ভিজিটিং আওয়ার্সের শেষে ওয়ার্ডে গিয়ে চোখে পড়লো যথারীতি যা হয়, আমাদের গ্রামের দিকে। বেশ কিছু লোক তখনো দিব্যি দাঁড়িয়ে, বসে গল্প করে যাচ্ছে নিজেদের মধ্যে, রুগীর সাথে। মেল ওয়ার্ডে মহিলা, ফিমেল ওয়ার্ডে পুরুষ। সবাইকে বকে ঝকে ভাগানোর পরে চোখে পড়লো মেল ওয়ার্ডে একটি বেডে একজন তরুণ রুগী। আর তার বিছানায় বসে দিব্যি পা দোলাচ্ছে সালোয়ার কামিজ পরা একটি তরুণী। একটু কড়া করে বকে দিলাম। “যাও, কাল আবার আসবে।” মেয়েটি কি বলতে গিয়েও কথাটা গিলে ফেলে মাথা নিচু করে চলে গেল।
সিস্টারের কাছে ফিরে আসার পরে শুনলাম একটা গল্প। গল্প ঠিক নয়। সত্যি ঘটনা। ছেলেটি বা মেয়েটি দু দিন আগেও কেউ কাউকে চিনতো না। মেয়েটি দীঘা বেড়াতে এসেছে তার পরিবারের সাথে, আর ছেলেটি তার কলেজের বন্ধুদের সাথে। হঠাৎ ঢেউ-এর আঘাতে মেয়েটি জলে তলিয়ে যাচ্ছিল। তখন এই ছেলেটি ঝাঁপিয়ে পরে তাকে বাঁচায়। গোলমালটা হল যে আমাদের হিরোবাবু সাঁতার জানতেন না। তাই জল টল নাকে মুখে, বুকে পেটে ঢুকে বাবুরাম আমাদের হাসপাতালে ভর্তি।
এরপরে নানাবিধ আসুরিক প্রক্রিয়ায় আমার অসুর থুড়ি ডাক্তার বন্ধুরা তার জীবনটা বাঁচিয়েছে। ছেলেটি ভর্তি হওয়া থেকে মেয়েটি সবসময়ই ওর কাছাকাছি আছে। শুধু রাত্রে খেতে শুতে হোটেলে ওর পরিবারের কাছে যায়। সেই যুগলকে আলাদা করে দেওয়ার অপরাধে আমাকে ওই সিস্টারের কাছ থেকেও কিঞ্চিৎ বকুনি শুনতে হল। হাসপাতাল ভিজিট সেরে গাড়িতে ওঠার আগে সামনের বিশাল সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম, অঞ্জন চৌধুরী বা সুখেন দাসের হাতে পড়লে এই গল্পটা কি ভাবে শেষ হত।
বড় অদ্ভুত এই হাসপাতাল। এককালের হস্পিস আর পান্থশালার মধ্যে খুব একটা তফাৎ ছিল না। এখনও নেই। এই পান্থশালার চার দেওয়ালের মধ্যে কত কি দেখে ফেললাম। জীবন, মৃত্যু, শোক, দুঃখ, সাহস, ভয়। কত কি। এমন কি প্রেম ভালোবাসাও।
গল্পের শেষ নেই। এই গল্পটার শেষটাও জানা নেই। আমি চাইবো আমার সরকারি গাড়িটা হাসপাতালের গেট পেরিয়ে গেলে ওই মেয়েটি আবার এসে বসুক তার আগের জায়গায়। ঠিক আগের মতোই ছেলেটির সাথে চলতে শুরু করুক তার অন্তহীন আলাপ।