ইয়াস, মিউকরমাইকোসিস ও হাঁটুজলে সাঁতার
ভয় পেতে লোকজন যে বেশ ভালোবাসে, সেটা খুপরিতে রোগী দেখার সময় হাড়ে হাড়ে বুঝি। মুশকিল হলো ভয়ের যে চারাগাছ সকলে জলটল দিয়ে বাঁচিয়ে রাখে, একটু বড় হয়েই সে শরীরের ভেতর শিকড় বাকড় ছড়িয়ে গেঁড়ে বসে। তখন আর তাকে উপড়ে ফেলা যায় না।
রোজকার মতো একঘেঁয়ে রোগী দেখছিলাম। আজ আবার ইয়াস ঘূর্ণিঝড়ের দিন। সকাল থেকেই মাঝে মাঝে বৃষ্টি হচ্ছে, হাওয়া বইছে।
একটু আগেই একজন এসেছিলেন, বুক ধড়ফড় করছে। তিনি সকাল থেকে টিভি দেখছিলেন। টিভিতে নাকি দেখিয়েছে দীঘাতে নারকেল গাছের মাথার উপর দিয়ে জল বইছে।
বললাম, ‘দীঘা তো অনেক দূরে। আপনি এতো চিন্তা করছেন কেন?’
তিনি বললেন, ‘কোথায় দূরে। রাস্তা ভালো হয়ে গেছে। কদিন আগেই গেছিলাম। তিন ঘণ্টায় পৌঁছে গেলাম।’
সকালে ঝড় বৃষ্টির মধ্যে খারাপ রাস্তায় স্কুটারে সোদপুরে যেতে আসতে ভালোই ভুগেছি। কিন্তু রাস্তা ভালো মন্দের সাথে ঘূর্ণিঝড়ের কী সম্পর্ক বুঝলাম না। ঘূর্ণিঝড় নিশ্চয়ই রাস্তা ধরে আসবে না।
একটু ভোকাল টনিক দিয়ে, প্রেশার ট্রেশার দেখে তাঁকে বাড়ি পাঠালাম। তারপর খুপরি পুরো ফাঁকা। বারান্দায় গিয়ে গৌড় আর সঞ্জীবদার সাথে গল্প করছিলাম, হঠাৎ একটা টোটো এসে দাঁড়াল। দুজন মিলে একটি ছেলেকে প্রায় চ্যাংদোলা করে নামালেন। কী হয়েছে?- জিজ্ঞেস করার আগেই তাঁরা বলতে শুরু করলেন, ‘ডাক্তারবাবু, একটু তাড়াতাড়ি দেখুন। দম আটকে অজ্ঞান হয়ে গেছে। একবার যন্ত্রটা দিয়ে অক্সিজেন দেখুন।’
ততক্ষণে আমি দেখে ফেলেছি অজ্ঞান অবস্থাতেও ছেলেটির চোখের পাতা নড়ছে। সম্ভবত পাতি কনভারসন ডিজওর্ডার। ধীরে সুস্থে পালস অক্সিমিটার লাগালাম। স্যাচুরেশন ৯৯%। সঙ্গের দুজন ছেলেটার বাবা ও কাকা। সেই দুজনকে দেখালাম। বললাম, ‘একে মাস্ক পরাননি কেনো? শিগগিরী মাস্ক পরান।’
‘দম আটকে যাচ্ছিল বলে মাস্ক পরাইনি। ডাক্তারবাবু, আমার ছেলে ঠিক আছে তো? ওর কিন্তু দুদিন আগে করোনা ধরা পড়েছে।’
আবার চমকালাম, ‘একটা করোনা রোগীকে এভাবে আপনি টোটো করে চেম্বারে নিয়ে এসেছেন! তাও মাস্ক ছাড়া!! আজ না হয় ঝড়- বৃষ্টির জন্য লোক নেই। না হলে যারা থাকত সকলেরই করোনা হয়ে যেত।’
নিজেই একটা সার্জিক্যাল মাস্ক বের করে তাড়াতাড়ি পরালাম। ইতিমধ্যেই আমার একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট করোনা আক্রান্ত হয়ে বাড়িতে আইসোলেশনে। গৌড়ের করোনা হলে চেম্বারে তালা ঝোলাতে হবে।
বুকে একটু চাপাচাপি করতেই ছেলেটা উঠে বসল। বলল, ‘জল খাব।’
বললাম, ‘জলটল যা খাবে, বাড়ি ফিরে ফাঁকা ঘরে বসে খাবে। ইতিমধ্যেই যা কাণ্ড ঘটিয়েছো তাতে তোমার কাকা আর বাবার করোনা হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। এমনকি আমার নট আউট থাকার রেকর্ডও ভেঙে যেতে পারে। কী অসুবিধা হচ্ছে চটপট বল।’
‘ডাক্তারবাবু, আমার বুকটা কেমন চেপে আসছে। নাক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।’
বললাম, ‘তুমিও কি সকাল থেকে টিভি দেখছিলে? মানে ইয়াস ঘূর্ণিঝড়ের খবর দেখছিলে? তোমার যেটা হচ্ছে সেটা হল প্যানিক অ্যাটাক। অত্যাধিক টেনশনে এমন হতে পারে।’
‘না ডাক্তারবাবু, আমি টেনশন করি না। আমি রোজ জিম করি, চারখানা ডিম খাই। আপনি একটু মন দিয়ে আমার সমস্যাটা শুনুন। নাক তো দুদিন বন্ধ ছিলোই, আজ সকালে একফোঁটা রক্তও পড়েছে। আমার সম্ভবত মিউকো.. ওই কী যেন বলেনা ব্ল্যাক ফাংগাস- ওইটা হয়েছে।’
যাক, এর অসুখও সিলেবাসের মধ্যে। এ ভুগছে মিউকরমাইকোসিস ফোবিয়ায়। গত তিন চারদিন ধরে এমন রোগী অনেক পাচ্ছি। এবং এর জন্য দায়ী মিডিয়াতে মিউকরমাইকোসিস নিয়ে লাগাতার খবর।’
বললাম, ‘বাবা, মিউকর মাইকোসিস এতো সহজে হয় না।’
‘কেন? হবে না কেন? ওই জীবাণু কি আমাদের এখানে নেই?’
‘থাকবে না কেন। নিশ্চয়ই আছে। প্রচুর পরিমাণে আছে। পঁচা খাবার, পঁচা পাতা, মৃত পশুর দেহে হামেশাই এই ছত্রাক দেখা যায়। কিন্তু এই রোগ এতো সহজে হয় না।’
‘কিন্তু টিভিতে যে বলছে এই রোগ কোভিডের পর হতে পারে।’
‘কোভিডের পর হতে পারে, কিন্তু কাদের হবে? যারা হাসপাতালে দীর্ঘ দিন ভর্তি থাকছে, দীর্ঘ সময় ধরে অক্সিজেন, স্টেরয়েড, এন্টিবায়োটিক, এন্টিফাংগাল ইত্যাদি লাগছে- তাদের হতে পারে। তোমার মতো কমবয়সী ছেলের মিউকরমাইকোসিস হওয়ার সম্ভাবনা নেই।’
‘আপনি একবার নাকের ভেতরটা দেখবেন না?’
‘মাপ করো ভাই। একজন এক্টিভ করোনা রোগীর নাকের ভেতর উঁকি মেরে দেখার দুঃসাহস আমার নেই।’
ছেলেটা অত্যন্ত মনোক্ষুণ্ণ হয়ে বলল, ‘তাহলে কটা এম্ফোটেরিসিন বি লিখে দিন। ওষুধটা খেয়েই রাখি। এরোগে তো বাঁচার সম্ভাবনা কম।’
আমি হতবাক হয়ে বললাম, ‘টিভি,মোবাইল দেখা বন্ধ না করলে তোমার খবর আছে।’
ছেলেটিকে টোটোয় তুলে ওর বাবা ফেরত এলেন। বললেন, ‘এসেছি যখন আর আপনি ফাঁকা আছেন যখন- একবার দেখিয়ে যাই।’
ভাবলাম, নিশ্চয়ই জানতে চাইবেন ছেলেকে এভাবে জড়াজড়ি করে নিয়ে আসার জন্য করোনা হতে পারে কিনা, হলে কী করবেন।
কিন্তু তিনি বললেন, ‘ডাক্তারবাবু, আমার খুব গ্যাসের সমস্যা। যা খাই তাতেই গ্যাস হয়। এমনকি জল খেলেও গ্যাস হয়। আজ সকাল থেকে নতুন সমস্যা। ডান হাঁটু ব্যথা করছে। আর হাঁটুতে চাপ দিলেই ঢেকুর উঠছে। এই দেখুন…’
উনি নিজের ডান হাঁটুতে চাপ দিলেন এবং সাথে সাথে হেউ করে একটি বিচ্ছিরি ঢেঁকুর তুললেন।
উফ, এইভাবে ঝড় বৃষ্টির মধ্যে স্কুটার নিয়ে ঘুরে ঘুরে সার্কাস দেখার থেকে, হাঁটু জলে সাঁতার কেটে কেটে লোককে যতটা পারা যায় সাহায্য করা ভালো।