দ্বিতীয় পর্ব
(এই পর্বের সব লেখাই আমার চঞ্চলাকে লেখা চিঠির অংশবিশেষ, আজকের সংযোজন বন্ধনীর মধ্যে।)
২৯/১০/৮১
রাজহরা থেকে মাইল দশেক দূরে দানীটোলায় যে রুগীকে নিয়োগীর সাথে দেখতে গিয়েছিলাম তার জন্য খুব একটা কিছু করতে পারব বলে মনে হয় না।
রুগী একজন শ্রমিক—মজবুত জোয়ান, সেলুনে চুল কাটার পর নাপিতকে দিয়ে ঘাড় ম্যাসেজ করাচ্ছিল। বেকায়দায় ঘাড় ঘোরাতেই চার হাত পা প্যারালিসিস। পেচ্ছাপ পায়খানার কন্ট্রোল নেই। Quadriplegia—spinal cord injury. রায়পুরে অনেক খুঁজে Holter Traction এর মত একটা traction লাগিয়েছি, জানি না কি হবে।
(দানীটোলায় ছিল কোয়ার্জাইট মাইন্স। এখানেই নিয়োগী ১৯৭৭-এর আগে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। এখানেই ওনার আশার সাথে পরিচয় এবং পরে বিয়ে হয়।।
১৯৭৭-এ দল্লী রাজহরার শ্রমিকেরা মজুরী বৃদ্ধির দাবীতে আন্দোলন শুরু করে। প্রচলিত ট্রেড ইউনিয়নগুলোকে শ্রমিকরা প্রত্যাখান করে।
দানীটোলায় এসে ওরা নিয়োগীকে অনুরোধ করে এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে। এই অঞ্চলে নিয়োগী সৎ militant শ্রমিক নেতা হিসেবে নাম করে ফেলেছিলেন।
নিয়োগী দল্লী রাজহরায় আসেন এবং এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। মাঝরাতে পুলিশ এসে নিয়োগীকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। কিন্তু হাজার হাজার মানুষ কিছু পুলিশকে ঘিরে রাখে। আরো ফৌজ আসে এবং গুলি চালায়। বালক সুদামা সহ এগারোজন গুলিতে মারা যান। শেষপর্যন্ত আন্দোলনে শ্রমিকরা জয়ী হন।
১৯৮৩-তে নিয়োগীজির নির্দেশে আমি আর শৈবাল হাওড়ার গ্লোব নার্সারী থেকে এগারোটা বকুল গাছ নিয়ে যাই। সেগুলো হাসপাতালের সামনের বাগানে শহীদ স্মৃতি হিসেবে রোপন করা হয়। আজ গাছগুলো বড় হয়ে গেছে।)
৯/১০/৮১
ইউনিয়ন অফিসে একলা বসে আছি, বিনায়কদা আর পবিত্র নিয়োগী এবং অন্যদের সাথে ভিলাই গেছে। পবিত্র এখন এখানে কিছুদিন থাকবে। সন্ধ্যেবেলা ওরা ফিরে আসবে। যদি কোন রুগী এসে ফিরে যায় সেই জন্য বসে আছি। এই মাত্র একটা বাচ্চাকে দেখলাম যার কোন রোগ নির্ধারণ করতে পারিনি। তাই কোন ওষুধ দিইনি। সন্ধ্যেবেলা আবার দেখতে হবে।
গত চার পাঁচদিন পকেটে পনেরো পয়সা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। পঞ্চাশ টাকা ধার করেছিলাম। তার মধ্যে পঁয়তাল্লিশ টাকা বিভিন্ন কাজে (ওষুধ ইত্যাদি) সেইদিনই খরচ হয়ে গেছে। বিল ইউনিয়নে জমা দিয়েছি। সম্ভবত আজ সন্ধ্যেবেলা টাকাটা পেয়ে যাবো। প্রাতরাশ, টিফিন, চা বিনায়কদা খাওয়াচ্ছে। দুপুর-রাতের খাবার ইউনিয়ন অফিসে। আর বিড়ি ও খাওয়াচ্ছে। পরিস্থিতিটা একটু বিরক্তিকর।
এছাড়া এখন এখানে মিটিং করা, ঘুরে বেড়ানো ছাড়া কাজ নেই। মানে রুগী দেখার ব্যবস্থা কিছুই হয়নি। কখনো এক-আধটা রুগী দেখছি। এই অবস্থাটা আরো মাস তিনেক চলবে বলে মনে হয়। পরের মাস থেকে ইউনিয়ন যদি কিছু পয়সা কড়ি দিতে শুরু করে তাহলে সেটাও অস্বস্তিকর। এইরকম কাজ করে পয়সা নেওয়ার কোন মানেই হয়না, অথচ পয়সা দরকার। তাই ভাবছি পার্টটাইম কোন কাজ যদি কিছুদিনের জন্য পাওয়া যায়। অবশ্য ওই ধরনের কাজ এখানে পাওয়াটা খুবই মুস্কিল। বিনায়কদা অবশ্য খুবই আপত্তি করছে। বলছে এখানে প্রচুর কাজ শুরু হয়ে যাবে কিছু দিনের মধ্যে এবং ইউনিয়ন পরের মাস থেকে পয়সা দেবে বলছে। এখন শুধু টাকা পয়সার জন্য অন্য কোন কাজ না করাই উচিত। আমি অবশ্য খুবই চাইছি। দেখি যদি কিছু পাওয়া যায় তাহলে করব, অবশ্য কোন আশা দেখছি না।
২১/১০/৮১
বিনায়কদা একজন রুগীকে নিয়ে গতকাল ভিলাই গেছে। আমি সকাল বেলা একজন রুগীকে দেখে কাপড়চোপড় কেচে চান করেছি সাড়ে দশটা নাগাদ আবার যাব।
হেলথ কমিটির কাজ এখন খুব ধীর গতিতে চলছে। দীপাবলি আগামী বুধবার। তখন পর্যন্ত ওইরকমই চলবে। বিনায়কদা এই মাসটার বাকী দিনগুলো বাইরেই থাকবে—বম্বেতে কোন কাজ আছে, পরের মাসের প্রথমে আসবে।
এখানে একটু একটু ঠান্ডা পড়েছে। রাতে লেপ ঢাকা দিয়ে শুতে বেশ আরাম লাগে। কিন্তু মানসিক অস্থিরতা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে আমি এখন না এসে আরো কিছুদিন পরে আসলেই ভাল হতো, রুগী দেখার যে কাজ তা বিনায়কদার একলার পক্ষেই যথেষ্ট ছিল। আর বাকি যে কাজটা সাংগঠনিক তার প্রকৃতিটাই হচ্ছে নিজ উদ্যোগে করার, এর জন্য বাড়তি পয়সা নেওয়াটা বিচ্ছিরি। আরো মনে হচ্ছে কিছু দিন অন্য কোথাও চাকরী করে কিছু টাকা জমিয়ে এখানে আসলে ভাল হত। আবার মনে হচ্ছে সার্জারীতে আরো পারদর্শী (বিশেষজ্ঞ) হয়ে আসলে ভাল হত।
Hierarchy জিনিষটা এত অপছন্দ করি—চারপাশে শুধু hierarchy আর bureaucracy দেখি। এগুলো সবই বিক্ষিপ্ত চিন্তা—কাউকে বলার মত নয়। বুঝতে পারছি লেগে পড়ে থেকে কাজ করাটাই গুরুত্বপুর্ণ।
চুয়াল্লিশ টাকাটা উনিশ তারিখেই পেয়ে গেছি। বিনায়কদা বলেছে যতদিন এখান থেকে টাকা না পাচ্ছি, ততদিন বিনায়কদার কাছ থেকে টাকা নিতে।
২৯/১০/৮১
খেতে গেছিলাম। লোডশেডিং হয়ে গেল। ফেরার সময় অন্ধকারে সাইকেল নিয়ে আছাড় খেলাম, কিছু ছড়ে-টরে গেল, কাল থেকে টর্চ নিয়ে বেরোব।
আজ দুপুরে আমি আর পবিত্র শান্তি বাইয়ের বাড়ীতে খেতে গেছিলাম, দেওয়ালি পরব উপলক্ষ্যে। লুচি, মাছের ঝোল, ডালের বড়া, চাল গুঁড়োর বড়া, আলুর বড়া, আরো অনেক কিছু। তারপরে ভাত এসেছিল। খেতে পারিনি। ওরা আমাদের খাওয়া দেখে হাঁসে। ওরা খাদানে কাজ করে তো তাই প্রচুর খেতে হয়।
এখানে মেয়েরা অন্য সব জায়গার আদিবাসীদের মতই কয়েকটা দিক থেকে অনেকটা স্বাধীন। বিয়ের আগে সন্তান হওয়াটা মেনে নেওয়া হয়। বিয়ের পর সেই সন্তান মায়ের সাথে চলে যেতে পারে অথবা দাদু দিদার সাথে থেকে যেতে পারে। বিয়েতে মেয়েকে পণ দিতে হয় না। ছেলেকে দিতে হয় (bridal price)। বিয়ে সব মেয়েই চায় কারণ বিয়েটা মেয়েদেরকে সম্মানিত করে। বিয়ের পর ভালো না লাগলে কোন কোন মেয়ে বাপের বাড়ী ফিরে যায়। যদি ছেলেকে বিয়ের পণ ফেরত দিতে পারে, তাহলে আবার বিয়ে করতে পারে। ফেরত দিতে না পারলেও অন্য ছেলের সাথে চলে যেতে পারে—বিয়ে করে নয়, ‘কেপ্ট’ হিসেবে, তবে ‘কেপ্ট’ ব্যাপারটা এখানে অসন্মানের কিছু নয়, সামজিক ভাবে স্বীকৃত।
অন্যদিকে ছেলেরা একই সাথে একাধিক বিয়ে করতে পারে। একসাথে পাঁচজন বউ আছে এরকম লোকও এখানে আছে। এতে আর্থিক সমস্যা নেই, কারণ প্রত্যেকেই কাজ করে।
এই সামাজিক অবস্থাটা দল্লী রাজহরায় কিছুটা পাল্টেছে। কারণ ১) বাইরের লোকজন (non-adivasis) এই ব্যবস্থাকে নিজেদের মত করে exploit করার চেষ্টা করে। ২) সামাজিক বিধি নিয়মের কিছু মিশ্রণ এখানে ঘটেছে। ৩) ইউনিয়ন এই রীতি কিছুটা পাল্টেছে।
নিয়োগীর মতে ১) ইউনিয়নের কাজকর্মের খুব অসুবিধে হয়। ছেলে আরেকবার বিয়ে করলে অথবা বৌ চলে গেলে এই সমস্যা নিয়েই দিন কেটে যায় ২) ছেলে মেয়েদের দেখাশোনার খুব অযত্ন হয়।
বিয়ে হয়নি অথচ একসাথে আছে এরকম অনেকেই আছে। তবে একটা ছেলের সাথে একাধিক বৌ এই সংখ্যাটা অনেক কম। অগ্রণী শ্রমিকরা এই জিনিষগুলো অপছন্দও করছে।
শান্তিবাইয়ের কাছে শুনছিলাম এখনও গ্রামের দিকে জুয়া খেলে—কখনও বা বউকে বাজি রেখে। দেওয়ালীর দিন জুয়া খেলাটা বহুদিনের প্রথা। এতে নাকি ভাগ্য নির্ধারণ হয়। ইউনিয়ন রাজহরায় এটা বন্ধ করেছে। তবে এখনও কিছু লোক লুকিয়ে খেলে।
ইউনিয়নের প্রভাবে বেশ্যাবৃত্তি অনেক কম হয়ে গেছে, তবে বেশ্যাবৃত্তিটা আমাদের ওখানকার মত অসন্মানজনক নয়।
সীমিত পরিবারের চেষ্টা খুব একটা করা হয় বলে মনে হয় না, তাই মেয়েদের খাদানে কাজ করার সাথে সন্তানের জন্ম, প্রতিপালন, রান্না বান্না ঘর সংসারের কাজ—অনেক পরিশ্রম করতে হয়। অবশ্য রান্নার পদ্ধতি খুবই সাধারণ আর কম সময় সাপেক্ষ।
এখানকার সমস্ত আন্দোলনেই মহিলারা militant role নিয়ে এসেছে—অনেক ক্ষেত্রে ছেলেদের থেকেও বেশী। তবে মহিলা মুক্তি মোর্চার কাজকর্ম খুব একটা চোখে পড়ে না। নিয়োগীর কথায় সাতাত্তর সাল থেকেই মহিলাদের নিজস্ব আন্দোলনের কথা উনি ভেবেছেন। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত মহিলাদের মধ্যে থেকেই একটা nucleus গড়ে উঠেছে ততক্ষণ পর্যন্ত ইউনিয়নের পক্ষ থেকে মহিলা মুক্তি মোর্চার কাজকর্ম গড়ে তোলা সম্ভব নয়। উনি মনে করেন, মহিলা সংগঠনে ছেলেদের participation-এ male bias এবং male domination-এর জন্ম হয়। মধ্যে দুএকবার বম্বে দিল্লী থেকে কিছু মহিলা কমরেড এসেছিলেন। তাঁদের প্রেরণায় এখানকার মহিলারা অনেকখানি উদ্বুদ্ধ হয়। এখনও মহিলাদের মধ্যে কোন nucleus গড়ে ওঠেনি। নিয়োগী গতকাল বলছিলেন, একজন মহিলা কমরেড যদি বাইরে থেকে এসে এখানে থাকেন তাহলে এই nucleus গড়ে উঠতে পারে।
৩১/১০/৮১
আজ সকাল থেকেই মনটা ভাল নেই। বিনায়কদা এখনও ফেরেনি। আজ সারাদিন ইউনিয়ন অফিসে ছিলাম।
রোজ ইউনিয়ন অফিসে যাচ্ছি। মাঝে মাঝে এক-আধজন রুগী আসছে। ডাক্তার আছে তাই একটু দেখিয়ে যাচ্ছে। দেওয়ালীর জন্য অনেক লোকজন নেই। সোমবারের আগে স্বাস্থ্য কমিটির কোন লোকজনকেই পাওয়া যাবে না।
হয়ত সোমবারের পর থেকে মনটা একটু ভাল থাকবে।
আজ পবিত্রর কাছ থেকে কুড়ি টাকা ধার করলাম, টাকা পেলে শোধ করে দেব।
(এই সময় আমাদের কাজ ছিল শ্রমিকদের সাথে স্বাস্থ্য আন্দোলন নিয়ে কথা বলা। আমরা বিভিন্ন মুহল্লায় গিয়ে মিটিং করতাম। আলোচনার বিষয় অনেক—টোটকা চিকিৎসা, জরিবুটি, ধুলো ঝাড়া, অবৈজ্ঞানিক চিকিৎসা, হাতুড়ে চিকিৎসা সম্পর্কে সবাইকে অবহিত করা। এটাও আলোচনা হত—ভিলাই হাসপাতালে, সরকারী হাসপাতালে গরীব কৃষক মজদুরের প্রতি কি অমানবিক ব্যবহার হয়, শ্রমিকদের নিজেদের তৈরী হাসপাতাল কেমন হবে, ইত্যাদি।
সমস্যা একটা ছিল। যেহেতু আমরা রুগী দেখতাম ন্ তাই অনেকেই আমাদের ঠিক ডাক্তার বলে ভাবতো না আর আমাদের খুব একটা গুরুত্ব দিত না।
তবে লাভও হয়েছে, এই সভাগুলো থেকেই আমরা স্বাস্থ্য কর্মীদের বেছে নিয়ে শিক্ষা দিতে থাকি। এই স্বাস্থ্য কর্মীরা আজও চল্লিশ বছর পরও হাসপাতালের সাথে কাজ করে যাচ্ছে।)
৭/১১/৮১
তুই কবে আসতে পারবি? ১৯শে ডিসেম্বর এখানে বীর নারায়ণ সিং* দিবস পালন করা হবে। ওই সময় এখানে প্রচুর লোকজন আসবে বাইরে থেকে। ২৬ শে নভেম্বর বিনায়কদা কলকাতা যাবে, ৭ই ডিসেম্বর পবিত্রও বাড়ি যাবে।
(* বীর নারায়ণ সিং-এর কথা ১৯৮১ এর আগে বেশীর ভাগ লোকই জানতো না –ছত্তিশগড়েও। নিয়োগী ইতিহাসের পাতা থেকে এমন একজন চরিত্র খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন, যিনি এই অঞ্চলের আদর্শ হয়ে উঠতে পারেন, এইভাবেই উনি বীর নারায়ণ সিং-কে আবিষ্কার করেন। নিয়োগী সোনাখান, বিলাসপুরে নারায়ণ সিং-এর পৈত্রিক বাড়ীতে যান, নারায়ণ সিং-এর বংশধরদের কাছ থেকে কিছু পুঁথি এবং একটা তলোয়ার খুঁজে বার করেন।
নারায়ণ সিং ১৮৫৭-এ ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামেন। তাঁকে বলা হয় ছত্তিশগড়ের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামী।
১৮৫৭ সালে তাঁকে রায়পুরে জয়স্তম্ভ চৌকে ফাঁসী দেওয়া হয়।
১৯ ডিসেম্বর ১৯৮১ প্রথম নারায়ণ সিং দিবস পালন করা হয়, ছত্তিশগড় মাইন্স শ্রমিক সংঘের উদ্যোগে।
এখন তো সরকারী উদ্যোগেও ঐদিন নানা অনুষ্ঠান হয়।)
(চলবে)
Darun lagche se sob diner katha jante.