ভয়ের দিন আবার ঘুরে আসছে!
দুপুরবেলা। সদ্য রাউন্ড শেষ হয়েছে। ঘন্টা তিনেক একটানা দাঁড়ানোর পর চেয়ারে বসে আড়মোড়া ভাঙছি। আমাদের তিন মক্কেলের আড্ডার আসর সবে একটু একটু করে ক্ষীর হ’তে শুরু করেছে। ও হ্যাঁ, যাঁরা এখনো জানেন না তাঁদের বলে দিই- আমরা ডাক্তাররাও কাজের ফাঁকে একটু আধটু আড্ডা দিই। আরও আশ্চর্যের কথা শুনবেন? আমাদেরও খিদে পায়। প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে হয়। আমাদেরও ঘাড়ের ওপর একটিই মাথা এবং কাঁধের ওপর ওই দু’খানিই হাত। আগে অনেকবার এরকম হয়েছে; ডাক্তার আড্ডা দেয় শুনে অনেকেই চোখ পাকিয়ে বলেছেন- “এই করেই তো সব গোল্লায় গেল! ডাক্তার হয়েছে হারামজাদাগুলো! কোথায় মানুষের সেবা করবে তা না… শালা আড্ডা মারাচ্ছে! দেখুন দিকি বরুণবাবু, ডাক্তারও যদি আড্ডা মারবে বলে… ছিঃ ছিঃ! কী দিন এলো… সেই এক আমাদের সময় ছিলেন ডা. সেন…” এসব কথা শুনে একসময় কোমর বেঁধে ঝগড়া করতে যেতাম। “কুকুর বলে কি মানুষ নয়” এরকম ঢংয়ে বলার চেষ্টা করতাম- “কেন? ডাক্তার বলে কি…” ইত্যাদি। তারপর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে। এখন এসব মন্তব্য শুনলে মুচকি হেসে শশা খাই; কচরমচর।
যাক গে, যা বলছিলাম… আমাদের আড্ডার তাল কেটে দিয়ে জুনিয়র হাঁফাতে হাঁফাতে এসে বলে-
– ব্লাড গ্যাসটা দ্যাখো দাদা। খারাপ আছে।
– হুম। হিমোগ্লোবিনের অবস্থাও তো ভালো না রে…
– খুব ডিস্ট্রেস হচ্ছে
– এক কাজ কর। ওকে এখানে শিফট কর। দেখি কী অবস্থা…
আড়াই মাসের বাচ্চা আইসিইউ-র ভেতরে ঢুকলো। ঠোঁট-মুখ অক্সিজেনের অভাবে নীল। ফ্যাকাসে হাত-পা। ভেন্টিলেটরে দিতে হ’ল। রক্ত আনতে দেওয়া হ’ল। ভেন্টিলেটরে রেখেও অক্সিজেন স্যাচুরেশন উঠছেই না। বাড়ির লোকজনের সাথে কথা বলা হ’ল। ঘন্টাখানেক বাদে জানা গেল বাচ্চা কোভিড পজিটিভ। তড়িঘড়ি আইসোলেশন ওয়ার্ডে পাঠানো হ’ল। বাচ্চার অবস্থা রীতিমতো আশঙ্কাজনক।
মোদ্দা কথা এই, কোভিড বাড়ছে। চড়বড়িয়ে বাড়ছে। আইসোলেশন ওয়ার্ড আবার ভরে উঠতে শুরু করেছে। স্যোশাল মিডিয়ায় এক বছর আগের লেখা, গত বছরের বিভিন্ন ঘটনা ভেসে উঠছে। মাইলের পর মাইল পায়ে হাঁটা পরিযায়ী শ্রমিক, রেললাইনে কাটা পড়া ‘সস্তা’ মানুষ, মারীর শুরুর দিনগুলোর আতঙ্ক, শুনশান রাস্তাঘাটের ছবি… সব আবার নতুন করে চোখের সামনে আসছে। শুরুর দিনগুলোর দমবন্ধ করা পরিস্থিতিতে পিপিই ছাড়া, পর্যাপ্ত মাস্ক বা অন্যান্য সুরক্ষা ছাড়াই স্বাস্থ্যকর্মীরা মারীর মুখোমুখি হ’তে বাধ্য হয়েছিলেন। পিপিই-র বদলে জুটেছিল ছেঁড়া রেনকোট! এখনো মাস্কের জোগান রীতিমতো অপ্রতুল। যে সুরক্ষাটা স্বাস্থ্যকর্মীদের অধিকার, যেটা তাঁদের নায্য পাওনা সেটা তাঁরা অধিকাংশ জায়গায় এখনো পাচ্ছেন না। হ্যাঁ, বছর ঘুরেও। শুরুর দিনগুলোর থেকে পরিস্থিতি অনেক বদলেছে ঠিক। কিন্তু এখনো এন ৯৫ পাওয়া মানে চাঁদ হাতে পাওয়া। এই প্রসঙ্গে একটি ছোট্ট, অপ্রয়োজনীয় এবং ফুটনোটের সবার নিচের লাইনে লেখার মতো তথ্য জানিয়ে রাখা যাক- দেশে করোনার আক্রমণে ছয় শতাধিক চিকিৎসক মারা গেছেন! যদিও তাঁরা কেউই সিয়াচেনে কাজ করতেন না। তাঁদের নিয়ে আবেগ থরথর বলিউডি সিনেমা তৈরি হবে না। অতয়েব সেসব নিয়ে ভেবে কাজ নেই। তার চেয়ে বরং এসির ঠান্ডায় বসে ভোটরঙ্গ উপভোগ করাই ভালো।
এপ্রিলের শুরুতেই এরকম গরম, ভোটের উত্তাপ আর মারীর ভ্রূকুটি মিলিয়ে আমরা স্বাস্থ্যকর্মীরা অন্তত ভয় পাচ্ছি। জানি, সেসবে আপনাদের কিছু যায় আসে না কেননা আপনি বেশ জানেন, স্বাস্থ্যকর্মী মানেই সমাজের ‘সেবা’য় বলিপ্রদত্ত। কফ-থুতু-রক্ত ভরা তাঁদের ‘যৌবনের উপবন’। সমাজের খিস্তিময় ‘বার্ধক্যের বারানসী’। আসলে জাতটাই ওরকম বিচ্ছিরি, নোংরা!
তবু দিনগত পাপক্ষয় হিসেবে শেষবেলায় দুটো জ্ঞান দিয়ে যাই। সবার কথা, মারীর দেশের অসহায়তার কথা ভাবার দরকার নেই। অন্তত নিজের আর পরিবারের সুরক্ষার কথা ভেবে মাস্ক পরুন। ভোটরঙ্গ শেষে ফলাফল যাই হোক, মাথায় রাখবেন- বিপদের দিনে দরকারে আপনার পাশের বাড়ির মানুষটাকেই পাবেন। ভোটের ফুলবাজিতে মেতে নিজেকে ‘ফুল’ বানাবেন না। ভোটের উত্তাপে অন্ধ হয়ে নিজের যাবতীয় মানবিকতা বিসর্জন দিলে আদপে ক্ষতিটা আপনারই। দিনের শেষে, ভোট-বসন্তের কোকিল শীত-গ্রীষ্মের কেউ নয়।
(অনেক জ্ঞান দিলাম। এবার একটু মন হাল্কা করার ছবি দেখুন। বকগুলো গরুর পাশে পাশে ঘুরে বেড়ায়। গরুর গা থেকে খুঁটে খুঁটে পোকা খায় বোধহয়। লেখার সাথে ছবির কোনও সম্পর্ক নেই। জোর করে সম্পর্ক খোঁজার চেষ্টা করবেন না।)