“জল, নল, কল”- চিকিৎসা শিখেছিলাম ইন্টার্নশিপের প্রথম দিনই। সিনিয়র হাউস স্টাফ দাদা বলেছিল, ‘খারাপ বা অজ্ঞান রোগী ভর্তি হলেই ঝাঁপিয়ে পড়বি। আগে জল, নল, কল করে দিবি।’
ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘জল, নল, কল? সেটা আবার কি চিকিৎসা?’
দাদা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল। তারপর বলল, ‘ছ্যা, ছ্যা। পাঁচ বছর ধরে তাহলে কি পড়াশুনো করলি? জল মানে স্যালাইন চালানো। নল হলো নাক দিয়ে রাইলস টিউব ঢুকিয়ে খাওয়ার ব্যবস্থা করা। আর কল হলো ক্যাথেটার পরিয়ে পেচ্ছাপ করানো। আর ওর সাথে নাকে অক্সিজেনের নলটাও গুঁজে দিস।’
সংকোচের সাথে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘রোগীর কি হয়েছে না জেনে কি স্যালাইন চালানো উচিৎ হবে?’
দাদা বিচ্ছিরি রকমের হেসে বলল, ‘ঐন্দ্রিল, রোগীর আত্মীয় বলে একটি বস্তু আছে। তাঁরা যখন পেটাতে আসবেন, তখন উচিৎ, অনুচিতের ধার ধারবেন না। মনে রাখবি, স্যালাইনটা তুই আসলে তাঁদের চালাচ্ছিস। অক্সিজেনটাও তাঁদের দিচ্ছিস।’
সেই প্রথম দিনই দুটো জিনিস বুঝেছিলাম। প্রথমতঃ দুই রকমের চিকিৎসা হয়। রোগীকে বাঁচানোর চিকিৎসা এবং নিজেকে বাঁচানোর চিকিৎসা। দ্বিতীয়তঃ ডাক্তারি শেখার পক্ষে পাঁচবছর যথেষ্ট নয়। সারাজীবন ধরেই ডাক্তারি শিখতে হয়।
হাসপাতালে কাজ করতে করতে বুঝলাম, হাসপাতাল একটা পরিবারের মতো। ডাক্তার, নার্স, গ্রুপ ডি, ফার্মাসিস্ট, সুইপার সকলকে নিয়ে এক বিশাল একান্নবর্তী পরিবার। আর এই পরিবারের মূল স্তম্ভ নিঃসন্দেহে নার্স দিদিরা।
নার্স দিদিরা পৃথিবীর অন্যতম নিয়ম শৃঙ্খলে আবদ্ধ ক্যাডার। এনারা যেভাবে মুখ বুজে বিনা প্রতিবাদে হায়ারার্কি মেনে চলেন তা শেখবার মতো। প্রথম দিকে সেটা আমার কিছুটা বিরক্তিকরই লাগত। কিন্তু পরে বুঝতে পারলাম, চরম হট্টগোলের সরকারি হাসপাতালগুলি টিকিয়ে রেখেছে তাঁদের এই অসাধারণ শৃঙ্খলা। তাছাড়া সম্ভবত এই ক্যাডারের সকলেই মহিলা হওয়ায় এনাদের মধ্যে করাপশন প্রায় দেখাই যায়না।
নার্স দিদিদের কাছে শিখেছি অনেক কিছু। এনারা অনেকেই অত্যন্ত ভালো ছাত্রী। আজকাল তো উচ্চমাধ্যমিকে ৮০% এর বেশি নম্বর না পেলে জি এন এম নার্সিং এ সুযোগ পাওয়াই মুশকিল।
একটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে। আমি তখন গ্রামীণ হাসপাতালে। একটি মেয়ে প্রায় কুড়ি দিন ধরে জ্বরে ভুগছে। ভর্তি করলাম। হাসপাতালে যে সব পরীক্ষা নিরীক্ষা হয় করলাম। জ্বর খুব বেশি আসছে না। কিন্তু রোগিণীর অবস্থা ক্রমশ খারাপ হচ্ছে। সাথে খুকখুকে কাশি। এক্স রে করলাম। তাও পরিষ্কার। এর মধ্যে আবার তিনদিন ধরে রোগিণীর মাসিক শুরু হয়েছে। প্রচণ্ড ব্লিডিং হচ্ছে।
কি করব বুঝতে পারছিলাম না। মাঝরাতে হঠাৎ কল-বুক খেলাম। আমার ডিউটি নয়, অথচ আমার নামেই কল-বুক এসেছে। যেতেই চৈতালীদি বললেন, ‘ডাক্তারবাবু, ওই জ্বর আসা মহিলার রোগ আমি ধরে ফেলেছি। মাঝরাতে কল-বুক দিয়েছি বলে রাগ করবেন না।’
আর রাগ। এমনিতেই মহিলার জ্বর নয়া কমায় আমার ঘুম উড়ে যেতে বসেছিল। বললাম, ‘কি ধরে ফেলেছেন?’
চৈতালীদি একটা প্রেগনেন্সি কার্ড বের করে দেখালেন। দুটো দাগ। মানে পজিটিভ। বললেন, ‘আমি কাল অনেক ভেবেছি। কি হতে পারে। আজ রাতে এসে আরেকবার ভালো করে ইতিহাস নিলাম। ও বারবার বলছে এর আগে মাসিক ঠিক ঠাক হয়েছে। কিন্তু এবার একটু আগে হয়েছে। প্রচুর ব্লিডিং হয়েছে। আমার কেমন সন্দেহ হোল। ওকে বুঝিয়ে শুনিয়ে ‘পি ভি’ পরীক্ষা করলাম। জরায়ুর মুখ খোলা। হাতে রক্তের ক্লট ছাড়াও কিছু জিনিস পেলাম। যেরকম স্পন্টেনিয়াস এবরশনে পাওয়া যায়। ইউরিন টেস্ট করতেই পজিটিভ। আসলে কম বয়সী মেয়ে। মাস চারেক আগেই বিয়ে হয়েছে। ঠিক ঠাক বলতে পারেনি।’
বললাম, ‘রাতে যখন উঠেই পড়েছি, ডিসি সেটটা বার করুন। এখনই ফাঁকায় ফাঁকায় কাজ সেরে যাই।’
সেদিন ডিসি করে মৃত ভ্রূণের বাকি অংশ বের করে দেওয়ার পর রোগিণীর আর জ্বর আসেনি। অনভিজ্ঞ মেয়েটি বুঝতেই পারেনি কখন তার মধ্যে একটি প্রাণ বাসা বেধেছে। কখন সেটি নিজে থেকে নষ্ট হয়ে গেছে। পুরোটা বেরিয়ে না গিয়ে কিছুটা জরায়ুর মধ্যে আটকে থাকায় সেটা সংক্রমণের ফলে জ্বর কমছিল না।
এভাবেই একজন নার্স অনেকসময় চিকিৎসকের চোখ কান হয়ে ওঠেন। রোগীর জীবন বাঁচান। একজন নার্স দিদি শুধু নিজের জন্য কোনোদিনও টিফিন আনেন না। তিনি টিফিন আনেন ওয়ার্ডের সব স্টাফ এবং চিকিৎসকের জন্যও। তিনিই ওয়ার্ডের বেওয়ারিশ শিশুটির মা হয়ে ওঠেন। তাঁর জন্য কিনে আনেন নতুন জামা। তাঁর হাত ধরে স্লেট পেন্সিলে অ আ লেখান। তিনি পরিবার থেকে বহিষ্কৃত হয়ে হাসপাতালে ঠাঁই পাওয়া বৃদ্ধের কন্যা হয়ে ওঠেন। তিনি বিপথে যাওয়া তরুণের মাথায় হাত বুলিয়ে দিদির মতো বলেন, ‘আর ওসব ছাই পাস খাসনে।’
এই করোনার সময়ে তাঁরা নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ডিউটি করতে ইতস্তত করছেন না। দিনের পর দিন নিজের পরিবার, সন্তানদের কাছ থেকে আলাদা হয়ে থাকছেন। এর বিনিময়ে সমাজের কাছ থেকে তাঁরা যে ব্যবহার পাচ্ছেন তা প্রকাশ না করাই ভালো।
বেসরকারি হাসপাতালের নার্স দিদিরা পড়েছেন আরও সমস্যায়। বিশেষ করে যারা ভিন রাজ্য থেকে এসেছেন। এমনিতেই তাঁদের মাইনে অত্যন্ত সামান্য। তাও করোনার সময়ে অনেক জায়গায় অনিয়মিত হয়ে পড়েছে। উপযুক্ত প্রটেকশন ছাড়াই তাঁদের কোভিড রোগীদের চিকিৎসায় নিযুক্ত করা হচ্ছে। তাছাড়া তাঁরা যে যেখানে ভাড়া থাকেন, সেখান থেকে বাড়িওয়ালারা তাঁদের উৎখাত করতে উঠে পড়ে লেগেছেন। তাঁরা রাস্তায় বেরোলে, বাবা মা ছোটো ছোটো বাচ্চাদের বলছেন, ‘ওই দ্যাখ করোনা যাচ্ছে।’
ফলে তাঁরা দলে দলে চাকরি ছাড়ছেন ও রাজ্য ছাড়ার চেষ্টা করছেন। প্রায় পাঁচশোরও বেশি নার্স চাকরি ছেড়েছেন। এটা প্রতিরোধের জন্য মুখ্যমন্ত্রী সাংবাদিক সম্মেলনে যা বলেছেন তা আরও হতাশা জনক। তিনি বলেছেন পাড়ার ছেলে মেয়েদের সাত দিনের ট্রেনিং দিয়ে নিয়োগ করা হবে। যাতে তাঁরা একটু স্যালাইন চালাতে পারে, একটু অক্সিজেন দিতে পারে। এটুকু স্পষ্ট তিনিও ওই হাউস স্টাফ দাদার মতো রোগী নয়, রোগীর বাড়ির লোকের চিকিৎসা করতেই বেশি আগ্রহী।
কর্পোরেট হাসপাতাল গুলি লক্ষ লক্ষ টাকা নেয় রোগী পরিষেবার জন্য। তার কিছুটা অংশও তারা যদি এই অকালে স্বাস্থ্য কর্মীদের সুরক্ষার জন্য ব্যয় করত তাহলে হয়ত আজ এই পরিণতি হতো না।