আমি নতুন করে লকডাউন এর ঘোরতর বিরুদ্ধে। আবার লকডাউন হলে মানুষের আর ভোগান্তির সীমা থাকবে না। আগের বছর লকডাউনের সময় সাধারণ মানুষের এত অসহায়তা দেখেছি, সারা জীবনে ভুলতে পারা মুশকিল।
লকডাউনে কত মানুষ কাজ হারিয়ে বেকার হয়ে গেছেন, কত শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছেন- এসব অর্থনীতিবিদেরা বলতে পারবেন। একজন স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে নিজের চোখে যেটুকু দেখেছি সে টুকু বলতে পারি।
দীর্ঘমেয়াদী অসুখে আক্রান্ত বহু মানুষ যাঁরা সরকারি হাসপাতাল থেকে ওষুধ খেতেন, লকডাউনের সময় ওষুধ ও চিকিৎসা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এর পেছনে প্রধানত দুটি কারণ ছিল। হাসপাতালে যাওয়ার জন্য যানবাহনের অভাব এবং হাসপাতালে গেলেই করোনা হবে এই ভয়।
যাঁরা ওষুধ কিনে খেতেন অনেকেই অর্থের অভাবে ওষুধ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। প্রেশার, সুগারের অতি প্রয়োজনীয় ওষুধ বন্ধ করায় অনেকেই স্ট্রোক, হার্টের মারাত্মক অসুখে আক্রান্ত হয়েছেন।
আমাদের মত খুপরিজীবি চিকিৎসকদের ডেথ সার্টিফিকেট খুব বেশি লিখতে হয় না। শহরাঞ্চলে অসুস্থ রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করে শেষ চেষ্টা করা হয়। লকডাউনের সময় রোজই প্রায় তিন-চারটি ডেথ সার্টিফিকেট লিখতে হয়েছে। হার্ট অ্যাটাকের রোগীকে দুপুরে দেখে বলেছি, এখুনি কোনো মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। সেই রোগীর বাড়ির লোক রাত্রে ডাকতে এসেছেন। রোগীকে তাঁরা কোথাও নিয়ে যেতে পারেননি। বাড়িতেই মারা গেছেন।
একটা জনস্বাস্থ্য বিপর্যয়কে ঠেকানোর জন্য লকডাউন আরো বড় জনস্বাস্থ্য বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। লকডাউন এর পরিস্থিতি যাতে তৈরি না হয় তার জন্য দরকার ছিল কোভিড আচরণবিধি কঠোরভাবে মেনে চলা। আমরা তাতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছি। আর ভোটের বাঁশি বেজে যাওয়ার পর মনেই হচ্ছে না আমরা একটা মহামারীর দ্বিতীয় ঢেউয়ের মধ্যে রয়েছি।
মধ্যমগ্রামের এক ভোট প্রার্থীর বিনা মাস্কেই সাক্ষাৎকার শুনে হতবাক হয়ে গেলাম। ভিডিও লিংক প্রথম কমেন্টে দিলাম। তিনি বললেন, ‘আমরা রোদের মধ্যে রয়েছি। সেখানে একটা মিনিমাম টেম্পারেচারের পর করোনা তো থাকে না। এখানে কারো করোনা হবে না। আমি প্রত্যেককে বলে দিয়েছি বাড়ি ফিরে গরম জলে (প্রথমে সম্ভবত গঙ্গাজল বলতে গিয়ে সামলে নিয়েছেন) স্নান করতে, হ্যান্ড ওয়াশ করতে, গরম জলে গার্গেল করতে- কোনো প্রবলেম হবে না। সারাদিন এতো হিটের উপর আছি তাতে করোনা আসবে বলে মনে হয় না। ডক্টর বলেছে চারদিনের মধ্যে আমরা যদি নিজেকে ট্রিটমেন্ট এর মধ্যে রাখি তাহলে কিছু হবে না।’
সঞ্চালক যখন জিজ্ঞেস করলেন, ‘তাহলে মাস্ক পরার দরকার নেই?’
উনি জবাব দিলেন, ‘আমার কাছেও মাস্ক রয়েছে। যখন বাইরে গেছি, ভেতরে গেছি তখনও ছিল। সেগুলো ঠিকঠাক করেই রেখেছি। ওই নিয়ে চিন্তা করার কিছু নেই।’
তবে একটু চিন্তা হয় বইকি। এনাদের কথা বহু মানুষ শুনছেন, প্রভাবিত হচ্ছেন।
১. গতবছর গোটা গরমকাল করোনা দাপিয়ে বেড়িয়েছিল। বরঞ্চ শীতকালে ডিসেম্বর, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে কেস অনেক কমে গেছিল।
২. দ্বিতীয় ঢেউয়ে মহারাষ্ট্র, রাজস্থানের অবস্থা খুবই খারাপ। এই রাজ্য দুটিতে নিশ্চয়ই বরফ পরে না।
৩. বাংলাতে গরম ও ভোটের গরম যত বাড়ছে করোনার কেস প্রায় গুণোত্তর প্রগতিতে বাড়ছে।
৪. ৩৮ ডিগ্রী গরমে বাড়ি ফিরে গরম জলে স্নান করলে আর যাই হোক করোনা পিছু হটবে না।
৫. পকেটে মাস্ক যত্ন করে রেখে দিলে করোনা আটকাবে না। মাস্ক দিয়ে নাক- মুখ ঢাকলে তবেই করোনা আটকাবে।
৬. চারদিনের মধ্যে ট্রিটমেন্ট- বস্তুটা সম্ভবত ওনার মস্তিষ্কপ্রসূত।
অথচ উনি যদি নিজে মাস্ক পরে ক্যামেরার সামনে বলতেন, সকলে মাস্ক পরুন, ভ্যাকসিন নিন- তাহলে বহু মানুষের কাছে সঠিক বার্তা পৌঁছাতো।
এই করোনাকালে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচণ্ড ক্ষতি হয়েছে। ১ বছরের অধিক সময় স্কুল বন্ধ। যারা প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়া তারা যেটুকু শিখেছিল, পুরোটাই ভুলে যাচ্ছে।
সকলেই ভেবেছিল ভোটের পর স্কুল খুলে যাবে। কিন্তু যে ভাবে করোনা আবার ছড়াচ্ছে- এ বছর স্কুল খুলবে কিনা বলা মুশকিল। এই নিয়ে এবার ভাবনা চিন্তা করার সময় এসেছে।