লকডাউনের আজ সপ্তম দিন। একটু পিছনে ফিরে দেখে নি, এই এক সপ্তাহে আমি কি জানলাম, কি শিখলাম।
১. হাইপোক্লোরাইট সলিউশান দিয়ে শ্রমিকদের শোধন করাঃ জানতাম হাইপোক্লোরাইট সলিউশান মানব দেহের চামড়া, বিশেষ করে নরম চামড়ার জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। সরাসরি চোখে গেলে দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হতে পারে। দেহের ভেতরে করোনা ভাইরাস থাকলে তাঁকে হাইপোক্লোরাইটে স্নান করিয়ে ক্ষতি ছাড়া কোনো লাভ হবে না।
উত্তরপ্রদেশের পুলিশ সেটাই করল। দরিদ্র শ্রমিকদের রাস্তায় ফেলে হাইপোক্লোরাইটে স্নান করল। ভাত দেবার মুরোদ নাই, কিল মারার গোঁসাই।
২. আরও আশ্চর্য বিষয় হল এসব নিয়ে কিছু বলতে গেলে এক দল লোক গাঁক গাঁক চিৎকার করছেন, কেরলেও নাকি ২৩ তারিখে শ্রমিকদের এই ভাবে হাইপোক্লোরাইটে স্নান করানো হয়েছিল। তখন আমি কেন নিশ্চুপ ছিলাম, আমি নির্ঘাত বামপন্থী ইত্যাদি, ইত্যাদি।
গরীব মানুষের কথা বললে তাঁকে বামপন্থী হতেই হবে এটাও জানলাম। যদিও তাঁদের উল্লেখিত বামপন্থী জিনিসটা কি, খায় না মাথায় দেয়, নাকি এটা এক ধরণের গালাগালি সেটা আমি এখনও জানিনা।
৩. আমি ডাক্তার হওয়ার পর পনের বছরে যত প্যানিক ডিজঅর্ডারের রোগী দেখেছি, এই এক সপ্তাহে তার চেয়ে বেশি প্যানিক ডিজঅর্ডারের রোগী দেখেছি। প্রায় সকলেই আত্ঙ্কে ভুগছেন। দুবার হাঁচি দিলেই অনেকে করোনা ভাইরাসের জন্য থ্রোট সোয়াব বা রক্ত পরীক্ষা করাতে চাইছেন।
৪. বেশীরভাগ মানুষই যে অকৃতজ্ঞ সেটা মহামারীর চোখে আঙুল দিয়ে শেখালো। যাঁরা স্বাস্থ্য কর্মীদের জন্য থালা বাজালেন, তাঁরাই পরের দিন ভাড়ায় থাকা চিকিৎসক, নার্সদের ঘর থেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বার করে দিয়েছেন। ভুবনেশ্বরে মহিলা চিকিৎসককে এমনকি বাড়ি না ছাড়লে ধর্ষণের হুমকি দেওয়া হচ্ছে।
৫. এটা বন্ধু চেনারও সময়। অনেকেই না চাইতেই দরিদ্র রোগীদের জন্য সাহায্য করতে চাইছেন। ওষুধ দিয়ে যাচ্ছেন। অনেকে রোগীই আমাকে স্যানিটাইজার উপহার দিয়েছেন। উচ্চপদে কাজ করা বন্ধু ফোন করে বলছে, বাড়ি বসে অসহ্য লাগছে ভাই। আমাকে লড়ার একটা সুযোগ করে দে। যে কোনও সরকারি হাসপাতালে ট্রলি ঠেলতেও রাজি। না হলে তোর সাথে থাকি। তোর কম্পাউন্ডারি করি।
৬. কমদামী রেনকোট যে PPE হিসাবে ব্যবহার করা যায় সেটাও শিখলাম। ছেঁড়া ফাটা রেনকোট পরা ভাইবোনদের বিপদ থেকে রক্ষা করার জন্য এখনও ভগবানে বিশ্বাসী হতে রাজি আছি।
৭. মিষ্টি একটি অত্যাবশ্যকীয় পণ্য হিসাবে স্বীকৃতি পেল। আমি এটা আগে থেকেই মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতাম। যাঁরা রসরাজের নলিনীর স্বাদ থেকে বঞ্চিত, তাঁরা জীবনের প্রকৃত স্বাদ কোনোদিনই পাননি। কেউ সমর্থন না করলেও, মুখ্যমন্ত্রীর এই সাহসী সিদ্ধান্ত নেওয়ার পেছনে আমার পূর্ণ সমর্থন আছে। করোনায় মরতে হলে মরবো। কিন্তু জলভরা খেয়েই মরবো।
বিদ্রঃ সকালে রোগী দেখে ফেরার পথে রসরাজে গেছিলাম। তখন সাড়ে বারোটা। কিন্তু রসরাজ খোলেনি। অন্য একটি দোকানে শুধু ক্ষীর-কদম ছিল। তাই গোটা দশেক কিনে এনেছিলাম। কিন্তু সেগুলো এতোটা শক্ত, দাঁত দিয়ে ভাঙা যাচ্ছে না। আমার বড় মেয়ের দাঁত নড়ছিল। মিষ্টি খেতে গিয়ে ওর দুটো দাঁত পড়ে গেছে। আমি বাড়িতে রোগী দেখা শেষ করে লিখছি আর চুষে চুষে খাচ্ছি।