আজকের দিনটা বেশ ঘটনাবহুল। একটুর জন্য কোয়ারাণ্টাইনে যেতে যেতে বেঁচে গেলাম। গতকাল সকালে একজন পরিচিত ফোন করেছিলেন, মধ্যমগ্রামেরই এক অতি পরিচিত অসুস্থ মানুষকে দেখার জন্য।
আমি তখন সোদপুরের এক চেম্বারে। বললাম, বেলা দুটোর পর বাড়িতে নিয়ে আসুন। দেখে দেব।
বিকেলে আবার ওই পরিচিত জনের ফোন পেলাম। ডাক্তারবাবু, আমরা আর আসছি না। ওনার শারীরিক অবস্থা আরও খারাপ হওয়ার জন্য হসপিটালাইজড করতে হয়েছে।
আজ বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে দেখলাম, তাঁর করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পরেছে। তাঁর সংস্পর্শে আসার জন্য অনেককেই কোয়ারান্টাইনে যেতে হয়েছে। উনি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠুন।
যুদ্ধের শুরুতেই যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরে যেতে মোটেই ভালো লাগত না। একজন সৈনিক আমাদের থেকে ভাগ্যবান। তিনি আহত হলেও যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারেন। কিন্তু আরেকটু হলেই আমাকে সুস্থ দেহেই লড়াইয়ের ময়দান ছাড়তে হত।
আমরা যারা প্রাইভেট প্রাক্টিশনার লকডাউনের দিনগুলিতে জ্বর ও অন্যান্য এমারজেন্সি রোগী দেখে চলেছি, তাঁদের অবস্থা সবচেয়ে করুন। করোনায় মৃত্যু হলে সম্ভবত আমাদের পরিবার চিকিৎসকদের জন্য নির্ধারিত ৫০ লাখ টাকার বিমা পাবে না। অভিজ্ঞ ডাক্তারবাবুরা এই বিষয়ে একটু আলোকপাত করলে ভালো হয়।
সবচেয়ে বিচ্ছিরি অবস্থা হচ্ছে হাত পেতে রোগীদের কাছ থেকে ভিজিট নেওয়ার সময়। রোগী দেখার সময় কায়দা করে তার পেশা জানার চেষ্টা করছি। একটা আশ্চর্য বিষয় অনেক দরিদ্র মানুষ এই সময়েও জোর করে ভিজিটের কিছুটা অন্তত দিতে চাইছেন। বলছেন, ভিজিট না দিলে জ্বর সারবে না।
আরও সমস্যা হচ্ছে কয়েকটি এমারজেন্সি রোগীর ক্ষেত্রে। একটি কমবয়সী ছেলের মাস দেড়েক ধরে জ্বর আর কাশি। গত একসপ্তাহ ধরে শ্বাস কষ্ট হচ্ছে। সপ্তাহখানেক আগে আমার কাছে এনেছিল। স্টেথো বসিয়ে ডানদিকের বুকে কোন আওয়াজই পেলাম না। এক্সরে করে আসতে বললাম। এক্সরেতে ডানদিকে ম্যাসিভ প্লুরাল ইফিউশান। সম্ভবত টিবি। কোথাও ভর্তি করে বুকের জল বের করে পরীক্ষা করা দরকার।
ছেলেটি সোনার কারিগর। আমাদের পাড়ার আশপাশের অনেক মানূষই সোনার কাজ করেন। কিন্ত সোনার মতো মূল্যবান ধাতুর কাজ করলেও তাঁদের আর্থিক অবস্থা খুব ভালো নয়। অগত্যা ভর্তি হতে হলে সরকারি হাসপাতালই ভরসা।
টোটো ভাড়া করে ছেলেটি দু’দিন পনেরো কিলোমিটার দূরের একটি সরকারি মেডিকেল কলেজ থেকে ঘুরে এসেছে। ভর্তি হতে পারেনি। এমনকি বক্ষ বিভাগে দেখাতেও পারেনি। এই সব রোগী নিয়ে কি করব জানিনা। প্রাইভেট ল্যাবরেটরি গুলোতে রুটিন কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা ছাড়া বাদবাকি সব পরীক্ষা নিরীক্ষা বন্ধ। বুকের জল বের করে দিলেও কোথাও পরীক্ষা করতে পারবে কিনা জানিনা। কালকে আবার ছেলেটি ঐ মেডিকেল কলেজেই যাবে। দেখা যাক।
অন্যান্য মেডিকেল এমারজেন্সিও থেমে নেই। আজই একজন হার্ট এটাকের রোগী পেলাম। তখনও গোল্ডেন আওয়ারের মধ্যে আছে। বাড়ির লোককে বললাম এখুনি হাসপিটালাইজড করা দরকার। এ্যাম্বুলেন্স জোগাড় করা গেল না। একটা গাড়ি জোগাড় করতেই অনেকটা মূল্যবান সময় নষ্ট হল। ঐ সময়টুকু প্রথমিক ওষুধপত্র দিয়ে দূরু দুরু বুকে অপেক্ষা করলাম।
আরও একটা সমস্যায় পড়েছি। দয়া করে সমস্যাটি নিয়ে হাসাহাসি করবেন না। গত কয়েক বছর ধরে আমার একটা বিচ্ছিরি নেশা হয়ে গেছে। প্রায় সর্বক্ষণ আমি চা খেতে খেতে রোগী দেখি। চা না পেলে ঘন্টাখানেকের বেশি রোগী দেখা আমার কাছে অসম্ভব হয়ে ওঠে। করোনার মরসুমে মাস্ক পরে রোগী দেখছি। যার ফলে প্রতি ঘন্টায় চা কি করে খাব বুঝে উঠতে পারছি না। একঘন্টা অন্তর অন্তর সব ছেড়ে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে চা পান করা সম্ভব নয়। কেউ যদি এই সমস্যার একটা সমাধান করে দিতে পারেন চির কৃতজ্ঞ থাকব।
আজ আমার স্ত্রীর জন্মদিন ছিল। তিন কন্যা বিকাল বেলায় বাড়ির ছাদে ছাই বৃষ্টি দেখে উত্তেজিত হয়েছিল। তাদের দাবীতে কেক কাটা হল। বড় কেক পাওয়া যায়নি। মুদির দোকানে দশটাকার বেশি দামের কেক নেই। তাই আনা হল গোটা কয়েক। এই দমবন্ধ করা পরিস্থিতির মধ্যেও কিছু সময়ের জন্য বাঁচতে ভালো লাগল।
রাত্রে আমি, স্ত্রী আর মেয়েরা মিলে মোমবাতি জ্বালালাম। অন্যরাও জ্বালিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রী, করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমরা আপনাদের সাথে আছি। আপনারা যা বলবেন আমরা তাতেই রাজি। আপনারা শুধু আমাদের অস্ত্র দিন। কমপয়সায় পরীক্ষার ব্যবস্থা করে দিন। যাতে জ্বর আসলেই প্রত্যেকটি রোগী সাথে সাথে পরীক্ষা করতে পারে। প্রতিটি কোভিড-১৯ কেস যাতে প্রথম অবস্থাতেই রোগ ছড়ানোর আগে ধরা পরে। আর পারলে প্রত্যেকটি স্বাস্থ্য কর্মীর জন্য উপযুক্ত পিপিই এর ব্যবস্থা করুন। সরবরাহের ব্যবস্থা থাকলে আমরা অনেকেই পয়সা খরচ করে কিনতে রাজি আছি।
আজই এনআরএস হাসপাতালে এক করোনা রোগীর মৃত্যুর পরে কয়েকজন, চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীকে কোয়ারন্টাইনে পাঠানো হয়েছে। এমনিতেই আমাদের চিকিৎসক, নার্সের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। উপযুক্ত পিপিই থাকলে তাঁরা আজ লড়াইয়ের ময়দানে থাকতে পারতেন।