ম্যাক্লাউড এখন বেশ বুঝতে পারছেন যে কুকুর বা গবাদি পশুর প্যানক্রিয়াস থেকে ইনসুলিন প্রস্তুত করাটা তেমন কোনো সমস্যার বিষয় নয়। এখন সময় এসেছে পরিশোধিত ইনসুলিন প্রস্তুত করার। শুধু তাই নয়, আসল পরীক্ষাই কিন্তু বাকি রয়ে গেছে এখনও। এখনও তো কোনো মানুষের উপর প্রয়োগই করা হয় নি ইনসুলিন ইঞ্জেকশন। মানুষের দেহে ইনসুলিনের কি প্রভাব সেটাই তো জানা হয় নি এখনও পর্যন্ত। আর মানুষের উপর ইনসুলিন প্রয়োগের ফলাফল জানতে না পারলে তো সমস্ত গবেষণাই থমকে যাবে। মানুষের উপর ইনসুলিন প্রয়োগের মধ্যেই তো নিহিত রয়েছে তাঁদের সাফল্য বা ব্যর্থতার চাবিকাঠি। ম্যাক্লাউডের বিবেচনায় তাই, ঠিক দু’টো কাজ বাকি আছে এই মুহূর্তে। প্রথম কাজটা হলো ইনসুলিন পরিশোধন করা আর দ্বিতীয় কাজটা হলো মানুষের দেহে তা প্রয়োগ করা।
ইনসুলিন পরিশোধনের ব্যাপারে কিন্তু, বান্টিঙ বা বেস্ট, কারও উপরই ভরসা করেন না ম্যাক্লাউড। না, তিনি নিজেও এই দায়িত্ব নেবেন না। এই ব্যাপারে বিকল্প ভেবে রেখেছেন তিনি। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি, টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র কলিপকে [২৭] তাঁদের পরীক্ষায় সামিল হবার জন্য আহ্বান জানালেন ম্যাক্লাউড। কলিপ তখন আলবেরটা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগে লেকচারার পদে কর্মরত। পাশাপাশি আলবেরটা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণাও করছেন তিনি। ম্যাক্লাউডের প্রস্তাব পেয়ে বছর খানেকের জন্য টরন্টো আসার সিদ্ধান্ত নেন কলিপ। সেই মতো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কয়েক মাসের ছুটির জন্য দরখাস্ত পেশ করলেন তিনি।
ইনসুলিন পরিশোধনের কাজে তৃতীয় কারও সহযোগিতার কথা আগেই অনুভব করেছিলেন বান্টিঙ। তাই তাঁদের পরীক্ষায় কলিপের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে বড় কোনো আপত্তি ছিল না বান্টিঙের। ফলে বান্টিঙ-বেস্ট-ম্যাক্লাউড ছাড়াও, ইনসুলিন গবেষণায় যুক্ত হলেন চতুর্থ বিজ্ঞানী- কলিপ। বান্টিঙ লিখেছেন, ক্রিসমাসের সাত দিন আগে কলিপ এসে কাজে যোগ দেন তাঁদের সাথে। মাস খানেক পর, ২৫শে জানুয়ারি ১৯২২ সালে, এই প্রসঙ্গে কলিপ লিখেছেন, “আমরা তিনজন প্রফ. ম্যাক্লাউডের এই কাজের সাথে যুক্ত ছিলাম। একজন সার্জন ডা. বান্টিঙ এবং এক সাম্প্রতিক স্নাতক মিঃ বেস্ট- যিনি প্রথম প্যানক্রিয়াস নির্যাসকে কার্যকরী ভাবে উপস্থাপনা করেছেন। [নির্যাসের] পরবর্তী উন্নতির জন্য এবং নিশ্চিত ভাবে তার রাসায়নিক দিকটা দেখভাল করতে এবং একই সাথে শারীরবৃত্তীয় সমস্যার দিকটা দেখতে আহ্বান করা করা হয়েছিল আমাকে”।
কলিপের অন্তর্ভুক্তিকে যে কতটা স্বাগত জানাবেন বান্টিঙ ও বেস্ট সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দিগ্ধ ছিলেন ম্যাক্লাউড। তাঁর অনুমান, কলিপের সাথে বান্টিঙ-বেস্টের বোঝা পড়ার সমস্যা হতে পারে। সেই সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখেই বান্টিঙ-বেস্টদের দলের সাথে সরাসরি যুক্ত করলেন না কলিপকে। কলিপের পরীক্ষার জন্য আলাদা একটা ঘরের ব্যবস্থা করে দিলেন ম্যাক্লাউড।
জেমস বারট্রাম কলিপ, নিজের ল্যাবে। |
ম্যাক্লাউডের অনুমান যে ভুল ছিল না অচিরেই তা প্রমাণ হয়ে গেলো। তাঁদের গবেষণায় কলিপের নাক গলানোকে মোটেও ভালো ভাবে মেনে নেন নি বান্টিঙ-বেস্ট। আইলেটিন পরিশোধনে কলিপের সাহায্য জরুরি বিবেচনা করে কিছুটা শান্তই রইলেন বান্টিঙ। কিন্তু সুর চড়ালেন বেস্ট। কলিপের নিয়োগ নিয়ে ম্যাক্লাউডের সাথে এক প্রস্থ বাক-বিতন্ডায় জড়িয়ে পড়লেন তিনি। বেস্টই বেশি বললেন এবার, বান্টিঙ কিছুটা নীরব। উল্টে, রগচটা বান্টিঙই বারবার নিরত করতে থাকেন বেস্টকে। পরবর্তীতে আমরা দেখবো, বিদ্বেষ ভুলে বান্টিঙ ও কলিপ যথেষ্টই ঘনিষ্ঠ হতে পেরেছিলেন, সেই তুলনায় বেস্ট ও কলিপ প্রায় আজীবনই পরস্পরের বিরোধিতা করে গেছেন। বান্টিঙের বায়োপিক ‘দ্য কোয়েস্ট’ [২৮] তৈরির সময় বেস্টের এক সাক্ষাৎকার নেন হার্ডি বয়েজের স্রষ্টা লেসলি ম্যাকফারলেন। ১৯৫৬ সালের সেই সাক্ষাৎকারে বেস্ট বলেছিলেন, “ম্যাক্লাউড, বান্টিঙ ও বেস্ট ছাড়া অন্য কারো নাম উল্লেখ করবেন না [বায়োপিকে]। কলিপের নাম উল্লেখ করার প্রয়োজনই নেই”।
কাজে যোগ দেবার প্রথম দিন থেকেই সহকর্মীদের কাছ থেকে উত্তপ্ত অভ্যর্থনা পেলেন কলিপ। কলিপের বুঝে নিতে অসুবিধা হয় নি যে তাঁর নিয়োগকর্তা একদিকে আর মূল গবেষকরা আরেকদিকে। বান্টিঙের পরীক্ষা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন কলিপ। তিনি জানেন এই নির্যাস এখন পরিশোধন করা প্রয়োজন। সেই মতো কাজ শুরু করলেন তিনি। কলিপ তাঁর দৈনন্দিন কাজের রিপোর্ট জমা দেন তাঁর নিয়োগকর্তা ম্যাক্লাউডের কাছে। তাঁর কাজের অগ্রগতির ব্যাপারে বান্টিঙ বা বেস্টের কাছে খুব একটা মুখ খুলতেন না তিনি। তবে, বান্টিঙ বা বেস্টের সাথে বাক্যালাপ বন্ধ ছিল না তাঁর।
কলিপ ছিলেন দক্ষ বায়োকেমিষ্ট। প্রথম থেকেই বেশি পরিমাণে প্যানক্রিয়াস নির্যাস তৈরির ব্যাপারে সচেষ্ট ছিলেন তিনি। এই জন্য বান্টিঙের মতো কুকুরের উপর নির্ভরশীল ছিলেন না কলিপ। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শুয়োর, গরু প্রভৃতি গবাদি পশুর প্যানক্রিয়াস ব্যবহার করতেন তিনি। গবাদি পশুর প্যানক্রিয়াসকে কুচি কুচি করে কেটে প্রথমে অ্যালকোহল দ্রবণে চুবিয়ে দিলেন কলিপ। পরে, দ্রবণকে ফিল্টার করে প্যানক্রিয়াস কুচিগুলোকে বাদ দিয়ে দিলেন। এই পরিশ্রুত দ্রবণে ৯৫% ইথাইল অ্যালকোহল মিশিয়ে নিম্ন [২০০-৩০০ সেন্টিগ্রেড] তাপমাত্রায় পাতিত করে নিলেন দ্রবণটাকে। পাতিত নির্যাসকে এবার ঘূর্ণীয়মান সেন্ট্রিফিউজ যন্ত্রে বসিয়ে দিলেন তিনি। কয়েক ঘন্টা পর, তরলের উপরি স্তর থেকে পৃথক করে নিলেন নির্যাস। এই নির্যাসই হলো কলিপের পরিশ্রুত করা ইনসুলিন।
ইনসুলিনের তিন কারিগর, (বাঁদিক থেকে) কলিপ, বেস্ট ও বান্টিঙ। মাঝে জনৈক চতুর্থ জন। |
এবার কলিপের প্রস্তুত ইনসুলিনের কার্যকারিতা পরীক্ষার পালা। ২২শে ডিসেম্বর ১৯২১, একটা সুস্থ [ননডায়াবিটিক] খরগোশের দেহে স্বল্প মাত্রায় পরিশোধিত ইনসুলিন ইঞ্জেকশন করলেন তিনি। কিছুক্ষণ পর খরগোশের রক্ত পরীক্ষা করা হলো। দেখা গেল, রক্তে সুগারের মাত্রার অনেকটাই কমে গেছে খরগোশের। কলিপ নিশ্চিত হলেন যে তাঁর পরিশোধিত ইনসুলিন সঠিক ভাবেই কাজ করেছে খরগোশের দেহে। বান্টিঙ যেখানে কুকুরের প্যানক্রিয়াস কেটে, কুকুরটাকে ডায়াবিটিস রোগীতে পরিণত করে, ডায়াবিটিস গ্রস্ত কুকুরের উপর তাঁর ইঞ্জেকশন প্রয়োগ করতেন, কলিপ সেখানে সুস্থ খরগোশের উপর ইনসুলিন দিয়ে দেখে নিলেন খরগোশের ব্লাড সুগার কমছে কিনা। খরগোশের ব্লাড সুগার অস্বাভাবিক ভাবে কমে গেলে বা ‘সুগার ফল’ করলে, খরগোশটাকে চিনি বা গ্লুকোজ খাইয়ে দিতেন তিনি। স্পষ্টতই, বান্টিঙের পরীক্ষার থেকে কলিপের পরীক্ষা ছিল অনেক কম ঝামেলার। তাই কলিপের পরীক্ষায় প্রাণী মৃত্যুর হারও ছিল অনেক কম।
কলিপ তাঁর পরীক্ষায় সাফল্যের কথা জানালেন ম্যাক্লাউডকে। কলিপের উপর অনেকটাই ভরসা করেন ম্যাক্লাউড। ম্যাক্লাউড বুঝলেন, কলিপের পরিশোধনে আশানুরূপ ফল পাওয়া গেছে মানে, সাফল্য এখন হাতের মুঠোয় এসেছে। এবার সময় হয়েছে ইনসুলিনের কার্যকারিতা সবার সামনে তুলে ধরার। এবার আর টরন্টোর পরিধির মধ্যে তাঁদের সাফল্যকে আটকে রাখতে চান না তিনি। এবার আরো বড় মঞ্চ ব্যবহার করতে চান ম্যাক্লাউড। সমস্ত পৃথিবীর কাছে তুলে ধরতে চান তাঁদের সাফল্যের খবর।
(চলবে)
[২৭] অন্টারিয় প্রদেশের বেলভিল শহরে জন্মগ্রহণ করেন জেমস বারট্রাম কলিপ (১৮৯২-১৯৬৫)। বেলভিল হাইস্কুলে পাঠান্তে ১৯০৮ সালে টরন্টোর শহরের ট্রিনিটি কলেজে ভর্তি হন। ১৯১২ সালে ফিজিওলজি এবং বায়োকেমিস্ট্রি নিয়ে স্নাতক হন। ১৯১৩ সালে এমএ পাশ করেন। ১৯১৬ সালে টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বায়োকেমিস্ট্রিতে পিএইচডি করেন কলিপ।
[২৮] গত শতকের পাঁচের দশকের মাঝামাঝি, বান্টিঙকে নিয়ে পূর্ণ দৈর্ঘ্যর ফিল্ম তৈরির প্রস্তুতি নেন ‘ন্যাশনাল ফিল্ম বোর্ড অব কানাডা’। চিত্রনাট্য রচনার সুবাদে, ১৯৫৪-৫৫ সালে চার্লস বেস্টের এক সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন লেসলি ম্যাকফারলেন (১৯০২-১৯৭৭)। এই সাক্ষাৎকারেই টস প্রসঙ্গে নিজের মতামত জানান বেস্ট [পর্ব ৭ দ্রষ্টব্য]। বেস্টের দেওয়া সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে এবং বেস্টের প্রচ্ছন্ন মদতে, চিত্রনাট্য থেকে সুচিন্তিত ভাবে ছেঁটে ফেলা হয়েছিল কলিপকে। ম্যাকফারলেনের চিত্রনাট্য পড়ে রুষ্ট টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয় ফিল্ম তৈরির অনুমোদন নাকচ করে দেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধিতার কারণে পিছিয়ে আসেন ফিল্ম বোর্ডও। কিন্তু ততক্ষণে ১৫,০০০ কানাডিয়ন ডলার ব্যয় হয়ে গেছে এই ফিল্মের পিছনে। অগত্যাই স্বল্পদৈর্ঘ্যের একটা ফিল্ম তৈরি করা হয়। ন্যাশনাল ফিল্ম বোর্ড অব কানাডার প্রযোজনায়, স্ট্যানলি জ্যাকসন পরিচালিত ৩৬ মিনিটের ‘দ্য কোয়েস্ট’ মুক্তি পায় ১৯৫৮ সালে, যাতে বান্টিঙ ও বেস্টই মূল চরিত্র (পাঠকদের ‘দ্য কোয়েস্ট’ দেখার আবেদন জানাচ্ছি)। ৭ই অগস্ট ১৯২১ পর্যন্ত ঘটনাবলী দেখানো হয়েছে এই ফিল্মে। স্বাভাবিক ভাবেই কলিপ প্রসঙ্গ অবতারণা করার প্রয়োজন হয় নি ফিল্মে, কারণ কলিপ এই পরীক্ষায় সামিল হয়েছিলেন ডিসেম্বরের মাঝামাঝি। এই ফিল্ম দেখার পর ‘ন্যাশনাল রিসার্চ কাউন্সিল’এর সভাপতি এডগার উইলিয়ম রিচার্ড স্টিশি (১৯০০-১৯৬২) বলেন, “এটা দুঃখজনক যে ডা. বেস্ট, অনস্বীকার্য ভাবে মস্ত প্রতিভা, ইনসুলিন আবিষ্কারে নিজের ভূমিকা বর্ণনায় এতো সময় ব্যয় করেছেন যা তাঁর প্রকৃত অবদানের থেকে অনেক বেশি”। প্রসঙ্গত, বিজ্ঞানে মৌলিক অবদানের জন্য ১৯৬৪ সাল থেকে ‘স্টিশি পুরস্কার’ চালু করেন কানাডা সরকার।