উফ, এই নুন-মরিচ মাথার তুর্কি ক্রাশের সর্বজনীন পিরীতি-বাঁশের ঠেলায় ফেসবুক উজাড় হয়ে গেল দেখছি!
না, আমি এঁর কেয়ারলেস পৌরুষে উদ্বেল হইনি মোটেও। দুনিয়ার যত ‘ছোটখাটো, সাদামাটা হরিপদ’রা আমার ক্রাশ এখন।
তবে হ্যাঁ, চিরকাল এমনটি ছিল না।
‘ক্রাশ’ কী, বোঝার বয়স হওয়ারও আগে আমি প্রথম অনুরক্ত হয়ে পড়েছিলাম একজনের নয়, একসঙ্গে দু’-দু’জনের প্রতি। যতটা ভয়াবহ ভাবছেন, ততটা ভয়ের ছিল না ব্যাপারটা। তাঁরা হলেন গুগাবাবা। অর্থাৎ তপেন চট্টো ও রবি ঘোষ মশায়।
আমি যাঁদের নেমসেক (১৯৬৯তে জন্ম আমার, তাই বাবা নাম রেখেছিল গুগাবাবা — পরে, বাবা-টা বাদ যায় আর মুড়োটুকু পড়ে থাকে। সেই উচ্চারণ ভয়াবহ বটে), তাঁদের প্রতি ভক্তি হওয়াটা শিশুকালে তত আশ্চর্যের কিছু ছিল না।
বয়স কিঞ্চিৎ বাড়ার ফলে জ্ঞানগম্যিও বাড়ল, ক্রাশ কথার অর্থ নিষিদ্ধভাবে বোধগম্য হলো আর সেই কচি কলাপাতা কৈশোরে আমি প্রথম লাট্টু হলাম
সানি গাভাসকরকে দেখে। মানে, ছবি দেখে আর কি!
তারপর বাবার মিলের লাইব্রেরির স্পোর্টস ম্যাগাজিনের ছবি কেটে রাখা, আনন্দমেলা, খবরের কাগজ ইত্যাদি থেকে আরো আরো ছবি সংগ্রহ, মোটা অ্যালবাম তৈরি করে তার পাতায় পাতায় সেসব ছবি সাঁটা (সেন্টারস্প্রেড হলে তো কথাই নেই), বাবার কাছ থেকে কোনো জন্মদিনে ‘সানি ডেজ’, তো পরের জন্মদিনে ‘আইডলস’ গিফট পেয়ে রেস্তোরাঁতেই সর্বসমক্ষে আনন্দে উদ্বাহ হয়ে নৃত্য — এইসবই আমার জীবনের প্রথম সিরিয়াস ক্রাশ খাওয়ার নির্ভুল আলেখ্য হয়ে রয়ে যাবে স্মৃতির পাতায়।
সানি ক্রেজ নিয়ে সবচাইতে লজ্জাকর অভিজ্ঞতা হয়েছিল স্কুলে। তখন আমি নাইন। বেস্ট ফ্রেন্ড নন্দিনীর সঙ্গে স্কুল লাইব্রেরিতে বসে বসে গল্প করছি, ক্লাস টিচার মিস দেবযানী লাহিড়ি এগিয়ে এসে জানতে চাইলেন, লাইব্রেরিতে বই পড়ার বদলে কী নিয়ে আড্ডা মারছি দুই বন্ধুতে? দেবযানী মিসের সঙ্গে আমাদের বয়সের বিশাল তফাৎ ছিল না। তিনিও খুবই বন্ধুসুলভ ব্যবহার করতেন তাঁর ছাত্রীদের সঙ্গে।
নন্দিনী তাই অত্যন্ত সপ্রতিভভাবে জবাব দিল — “Miss, she was discussing her love story with me. She’s in love with Sunil Gavaskar”.
আমি অধোবদন। কান দিয়ে হলকা বেরোনো বন্ধ হলে শুনতে পেলাম, একটুও না হেসে, খুব মনোযোগ সহকারে মিস দেবযানী লাহিড়ি আমা হেন দুগ্ধপোষ্য adolescentকে love আর infatuation এর পার্থক্য বোঝাচ্ছেন!
নন্দিনীর সঙ্গে টানা সাতদিন কথা বলিনি এর পরে।
বয়স আমার ফোড়ার মতো আরো খানিক পেকে ওঠার পরে, মন সরে এলো ক্রিকেট মাঠ থেকে। তখন সেলুলয়েডের পর্দার নায়কের উপর ক্রাশ খাওয়ার দিন এসে গেল।
প্রথম ক্রাশ (নো প্রাইজ ফর গেসিং) উত্তমকুমার।কিছুদিন পরে দেখলাম, মা-ও একই রকম মুগ্ধতা শেয়ার করছে ঐ লোকটির প্রতি। তারপর দেখি মাসিরা, তুতো দিদিরা, পাড়ার কাকিমারা, মায় স্কুলের মিসেরাও সমান উত্তমভক্ত। রণছোড়দাস চানচোড়ের মতো নিজেকে বুঝিয়ে ফেললাম — ‘ইঁহা বহুৎ কমপিটিশন হ্যায় বস্!’
তারপরেই পাল্টি খেলাম। মানে কলকাতা ছেড়ে বম্বে চলে গেলাম, আর কি!
ক্রাশ হয়ে গেলেন রাজ কাপুর, শাম্মী কাপুর এবং গুরু দত্ত!
আজো মনে পড়ে, ম্যাজেস্টিক হলে ‘মেরা নাম জোকার’ দেখতে গিয়েছি হোস্টেলাইট বন্ধুরা মিলে — অ্যাডভান্স টিকিটের বালাই নেই, ব্ল্যাকই ভরসা!
পাঁচ কা দশ শুনে বন্ধুনীরা পিছু হটলো। এদিকে ছবি শুরু হয়ে গিয়েছে — পাঁচ মিনিট, দশ মিনিট —
বন্ধুনীদের ধারণা, আরো একটু পরে দর আরো একটু নামবে। এদিকে ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে চলেছে দেখে আমার দু’চোখ ভর্তি জল। সেই দেখে সোমা দাঁত কিড়মিড় করে বলল — “হ্যাঁ, মুখটা আরো খানিকটা কাঁদো কাঁদো করে ফ্যাল, তাই দেখে ব্ল্যাকারগুলো এবার পাঁচেরটা পনের চাইবে — কুড়িও চাইতে পারে”!
কলেজ জীবনের শেষ ক্রাশ এক ফুটবলার। অবশ্যই বিদেশি। কী ভাবছেন? প্লাতিনি? জিকো? কিংবা নিদেনপক্ষে পাওলো রোসি? নাহ্! তাহলে আর আমি আউট অফ দ্য ক্রাউড হলাম কোথায়? সকলে যখন মারাদোনা আর ম্যাথিউসকে নিয়ে মত্ত, আমি ঝাঁ করে ফ্যান হয়ে গেলাম নেদারল্যাণ্ডের রুদ গুলিটের।
এখন আর তার মুখটাও মনে পড়ে না, শুধু বিনুনিকরা মাথা আর উজ্জ্বল কমলা রঙের জার্সিটাই মনের ক্যানভাসে আঁকা রয়ে গিয়েছে।
আজ আমার আর সেলেব্রিটির উপর ক্রাশ খাওয়ার বয়স/মন কোনোটাই নেই।
শার্লক হোমস, ঋজু বোস, রাজা রায়চৌধুরী, এলিজাবেথ বেনেট — এঁরাই হলেন আমার চিরন্তন ক্রাশ। হ্যাঁ, হারমিওনি গ্র্যাঞ্জারও।
আর তুর্কির কথা যদি বলেন, তাহলে বছর দুই আগে ইউটিউবে দেখা এক তুর্কি টিভি সিরিজের কথা বলব — দ্য ম্যাগনিফিসেন্ট সেঞ্চুরি।
তুর্কি সম্রাট সুলেমান দ্য ম্যাগনিফিসেন্টের জীবন অবলম্বনে ১৩৯ পর্বের এক দীর্ঘ সিরিজ। তাতে ইব্রাহিম পাশার চরিত্রের অভিনয়কারী ওকান ইয়ালাবিককে দেখেছিলাম। দেখে বেশ কিছুদিন ঘোরের মধ্যে ছিলাম। তবে কিনা, লোকটা আদতে টেকো। পরে ছবিতে দেখে ক্রাশ ফুসসস্ করে নিবে গিয়েছিল, বালি ভরা জালি রংমশালের মতো।এতসব ক্রাশতামামির পরে শেষমেশ ফের ফিরে আসি — আমার সকল ঘরোয়া কাজের কাজি পার্বতীদি, মাছওয়ালা সনৎ, সবজিওয়ালা আনোয়ার, মুদিখানার সঞ্জয় আর গাড়িচালক বিশ্বজিতের দুনিয়ায়। ফিরে আসি আমার সহকর্মী হালদার স্যার আর পুত্রসম রমেশ, গোপাল, নীলাদ্রি, কন্যাসম প্রিয়া, সুপ্রিয়া, রুমিদের পৃথিবীতে। যাদের বাদ দিয়ে আমি সত্যি সত্যিই চোখে অন্ধকার দেখব, বেরং হয়ে যাবে জগৎটা, বাঁশি সুর ভুলবে, কলম ভুলবে আখরমালা।
ক্রাশ পর্বের এখানেই ইতি টানি।
এতসব গুহ্য ইতিবৃত্ত ফাঁস করার পরে আঙুল নিশপিশ করছে — নিজেরই গালে ঠাস করে ঠাটিয়ে একটা থাবড়া মারার জন্য।
বন্ধুগণ, ইই গেজেলার! (শিখে নিন, তুর্কিতে গুডনাইট — ঐ ইউসুফ ডিকেচকে বলতে সুবিধা হবে 😁)