মানে, ওই কী যেন বলে.. ‘যোদ্ধা-টোদ্ধা’ সেসব তখন অনেকেই বলে দিয়েছেন। খুব জরুরি কাজে কাউকে টুক করে ফোন সেরে নিতে গেলেও তার আগে সাড়ে বাহাত্তর রকমের হ্যাজ- ‘এই যুদ্ধে যাঁরা আমাদের ঢাল’ ইত্যাদি ইত্যাদি। সব মিলিয়ে পুরো মাখোমাখো পরিবেশ..
বেশ কিছুদিন আগের এমত কোনও এক রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিনে রণদুন্দুভি ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে রণসাজ নিলাম। মাথায় ক্যাপ, মুখে মাস্ক (জোগান নিয়ে প্রশ্ন তোলা বারণ), হাতে জোড়া গ্লাভস আর সর্বাঙ্গ ঢাকা চিড়বিড়ে পোষাক পরে নিতেই তৎক্ষণাৎ হিটলারের কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্প চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল। ও হ্যাঁ, বলতে ভুলে গেছিলাম.. মাইনাস তিন চশমার ওপর গগলস জোড়া পরে ফেলতেই বেশ একটা বাষ্প বাষ্প প্রেশার কুকার ফিলিং!! তাও বেশ শিহরণ জাগছিল। জগৎ ও জীবনের উদ্ধারকার্যে ব্রতী হওয়া কি মুখের কথা নাকি? গগলস-সুদ্ধ ‘খসন্ত’ চশমা সামলাতে সামলাতে কয়েকবার নীতিবাক্য-টাক্য আউড়ে নিলাম। তারপর সোজ্জা কাঁধ ঝাঁকিয়ে কাজে নেমে গেলাম..
চেয়ারে বসে সবে গোটা দুয়েক পেশেন্টের কাগজপত্র দেখা হয়েছে কি হয়নি, হঠাৎ দেখি কাগজের ওপর টপটপিয়ে বৃষ্টির জল এসে পড়লো!! অবাক হয়ে ছাদের দিকে তাকালাম.. ছাদ ফুটো নাকি? সেই বাষ্পাচ্ছন্ন চোখে তখন ছাদ তো দূরের কথা, দু-তিন ফুট দূরের জিনিসপত্রও ভালো করে দেখা যায় না। এদিকে আবার বৃষ্টির ফোঁটা!! এবার পাতার অর্ধেক ভিজে গেল। চেয়ার সরিয়ে বসলাম। কী অদ্ভুত!! ওপরে আরও দুটো ফ্লোর চুঁইয়ে বৃষ্টির জল এসে খাতাপত্র ভিজিয়ে যাচ্ছে!! সে যাত্রা অনেক ভাবনাচিন্তার পর বুঝতে পেরেছিলাম এ বৃষ্টি সে বৃষ্টি নয়, এ বৃষ্টি স্বেদবৃষ্টি!! বস্তুত, স্বেদনপ্রবাহ যে এরকম রূপ নিতে পারে তা এই ক্ষুদ্র মনুষ্য-মস্তিষ্কের ধারণার বাইরে ছিল।
তারপর.. সে বিচিত্র রঙ্গমঞ্চের এমাথা থেকে ওমাথা জ্বরজ্বালা-শ্বাসকষ্ট-কোভিড-চ্যালেঞ্জ খারাপ-স্লাইন-ইঞ্জিশন-গ্যাস-বিলাড টেস-কী খাবাব-স্নান-ডেইলি নোটস-অ্যাডভাইস..
চরকিবাজির মতো ঘুরতে ঘুরতে ঘড়ির কাঁটা কখন সাড়ে চারটে ছুঁয়েছে খেয়াল করিনি। রীতিমতো কুকুরের মতো ফ্যা ফ্যা করে হাঁফাচ্ছি! অবশেষে দিনের কাজ শেষ করে পিপিই খুলছি.. ঘেমেনেয়ে একসা। গ্লাভস খোলার পর হাতের চামড়া কোঁচকানো কাগজের মতো! যুদ্ধক্লান্ত সৈনিক খেতে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। তবু তখনও কোনও দুঃখ নেই। বরং, বেশ একখানা ‘রক্তমাখা, কপাল কাটা, মাথায় ফেট্টি’ সৈনিক-সৈনিক হাবভাব নিয়ে স্নানঘরে ঢুকলাম। গায়ের দিকে তাকাতেই চমকে উঠলাম! গোটা গায়ে লাল হয়ে র্যাশ বেরিয়েছে!
খেতে বসলাম। প্রথমেই ঢকঢক করে লিটার খানেক জল। ভাত শুকিয়ে কাঠ। খানিক খুঁটে খেয়ে উঠে পড়লাম। ততক্ষণে গায়ের র্যাশগুলো চুলকোতে শুরু করে করেছে। এতক্ষণ কুকুরের মতো হাঁফাচ্ছিলাম, এবার বাঁদরের মতো চুলকোতে শুরু করলাম। কয়েক ঘন্টার মধ্যেই গাল তুবড়েছে, চোখ কোটরে ঢুকে এসেছে। ডিহাইড্রেটেড শরীর তখন জল.. আরও জল চায়..
তারপর আরও বেশ কিছুদিন কেটে গেছে। রাতে অনকল রুমে শুয়ে ঘুম আসে না। একদিকে র্যাশের চুলকুনি অন্যদিকে “মশা তার অন্ধকার সংঘারামে জেগে থেকে জীবনের স্রোত ভালোবাসে।” চোখ একটু জুড়ে এলেই অগুনতি মশার কামড়। তার মধ্যেই পেশেন্ট দেখার ডাক আসে। আমি যন্ত্রচালিতের মতো মাস্কে মুখ ঢাকি, চশমা গলিয়ে নিই। তারপর রক্তবর্ণ চোখে খোঁজ নিই.. কে হিসি করে নি, কার বুকে আটুপাটু, কার জ্বর এলো..
বাইরে ভোরের আলো ফোটে। ভোরের আলো ফুটলে মশার কামড় খানিক কমে আসে। আমি উদভ্রান্তের মতো বিছানায় এলিয়ে পড়ি।
না। এ শুধু আমার গল্প নয়। এ গল্প আমার মতো যে কোনও স্বাস্থ্য-শ্রমিকের, স্বাস্থ্যকর্মীর। যাক গে, গল্পের শেষটুকুও শুনে ফেলা যাক.. শেষ অংশটা আমার পুরোনো হাসপাতালের এক চিকিৎসকের অভিজ্ঞতা। (ভদ্রলোক নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) পুরোনো হাসপাতালটি এখন কোভিড-হাসপাতাল। স্বাস্থ্যকর্মীরা বাড়িঘর ছেড়ে হাসপাতালের ক্যাম্পাসের মধ্যেই দিনের পর দিন পড়ে থাকছেন। সেদিন বিকেলবেলা কিছু বিশেষ কাজে ডাক্তারবাবু হাসপাতালের বাইরে যাচ্ছিলেন। গেটের সামনে যেতেই বেশ কিছু লোক (শারীরিক বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী সম্ভবত মনুষ্য-প্রজাতিই) লাঠি-কাটারি-রামদা নিয়ে তাড়া করে। শুরু হয় অকথ্য গালিগালাজ আর ইঁটবৃষ্টি। অপরাধ? ডাক্তারবাবু বাইরে গেলে এলাকায় রোগ ছড়াবে। কী অকাট্য যুক্তি! তাই না?
দিনের পর দিন মাস্ক ছাড়া জমায়েত, পুচ পুচ করে পানের পিক ফেলা, অপগন্ড ধর্মগুরুদের করোনা সারানোর নিদান.. ইত্যাদি সব মিলিয়ে যখন পৃথিবী ‘নিত্য প্রেমের বৃন্দাবন’ হয়েই উঠেছে তখন করোনা ছড়ানোর অপরাধে দু-এক পিস স্বাস্থ্যকর্মী পেটালে কিংবা পাড়ায় ঢুকতে না দিলে অথবা ধরুন ‘উমুক করোনা আক্রান্ত’ বলে কুৎসিত মিম বানালে কার কীই বা যায় আসে? পড়ে-পাওয়া চোদ্দ আনা ছুটি আর গুলতানির অখণ্ড অবসরে এসব পার্টটাইম মজাটজা না হ’লে চলে নাকি?
অস্পৃশ্য স্বাস্থ্যকর্মীদের পথ চেয়ে বসে থাকা বাড়ির লোকেরা আতঙ্কে দিন গোনেন। রাতে ফোন আসে.. ‘বাবা, কবে আসবে?’, ‘কবে বাড়ি ফিরবি মা?’, ‘তুমি তো বাড়ির কথা ভুলেই গেলে..’
জবাবগুলো প্রায় একইরকম হয়। ‘এই তো আর ক’টা দিন গেলেই..’
‘ক’টা দিন’ দীর্ঘায়িত হয়। শেষ বিকেলের রাঙা আলোর তলায় ‘করোনা-যোদ্ধা’রা ‘করোনা-অপরাধী’ হয়ে যান।
তারপর রাত নামে। দীর্ঘ, কালো রাত..
চোখে জল আসে ।
রাগ হয়, ঘেন্না করে…| তারপরেও রাত গিয়ে সকাল হয় | ভরসা মরতে মরতেও মরে না….
এই লেখাটি সবার পড়া উচিৎ। আমরা ক্রমশঃ অনুভূতি হীন হয়ে পরছি। স্মার্টফোন হাতে শুধুই পেছনে হাঁটছি।