প্রথমেই বলি ফ্যাটি লিভার (Fatty Liver) রোগটি কি। ফ্যাটি লিভার হলো যকৃতের খুব সাধারণ একটি রোগ। ১৯৮০ সালে অধ্যাপক লুডউইগ প্রথম এ রোগটিকে ভালোভাবে ব্যাখ্যা করেন। যদিও লিভারে সাধারণ চর্বি জমা থেকে শুরু হয়, তবে ফ্যাটি লিভারের কারণে এসব রোগীদের লিভার সিরোসিস (Liver Cirrhosis), এমনকি লিভার ক্যান্সারও হতে পারে। যদিও এই রোগের মূল কারণ অ্যালকোহল, তবে শুধুমাত্র এটিই একমাত্র কারণ নয়। অর্থাৎ অ্যালকোহল ছাড়াও আরও অনেক কারণেই ফ্যাটি লিভার হতে পারে। আর এখানেই শুরু হয় “নন্ অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার ডিজিজ” এর আলোচনা।
নন্ অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার ডিজিজ (Non-Alcoholic Fatty Liver Disease) বা NAFLD বা NASH মূলত সমৃদ্ধিশালী বা দৌলতদার সমাজের একটি রোগ। আজকের দিনে এই রোগের ব্যাপকতা দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। তার মূল কারণ আধুনিক সময়ে আমাদের কায়িক পরিশ্রমের ঘাটতি অর্থাৎ সিডেন্টারি বা আয়েশি জীবন-যাপন (sedentary lifestyle)। আসলে যন্ত্র এবং কৃত্রিমতা আমাদের বহুকাল আগেই গ্রাস করে ফেলেছে। আমরা এখন আর সিঁড়ি ভাঙিনা, সুযোগ পেলেই লিফ্ট বা এসকেলেটর ব্যবহার করি। আমরা এখন আর সাইকেল চালাই না বা পায়ে হেঁটে চলিনা, অল্পদূর যেতে হলেও বাইক ব্যবহার করি। আমরা এখন আর জামাকাপড় হাতে কাচি না, ওয়াশিং মেশিন ব্যবহার করি। এরকম অজস্র উদাহরণ দেওয়া যায়। এছাড়া কাজের জায়গাতেও যাবতীয় কাজ এখন মেশিন দিয়েই হয়। সুতরাং যন্ত্র আমাদের কায়িক পরিশ্রম কেড়ে নিচ্ছে।
আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে মেদ, ভুঁড়ি, ডায়াবেটিস, ডিজলিপিডেমিয়া বা রক্তে অতিরিক্ত চর্বি, হাইপারটেনশন বা অতিরিক্ত রক্তচাপ, হাইপোথাইরয়েডিজম , মেটাবলিক সিনড্রম্ (Metabolic Sybdrome= ডিজলিপিডেমিয়া ~ হাইপারটেনশন~ ডায়াবেটিস ~সেন্ট্রাল ওবেসিটি, বর্ধিত BMI) এই রোগের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।
বিশেষ করে ডায়াবেটিস রোগীদের এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি খুবই বেশি। বর্তমানে জনপ্রিয় ’ফাস্ট-ফুড’ সংস্কৃতির অবদান না উল্লেখ করলেই নয়। শারীরিক পরিশ্রম না করার সাথে সাথে দীর্ঘক্ষণ ধরে বসে কাজ যেমন কম্পিউটারে অনেকক্ষণ কাজ করা আলাদা করে এই রোগের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। অর্থাৎ আপনি মোটা না হলেও এবং কায়িক পরিশ্রম করলেও যদি দীর্ঘক্ষণ ধরে বসে কাজ করেন তাহলেও এই রোগের শিকার হতেই পারেন।
অন্যান্য বেশিরভাগ ক্রনিক লিভার ডিজিজ রোগীদের মতো ফ্যাটি লিভারের রোগীদেরও প্রায়ই কোনো লক্ষণ থাকে না। এদের কেউ কেউ পেটের ডান পাশে উপরের দিকে ব্যথা, ভার-ভার ভাব বা অস্বস্তি, দুর্বলতা কিংবা খুব অল্পতেই ক্লান্ত হয়ে পড়ার কথা বলে থাকেন। তবে বেশিরভাগ রোগীদেরই প্রায়ই কোনো লক্ষণ থাকে না।
বেশিরভাগেরই আল্ট্রাসোনোগ্রাফি বা Liver Function Test (LFT) করতে গিয়ে হঠাৎ করে এই রোগ ধরা পড়ে। তবে একেবারে নিশ্চিতভাবে ফ্যাটি লিভার নির্ণয়ের পরীক্ষা হচ্ছে লিভার বায়োপসি; যা এই রোগে নিষ্প্রয়োজন।
এই রোগের চিকিৎসা ওষুধ দিয়ে হয় না। সুতরাং অযথা ব্যবসার শিকার হবেন না। জীবনযাত্রার পরিবর্তন (Lifestyle Modification)-ই আসল কথা। পর্যাপ্ত শারীরিক পরিশ্রম, খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন, শরীরের ওজন কমানো চিকিৎসার মূল চাবিকাঠি। চিকিৎসার মূল লক্ষ্যই হলো লিভারে সিরোসিস ও ক্যান্সারের ঝুঁকি প্রতিরোধ করা।