে ১ ডলার। তিনি নিজেকে একজন সাধারণ সৈনিক হিসেবে গণ্য করে মাসে ১ ডলার মাসোহারা নিতে সম্মত হন। তাঁর এক ভাষণে তিনি যা বলেছিলেন সেটা হুবহু তুলে দিচ্ছি। অনুবাদ করলে এর ওজস্বিতা ভেঙ্গে যাবে।
আমরা খেয়াল করবো কাদের উনি ধন্যবাদ দিলেন। কোন নেতা বা বীরকে নয়, যারা প্রতিদিন জীবন উৎসর্গ করে চলেছেন সেসব অনামা, ইতিহাসের প্রান্তবাসীদের। বেথুন আগুন জ্বালিয়ে দিলেন আমার শরীরের সমস্ত কোষে। একদিকে মেধাবী ছাত্র হিসেবে আমার গবেষণার আকাঙ্খা, আরেকদিকে মানুষের মুক্তির লড়াইয়ে সামিল হবার সুতীব্র আবেগ – এ দুয়ের মেলবন্ধন ঘটালেন তিনি।
সেরকম সময়ে খোলা চোখে দেখতে পেলাম, চোখের সামনেই দৃশ্যমান হল, মেডিক্যাল কলেজের যে দাদাদের একটি অবিভাজ্য সত্তা হিসেবে মনে করতাম তারা আসলে অনেকগুলো সত্তা। তাদের অনেক রাজনৈতিক বিভাজন। কেউ চারু মজুমদারকে নাকচ করছে সরাসরি, দায়ী করছে সত্তরের দশকের সমস্ত বিপর্যয়ের একমাত্র evil spirit হিসেবে। কেউ চারু-লিন পিয়াও পন্থী, কেঊ চারু-লিন বিরোধী অবস্থানে। কেউ মাঝামাঝি এক রাস্তায় হাঁটছে, কেউ কেবলমাত্র গণআন্দোলনের কথা বলছে। কেউ বলছে গ্রামে চলো, কারো মুখে ডাক্তারি শিখে বৈপ্লবিক চিকিৎসাব্যবস্থার কথা। কিন্তু সত্তরের দশকের জ্বলন্ত (গলন্তও বটে) প্রশ্নগুলোর সরাসরি কোন উত্তর পাচ্ছিনা। অনীক পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত চিন চিং মাই-এর উপন্যাস (যৌথ উপন্যাসও) “বিপ্লবের গান” অন্তরের জ্বালামুখ খুলে দিচ্ছে।
কোথায় যাবো আমি? আমি কে? কিভাবে যাপিত হবে আমার জীবন?
এখানেই আপাতত সমাপ্ত হল আমার এমসিডিএসএ-কে নিয়ে পথ চলার কাহিনী। এমসিডিএস-এর সাথে আমার পথচলায় সাময়িক যতি পড়লেও এ সংগঠন নিজের পথ ধরে এগিয়েছে। ২০১৮ সালে হোস্টেলের সিটের ক্ষেত্রে স্বচ্ছ কাউন্সেলিং-এর দাবীতে একাধিক ছাত্রের আমৃত্যু অনশনের আন্দোলন নির্দয় কর্তৃপক্ষকে বাধ্য করেছে ছাত্রদের দাবী মেনে নিতে। এমসিডিএসএ বেঁচে আছে জীবন্তভাবে, জীবনীশক্তি নিয়ে ৪৬ বছর পরেও – জীয়নকাঠি যে ছাত্রদের হাতে!
পরে খুব ভাল লাগলো। কেঊ তো চেস্টা করেছে।
সুন্দর বক্তব্য।
Jayanta , i am really overwhelmed . Fantastic writing . Will never forget those burning days . Salute to your determination and ideas . Stay always blessed 🙌 ❤️🌹👍
Loved this sir
যথার্থ বিশ্লেষণ
এক অনন্য জীবন কথা।
Khub valo laglo pore. Ato detail information gulo tor lekhatei paoya jay.