চিকিৎসা বিজ্ঞানের এক প্রাচীন এবং চিত্তাকর্ষক শাখা হলো বিষবিদ্যা (টক্সিকোলজি)। বিষবিদ্যার ইতিহাস নিয়ে চিকিৎসক-গবেষকদের থেকেও সাধারণ মানুষের আগ্রহ যেন কিছুটা বেশিই। সাপের বিষ, মাকড়সার রস, আর্সেনিকাদি খনিজ বিষ, হেমলক জাতীয় ভেষজের সাথে দীর্ঘদিনের পরিচয় মানুষের। ইতিহাস বলছে, মিথ্রিডাটিসের সমসময়ে রোম, গ্রিস, এশিয়া মাইনর অঞ্চলে বিষ প্রয়োগে গুপ্ত হত্যা ছিল বহু রাজপরিবারের ইতিহাসের অঙ্গ। বিষ প্রয়োগে গুপ্তহত্যা মোটেও কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা ছিল না সেই সময়ে। মানব সভ্যতার ইতিহাসে বিষ প্রয়োগে হত্যার এমন কিছু বর্ণনা লিপিবদ্ধ করা আছে, যার ক্লাইম্যাক্স নাটকেও হার মানায় (সক্রেটিস স্মর্তব্য)। কোনো সন্দেহ নেই যে সেই সমস্ত রোমহর্ষক মৃত্যুগুলোর সাথে একই পঙতি ঠাঁই পাবে ষষ্ঠ মিথ্রিডাটিসের মৃত্যুও। বিষ নিয়ে এমন বিষাক্ত রাজকীয় কর্মকান্ডের বর্ণনা ইতিহাসে আর দ্বিতীয়টা পাওয়া যাবে না বোধহয়।
মিথ্রিডাটিসের মৃত্যুর পর, সাময়িক ভাবে ইতিহাসের অন্তরালে চলে যায় এই সর্ব বিষ প্রতিষেধকের ঘটনাটা। মিথ্রিডাটিসের মৃত্যুর প্রায় ১০০ বছর পর রোমান মেডিক্যাল এনসাইক্লোপেডিয়ার রচয়িতা অলাস কর্নিলিয়স সেলসাস (খৃস্টপূর্ব ২৬-৫০ খৃস্টাব্দ) তাঁর বিখ্যাত ‘ডি মেডিসিনা’ গ্রন্থে ষষ্ঠ মিথ্রিডাটিস্ ব্যবহৃত এই সর্ব বিষহরার প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন। এই গ্রন্থে এই সর্ব বিষহরার উপকরণের বিশদ বিবরণও পেশ করেন তিনি। সেই সময়ে, মিথ্রিডাটিয়স্ ব্যবহৃত সর্ব বিষহরার নাম হয়তো অনেকেই শুনেছিলেন, কিন্তু সেই বিষহরার উপাদান সম্পর্কে একেবারেই অন্ধকারে ছিলেন সবাই। সেলসাসের বইতে সর্ব বিষহরার সেই উপাদানের উল্লেখ দেখে এখন কৌতুহলী হয়ে পড়ছেন অনেকেই। সেলসাসের বই প্রকাশের পর থেকেই দ্রুত জনপ্রিয়তা তথা পরিচিতি লাভ করতে থাকে এই সর্ব বিষহরা। অচিরেই, মিথ্রিডাটিসের নাম থেকেই এই সর্ব বিষহরা মিথ্রিডাটিয়ম নামে পরিচিতি লাভ করে। কোনো কোনো গ্রন্থকার আবার এই সর্ব বিষহরাকে মিথ্রিডাটাম নামেও উল্লেখ করেছেন।
মিথ্রিডাটিয়মে মোট ৩৬টা উপাদান আছে বলে উল্লেখ করেছেন সেলসাস। এই ৩৬টা উপাদানই ভেষজ তথা উদ্ভিজ। কি সেই ৩৬ ভেষজ যা দিয়ে তৈরি হয়েছিল মিথ্রিডাটিয়ম? সেলসাস বর্ণিত সেই ৩৬ উপাদানের নাম নীচের ছকে বর্ণনা করা হলো। এই সমস্ত ভেষজের ধাত্র মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হতো মধু। মধুই হলো মিথ্রিডাটিয়মের এক মাত্র উপাদান যা ভেষজ নয়। মধু ছাড়াও, স্বাদ বাড়ানোর জন্য ভেরেন্ডা (ক্যাস্টর) তেল ব্যবহার করা হতো মিথ্রিডাটিয়মে। মধু ও ভেরেন্ডা তেলকে এই ৩৬ উপাদানের অন্তর্ভুক্ত করা হয় নি। মিথ্রিডাটিয়মের উপাদান হিসেবে এমন কিছু ভেষজের ব্যবহার দেখা যাচ্ছে, যা কেবলমাত্র মধ্যপ্রাচ্য বা ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলেই পাওয়া যায়। ভারতে বা বাংলায় সেই সব গাছ জন্মায় না বলে, সেই সমস্ত ভেষজের বাংলা নাম পাওয়া যায় না বা বাংলা নাম সহজ লভ্য নয়। ফলে মিথ্রিডাটিয়মে ব্যবহৃত ভেষজের বাংলা নাম চয়নে কিছু বিভ্রান্তি রয়ে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। উৎসাহী পাঠক সঠিক তথ্য প্রদান করলে নির্ভুল তথ্য প্রদানে সক্ষম হই।
সেলসাস বর্ণিত মিথ্রিডাটিয়মের উপাদান সমূহ | |||
ক্রম | সেলসাস উল্লিখিত মূল নাম | বাংলা নাম | ওজন (গ্রাম) |
01 | Cinnamon | দারচিনি/দারুচিনি | 29 |
02 | Ginger | আদা | 29 |
03 | Saffron | জাফরান | 29 |
04 | Rhubarb | রেউচিনি | 28 |
05 | Nard | নিস্যন্দী | 25 |
06 | Opobalsam | গুগুল জাতীয় গাছের গঁদ | 25 |
07 | Shepherd’s purse | কপি গোত্রীয় গাছ | 25 |
08 | Cretan carrot seed | ক্রিট দ্বীপের বুনো গাজরের বীজ | 24.66 |
09 | Flower of round rush | নলখাগড়া ফুল | 24.66 |
10 | Galbanum | কুন্দুরু | 24.66 |
11 | Turpentine resin | তার্পিন | 24.66 |
12 | Castoreum | কলাই জাতীয় গাছ | 24 |
13 | Frankincense | ধুনো (শাল গাছের রস) | 24 |
14 | Hypocistis Juice | বিশেষ জাতের ছত্রাকের রস | 24 |
15 | Malabathrum leaves | তেজপাতা জাতীয় গাছের পাতা | 24 |
16 | Myrrh | রেজিন | 24 |
17 | Opopanax | মধ্যপ্রাচ্যের হলুদ ফুলের গাছ বিশেষ | 24 |
18 | Storax | শিলারস | 21 |
19 | Casia | অমলতাস (সোনালু) | 20.66 |
20 | Darnel | ঘাস বিশেষ | 20.66 |
21 | Long Pepper | মরীচ বিশেষ | 20.66 |
22 | Saxifrage | পাথরকুঁচি | 20.66 |
23 | Sweet flag | ঘোরবচ বা শ্বেতবচ | 20 |
24 | Parsley | পার্সলে | 17 |
25 | Poppy-tears | আফিম | 17 |
26 | Dried rose leaves | শুকনো গোলাপ পাতা | 16 |
27 | Gallic nard | ইতালির সুগন্ধি পুষ্প বিশিষ্ট লতা | 16 |
28 | Gentine root | চিরতা জাতীয় গাছের মূল | 16 |
29 | Anis | পাথুনি বা সেলেরি শাক | 12 |
30 | Acacia Juice | বাবলা জাতীয় গাছের আঠা | 8 |
31 | Cardamon | এলাচ | 8 |
32 | Gum | গঁদ | 8 |
33 | Hypericum | চোলি ফুল্য (হিন্দি) | 8 |
34 | Illyrian iris | বলকান অঞ্চলের আইরিস ফুল | 8 |
35 | Sagapenum | হিং | 8 |
36 | Costamary | চন্দ্রমল্লিকা জাতীয় ফুল | 1.66 |
সেলসাসের বই প্রকাশের পর থেকেই মিথ্রিডাটিয়ম নিয়ে আগ্রহ বাড়তে থাকে আমজনতার। খৃস্টিয় প্রথম শতকে রোমান সাম্রাজ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে মিথ্রিডাটিয়ম। অনেকেই ভাবতে থাকেন এই প্রতিষেধক সেবন করলে বুঝি সমস্ত রকমের অসুখ থেকেও নিস্তার পাওয়া যাবে। দীর্ঘ ও সুস্থ জীবনের আশায় রাজা প্রজা নির্বিশেষে এই মহৌষধ সেবনের আগ্রহ প্রকাশ করতে থাকেন। কিন্তু কে বানাবেন সেই মিথ্রিডাটিয়ম? ক্রেটুয়াসের মতো সেই কুশলী ওষুধ নির্মাতা কোথায়? তবু হাল ছাড়তে নারাজ অনেকেই। ফলে নতুন করে প্রস্তুত হতে লাগলো মিথ্রিডাটিয়ম। অনেকেই সেই প্রস্তুত প্রণালিতে বড়সড় পরিবর্তন আনলেন। বিষের তীব্রতা বাড়াতে অনেকেই আরো নতুন নতুন উপাদান যুক্ত করলেন। খৃস্টিয় প্রথম শতকেই মিথ্রিডাটিয়মের ৫৪ খানা উপাদানের কথা উল্লেখ করেছেন প্রখ্যাত রোমান ইতিহাসবিদ জ্যেষ্ঠ প্লিনি (২৩-৭৯ খৃঃ)। এই তথ্য থেকে এটা স্পষ্ট, ইতিহাসের একটা পর্যায়ে মিথ্রিডাটিয়ম প্রস্তুতিতে অত্যন্ত সক্রিয় ছিলেন বেশ কিছু মানুষ। তবে মিথ্রিডাটিয়ম প্রস্তুতিতে কেউ সফল হয়েছেন বলে শোনা যায় নি। কারণ, শুধু উপাদানের বর্ণনা থেকে তো আর কোনো ওষুধ বা রাসায়নিক পদার্থ তৈরি করা সম্ভব নয়। সেই সমস্ত ওষুধ বানাতে গেলে নির্দিষ্ট তাপ, চাপ, কতক্ষন ধরে তা ফোটাতে হবে, কোনটা গুঁড়ো করে ব্যবহার করতে হবে, কোনটা গোটা ব্যবহার করতে হবে, সেই সমস্ত তথ্যও তো জানা প্রয়োজন। সব দিক বিবেচনা করে, আধুনিক মিথ্রিডাটিয়ম বিশেষজ্ঞরা তাই স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, মিথ্রিডাটিয়ম বানানো সম্ভব নয়। তাঁরা বলছেন “আমাদের হস্তগত দস্তাবেজ অনুসরন করে মিথ্রিডাটিয়ম (প্রস্তুতির) মূল প্রণালী পুনঃনির্মান করা সম্ভপর নয়”। তাছাড়া মিথ্রিডাটিয়মের উপাদানগুলোর পরিমাপ লক্ষ্য করলে দেখে যাবে, কোনোটা ২৯ গ্রাম নেওয়া হয়েছে, তো কোনোটা ২৬.৬৬ গ্রাম নেওয়া হয়েছে, আবার কোনোটা ১.৬৬ গ্রাম নেওয়া হয়েছে। আজ থেকে দু’হাজার বছর আগে, এতো সূক্ষ্ম পরিমাপ করা যে কি ভাবে সম্ভব হলো, তা অনুমান করা বেশ কষ্টকর। তাঁর ‘নেচারাল হিস্ট্রি’ গ্রন্থে ঠিক এই প্রশ্ন তুলেই জ্যেষ্ঠ প্লিনি লিখেছেন, “সত্য করে বলুন (তো) কোন দেবতা এই কিম্ভূতকিমাকার অনুপাত বাৎলেছেন? কোনো মানুষের মস্তিষ্কই (এই পরিমাপ নির্ধারণের জন্য) এতো তীক্ষ্ণ হতে পারে না। এটা পাতি (পরিমাপ) কলার জাহির আর বিজ্ঞানের দর্প”[9]।
উপাদানের সূক্ষ্ম পরিমাপ নিয়ে প্লিনির এই সমালোচনা অবশ্য আজ আর ততটা উপযোগী নয়। আধুনিক যন্ত্রের সাহায্যে অনেক সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ভরই আজ পরিমাপ করতে পারি আমরা। তাহলে আর অসুবিধা কোথায়? এটা সেটা মিক্স করে একটা চেষ্টা করতে ক্ষতি কি? হুবহু এক না হোক মিথ্রিডাটিয়মের কাছাকাছি এক সর্ব বিষ প্রতিষেধক তো প্রস্তুত করতেই পারি আমরা। কি, চেষ্টা করেবেন নাকি একবার?
গ্রন্থপঞ্জী –
1) Adrienne Mayor, ‘The Poison King: The Life and Legend of Mithridates, Rome’s Deadliest Enemy’
2) Appian (of Alexandria), ‘Roman History’.
3) Aulus Cornelius Celsus, ‘De Medicina’
4) Aulus Gellius, ‘Attic Nights’
5) Cassius Dio, ‘Roman History’.
6) Florus, ‘Epitome of Roman History’
7) Laurenve M. V. Totelin, ‘Mithradates antidote-a pharmacological ghost’
8) Marcus Junianus Justinus, ‘Epitome of the Philippic History of Pompeius Trogus’.
9) Pliny (the Elder), ‘Natural History’
10) Various online sites (for herbal names).